আইএসএলে ইতিহাস তৈরি করল মোহনবাগান। প্রতিযোগিতার দশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম লিগ-শিল্ড জিতল তারা। সোমবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মরণ-বাঁচন ম্যাচে মুম্বই সিটি এফসি-কে হারিয়ে দিল ২-১ গোলে। লিস্টন কোলাসো এবং জেসন কামিংস গোল করেন মোহনবাগানের হয়ে। মুম্বইয়ের একমাত্র গোল লালিয়ানজুয়ালা ছাংতের। গত বছর আইএসএলের ট্রফি জিতলেও লিগ-শিল্ড কখনও জেতেনি তারা। সেই স্বপ্নও পূরণ হয়ে গেল আন্তোনিয়ো হাবাসের দলের। ২২ ম্যাচে ৪৮ পয়েন্ট নিয়ে লিগ-শিল্ড শেষ করল তারা। এখনও তাদের সামনে আইএসএলের ট্রফি পেয়ে ‘ডাবল’ করারও সুযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, লিগ-শিল্ড জেতার ফলে পরের মরসুমে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২-এর গ্রুপ পর্বে সরাসরি খেলার সুযোগও পেয়ে গেল মোহনবাগান।
ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আধিপত্য দেখিয়ে দাপট নিয়েই মুম্বইকে হারানো মোহনবাগান। এই ম্যাচে তাদের কাছে জয় ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। মোহনবাগানের খেলার মধ্যে আগাগোড়া সেই মনোভাবই লক্ষ করা গিয়েছে। দু’গোলে এগিয়ে গিয়েও তাদের মধ্যে কোনও রকম আত্মবিশ্বাস দেখা যায়নি। অন্য দিকে, মুম্বই হারল নিজেদের ভুলে। প্রথম থেকে সময় নষ্টের অন্য খেলায় মেতেছিল তারা। বল পায়ে এলেও যথেষ্ট আক্রমণ ছিল না। বোঝাই যাচ্ছিল, জয় নয়, ড্র করেই লিগ-শিল্ড জিততে যায় তারা। কিন্তু মরিয়া হয়ে থাকা মোহনবাগানের সামনে ড্র করার মনোভাব যে কতটা ক্ষতিকর তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন মুম্বই খেলোয়াড়েরা।
মোহনবাগানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হয়ে যায় ডাগআউটে হাবাস ফেরায়। হাবাস যে দলের কত বড় চালিকাশক্তি তা বলার অপেক্ষা রাখেন না। স্প্যানিশ কোচ অসুস্থতার কারণে সাইডলাইনের ধারে বেশি ক্ষণ দাঁড়াতে পারছিলেন, গিয়ে বার বার বসে পড়ছিলেন। তবু তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততায় কোনও খামতি লক্ষ করা যায়নি। দরকারে রেফারির সঙ্গে যেমন তর্ক জুড়েছেন, তেমনই ফুটবলারদের মাথায় হাত দিয়ে তাঁদের দায়িত্ব বুঝিয়েছেন।
মোহনবাগান শুরুটা করে আক্রমণাত্মক ভাবেই। বিশ্বকাপার জেসন কামিংসকে প্রথম একাদশে না রেখে দিমিত্রি পেত্রাতোস এবং আর্মান্দো সাদিকুকে দিয়ে শুরু করেছিলেন হাবাস। তিন ম্যাচ পর ডাগআউটে তিনি ফেরায় আগে থেকেই উদ্বুদ্ধ ছিলেন মোহনবাগানের খেলোয়াড়েরা। প্রথম থেকেই তাঁরা আক্রমণের ঝড় বইয়ে দেন। খেলার দু’মিনিটের মধ্যে শুভাশিস বসুর পাস থেকে মনবীর সিংহ বল পেলেও গোল করতে পারেননি।
কিন্তু মুম্বইও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। কোচ পিটার ক্রাতকি ভালই জানতেন মোহনবাগানের দুই প্রধান অস্ত্র কারা। তাই পেত্রাতোস এবং জনি কাউকো বল পেলেই ঘেরাও হয়ে যাচ্ছিলেন। মুম্বই বরং অনেক বেশি শান্ত হয়ে খেলছিল। বল কেড়ে নিয়ে আক্রমণের রাস্তায় হাঁটছিল তারা। বল পেলেও কোনও রকম তাড়াহুড়ো নেই। মুম্বইয়ের আক্রমণ হচ্ছিল মূলত দুই প্রান্ত দিয়ে। বাঁ দিকে বিপিন সিংহ এবং ডান দিকে লালিয়ানজুয়ালা ছাংতে বার বার সমস্যায় ফেলছিলেন মোহনবাগানের রক্ষণকে। উল্টো দিকে, মুম্বইয়ের রক্ষণ ছিল জমাট। মোহনবাগানের একের পর এক আক্রমণ করলেও কোনওটাই দানা বাঁধছিল না।
২০ মিনিটে মোহনবাগানের কাছে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছিল। ডান দিকে বল পেয়ে অনিরুদ্ধ থাপা ক্রস ভাসিয়েছিলেন বাঁ দিকে একা দাঁড়িয়ে থাকা লিস্টনের উদ্দেশে। লিস্টন সেই বল হেড করলেও তা পোস্টে লেগে প্রতিহত হয়। ফিরতি বল উড়িয়ে দেন অভিষেক সূর্যবংশী। তবে সবুজ-মেরুনের একের পর এক আক্রমণ দেখে মনেই হচ্ছিল গোল সময়ের অপেক্ষা। সেটাই হল।
লিস্টন বার বারই বাঁ দিক থেকে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। ২৭ মিনিটের মাথায় বক্সের একটু বাইরে বল পেয়ে পেত্রাতোস পাস দেন লিস্টনকে। তাঁর সামনে মুম্বইয়ের একাধিক ডিফেন্ডার ছিলেন। সামনে থাকা বিপিনকে প্রথমে বাঁ দিক, পর ক্ষণেই ডান দিকে গিয়ে মাটি ধরিয়ে বাঁকানো শট মারলেন লিস্টন। নিখুঁত কোণ দিয়ে বল জড়িয়ে গেল জালে। মুম্বই গোলকিপার ফুর্বা লাচেনপা ঝাঁপিয়েও বলের নাগাল পাননি।
মোহনবাগানের ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে কোনও কার্পণ্য করেননি সমর্থকেরা। মাঠ ভরিয়ে এসেছিলেন হাজার পঞ্চাশেক সমর্থক। লিস্টন গোল করতেই আবেগ বাঁধ মানল না। লিস্টন নিজেও সাইডলাইন টপকে সমর্থকদের সঙ্গে উচ্ছ্বাস করতে এগিয়ে গেলেন। তাঁর পিছু পিছু বাকি ফুটবলারেরা। গোল হজম করে মুম্বইয়ের মন ফিরেছিল খেলায়। এত ক্ষণ তাঁদের মধ্যে সময় নষ্টের একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। ফাউল বা কর্নার নেওয়ার সময় অহেতুক অনেক সময় নষ্ট করছিলেন মুম্বইয়ের খেলোয়াড়েরা। কিন্তু গোল খেয়ে তাদের আক্রমণের ঝাঁজ বাড়ল। সেই ঝাঁজেই বিরতির এক মিনিটের আগে গোল খেয়ে যেতে পারত মোহনবাগান। ছাংতে বল পেয়ে ডান দিকে জর্জে পেরেরা দিয়াসকে পাস দিয়েছিলেন। পেরেরা পাল্টা পাস দেন ছাংতেকে। সামনে ফাঁকা গোল। বলে পা ঠেকালেই চলত। কিন্তু আগেই পিছলে যাওয়ায় সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলেন না ছাংতে।
দ্বিতীয়ার্ধে মোহনবাগানের আক্রমণের গতি একটু কমে গেল। যে গতিতে তারা প্রথমার্ধে খেলেছিল তা ধরে রাখতে পারছিল না। ফলে মুম্বইয়ের আক্রমণ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু দলে এত প্রতিভাবান ফুটবলারেরা থাকা সত্ত্বেও মুম্বই কোনও ভাবেই মোহনবাগানের ধারেকাছে যেতে পারছিল না। দুই দলের মধ্যে লড়াই হচ্ছিল মাঝমাঠেই। রক্ষণ শক্তিশালী করার লক্ষ্যে অভিষেকের জায়গায় দীপক টাংরিকে নামিয়ে দেন হাবাস। এর পর সাদিকু এবং কাউকোকে তুলে নামান কামিংস এবং ব্রেন্ডন হ্যামিলকে।
মুম্বই তবু একের পর এক চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু তাদের সব প্রতিরোধ শেষ হয়ে যায় ৮০ মিনিটে। নিজেদের অর্ধে বল পেয়ে কামিংস পাস দিয়েছিলেন বাঁ দিকে থাকা পেত্রাতোসকে। সেই বল ধরে পেত্রাতোস আবার পাস দেন উল্টো দিকে ছুটতে থাকা কামিংসকে। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপারের প্রথম বার ঠিক মতো বল ধরতে পারেননি। কিন্তু ধারেকাছে মুম্বইয়ের কোনও ফুটবলার না থাকার ফায়দা তোলেন। ঠান্ডা মাথায় লাচেনপার পাশ দিয়ে বল জালে জড়িয়ে মোহনবাগানের দ্বিতীয় গোল করেন।
কিন্তু খেলা তখনও শেষ হয়ে যায়নি। দু’গোল হজম করেও লড়াই ছাড়েনি মুম্বই। মোহনবাগানের মনঃসংযোগের সামান্য ভুলে ৮৯ মিনিটে গোল করেন ছাংতে। এ বারের আইএসএলে শেষ মুহূর্তে গোল করে অনেক পয়েন্ট ছিনিয়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে মুম্বইয়ের। গ্যালারির ৬১ হাজার দর্শক আচমকাই নিস্তব্ধ। এখানেও সে রকম কিছু দেখা যাবে না তো। ম্যাচের শেষ দিকে দু’দলের খেলোয়াড়েরাই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। লাল কার্ড দেখলেন হ্যামিল। দশ জনে হয়ে যাওয়ায় রক্তচাপ আরও বেড়ে গিয়েছিল মোহন-সমর্থকদের। পরের দিকে ঝামেলার কারণে কামিংস এবং লাচেনপাকেও হলুদ কার্ড দেখানো হল। কিন্তু ম্যাচে আর ফিরতে পারল না মুম্বই। ঘরের মাঠে লিগ-শিল্ড জিতেই ইতিহাস তৈরি করল মোহনবাগান।