১। চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িকতা
২। হিমশৈলের চূড়া
৩। কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রশ্ন
৪. ধর্ম যখন উপলক্ষ্য
৫। সত্যের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা
৬। ইতিহাসবিদ বনাম ইতিহাস
৭। নভেম্বর-৯ ইতিহাস পরিবর্তন করবে
৮। শিল্যান্যাস থেকে “বার্লিনের পাঁচিল” পর্যন্ত
৯। রাম-জন্মভূমি মন্দির সংক্রান্ত মুসলিম বিবৃতি
১০। বোবা সাক্ষী কথা বলুক
উপসংহার
১৯৯০ সালে ভয়েস অফ ইণ্ডিয়া এই বইটি প্রকাশ করে। হিন্দুত্ববুক্সের সাথে যৌথ উদ্যোগে এই বইটি পাঠকদের সামনে নিয়ে আসল বঙ্গদেশ। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা সরকার।
মুখবন্ধ
রাম-জন্মভূমি মন্দির পুনর্নির্মাণ সংক্রান্ত প্রচেষ্টাগুলি ভারতের ইতিহাসের একটি লুপ্ত ও সুপ্ত অধ্যায়কে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। এ ইতিহাস মুসলিম আক্রমণকারী দ্বারা ব্যাপক মাত্রায় হিন্দু মন্দির ধ্বংসের ইতিহাস – এ ইতিহাস আজও অসমাপ্ত। এই গ্রন্থের উপসংহারে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অধুনা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক আকারে মুসলিমদের দ্বারা মন্দির ধ্বংসের তথ্যাবলী লিপিবদ্ধ করা আছে। বর্তমানে কাশ্মীরের মন্দিরগুলিও – যেগুলি যতটা অবশিষ্ট আছে- একইরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে ক্রমশঃ ধংস হয়ে যাচ্ছে।
এই অনুচ্ছেদটি – যদিও একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়ের অংশ মাত্র – তথাপি এটি মধ্যযুগের মুসলিম চরিত্রটিকে বিশেষভাবে উপস্থাপিত করে – যা তৎকালীন মুসলিম ঐতিহাসিকদের রচনায় দেখতে পাওয়া যায়। তৎকালীন মুসলিম চরিত্রের বিভিন্ন আঙ্গিকগুলি হলো
১) নির্বিচারে গণহত্যা – শুধুমাত্র যুদ্ধের সময়ই নয়, তারপর ইসলামিক সৈন্য বিজয়ী হবার পরেও
২) ব্যাপক সংখ্যায় সাধারণ মানুষদের বন্দী বানানো ও তাদের ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি
৩) জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করা
৪) একান্ত প্রতিবাদীদের নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ও তাদের উপর অমানবিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি
৫) অমুসলিমদের অস্ত্রহীন ও শক্তিহীন করে দেওয়া
৬) ভারী বৈষম্যমূলক করের মাধ্যমে অমুসলিমদের দারিদ্র্যকে বাড়িয়ে দেওয়া এবং কৃষকরা যা উৎপাদন করেছিল তার একটি বড় অংশের থেকে তাদের বঞ্চিত করা
৭) অমুসলিমদের দেশীয় এবং জাতীয় সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে তাকে অবজ্ঞা ও ঘৃণার মধ্যে ঠেলে দেওয়া।
তবে এই আচরণের ধরণটি সম্পূর্ণ অতীতের বিষয় নয়। মুসলিম শাসনের পরেও তা বজায় ছিল। ঊনিশ শতকে মুসলিম পুনরুত্থানবাদী আন্দোলন বিশেষতঃ বাংলায়, মধ্যযুগীয় মুসলিম শাসনের একটি প্রতিচ্ছবির পুনর্নির্মাণের যথাসম্ভব চেষ্টা করেছিল। তারপর আরো সাম্প্রতিক কালে পাকিস্তান নামক ইসলামী রাষ্ট্রটির জন্মের পরে, হিন্দুরা একদিকে যেমন পশ্চিম দিকে পাকিস্তানের অংশ থেকে দেশছাড়া হয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে অন্যদিকে তেমনি এর পূর্ব শাখা থেকে আগত শরণার্থীরা বাধ্য হয়েছে পূর্ব-পাকিস্তানে তাদের পূর্বপুরুষদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে আসতে। অতঃপর পূর্বপাকিস্তান একটি স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র বাংলাদেশ নামে আত্মপ্রকাশ করে – যা ভারতের সহায়তায় সম্ভব হয়েছিল। হিন্দু মন্দির এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি পাকিস্তান থেকে ক্রমাগত অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং বাংলাদেশেও সেগুলি বারংবার আক্রান্ত হয়েছে।
এই এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে একই রকম চলে আসা এই আচরণের ধরনটির ভিত্তি কী? কোথায় এর আদর্শগত উৎস?
এর উত্তর ইসলামের ধর্মীয় শিক্ষা, ধর্মতত্ত্ব এবং এর ধর্মীয় আইনগুলিতে নিহিত। এটি উদ্ভূত এর মোমিন এবং কাফিরের অদ্ভুত ধারণা থেকে, এর জিহাদ মতবাদ থেকে, দারুল-ইসলাম এবং দারুল-হার্বের ধারণা থেকে এবং যেটি একটি মুসলিম রাষ্ট্রের কর্তব্য হিসাবে বিবেচিত হয় তার থেকে। ভারতের হিন্দুদের গভীরভাবে ইসলামের অধ্যয়ন করতে হবে – এখন পর্যন্ত যতটা করা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এই কাজটিকে উপেক্ষা করার অর্থ নিজের ধ্বংস নিজে ডেকে আনা।
বর্তমান রচনাটি অবশ্য এ জাতীয় অধ্যয়ন উপস্থাপনের চেষ্টা করে না। কীভাবে হিন্দু মন্দিরগুলিকে ধ্বংস এবং অপবিত্র করে মসজিদ ও খানকাতে রূপান্তরিত করা হয়েছিল – বইটি সে সম্বন্ধে আলোকপাত করে। সেই সঙ্গে এটি ইসলামিক প্রতিমাধ্বংসী মতাদর্শের একটি আলোচনা প্রস্তুত করেছে। এটি অন্যান্য ধর্মের প্রসঙ্গ এবং প্রতিমাধ্বংসী বিষয়গুলিরও উল্লেখ করেছে। বইটিতে অযোধ্যা নিজের গুরুত্ব ধরে রেখেছে, তবে বইটি অযোধ্যা-কেন্দ্রিক নয়।
বিষয়টি নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে এটি সত্যের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বস্ততা অনুশীলন করে। এটি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং মার্ক্সবাদী লেখকদের মত ইতিহাসের পুনর্লিখন করে না। এর লক্ষ্য হল আমাদের জনগণের তথ্যের স্তর বাড়ানো এবং সেই সম্পর্কে তাঁদের আরও ভাল ভাবে সচেতন করা।
মহাবীর জয়ন্তী
এপ্রিল ৭, ১৯৯০
প্রকাশক
প্রথম অধ্যায় : চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িকতা
– অরুণ শৌরী
বিখ্যাত মুসলমান লেখক, যিনি ভারতের ইসলামিক শিক্ষার অন্যতম বৃহৎ কেন্দ্রের চতুর্থ শিক্ষক ছিলেন, তাঁর একটি বিখ্যাত বইয়ে জানা যায় বাবরি মসজিদ সহ আরো কয়েকটি মসজিদের কথা, যেগুলি হিন্দু মন্দিরের স্থানে ও মন্দিরের কাঠামো ও ভিত্তির উপর নির্মিত হয়েছিল। গ্রন্থটির ইংরেজি সংস্করণে ঠিক সেই অংশগুলিই বেছে বেছে বাদ দেওয়া হয়েছে।
জানা যায় যে বইটি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য, কারণস্বরূপ দেখা যায় যে : আজ থেকে মাত্র ১৫ বছর আগে সর্বোচ্চ প্রভাবশালী মুসলিম পণ্ডিত ও বর্তমানে ইসলামিক শিক্ষাকেন্দ্রের অধ্যক্ষ ও মুসলিম ল বোর্ডের অধ্যক্ষের আদেশানুসারে এটি করা হয়েছিল।
ফাঁকি দেওয়া, আড়াল করা এসব একটা জাতীয় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এবং তার পরিণতিও অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তবে আমি অবশ্যই প্রথমে আপনাকে একটি পটভূমি দেব।
লখনউয়ের নাদওয়াতুল-উলামা ভারতবর্ষের ইসলামী শিক্ষার প্রাথমিক কেন্দ্র। এটি ১৮৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে দেওবন্দের দারুল-উলুমের পরেই এর স্থান। “ভারতে ইসলামিক শিক্ষার কেন্দ্রসমূহ” শীর্ষক সরকারী প্রকাশনা এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে এর প্রতিষ্ঠাতা কীভাবে দক্ষ পণ্ডিতদের তৈরি করতে চেয়েছিলেন যাঁরা আধুনিক বিশ্বের সামনে কার্যকরভাবে ইসলামের সত্য চিত্র উপস্থাপন করতে পারেন।
তাঁদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য অর্থাৎ শিক্ষামূলক সংস্কারের জন্য তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন যা শুধুমাত্র ধর্মীয় ও তৎকালীন বিজ্ঞান শিক্ষাই দেবে না সঙ্গে সঙ্গে কারিগরি প্রশিক্ষণও প্রদান করবে।
নাদওয়া কলেজ আজ অসামান্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হয় তার সুবিশাল ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ও গবেষণা, প্রকাশনা বিভাগ ও ইসলামিক বিজ্ঞান শিক্ষার নির্দেশ দেওয়ার জন্য। এই প্রতিষ্ঠানটির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নিরপেক্ষ গবেষণা।
নাদওয়ার গ্রন্থাগারটি, যা কেন্দ্রীয় হলঘরটিতে অবস্থিত এবং মূল ভবনের আশেপাশের কক্ষগুলি দ্বারা বেষ্টিত, এই গ্রন্থাগারে প্রায় ৭৫,০০০ এর অধিক শিরোনাম সহ প্রায় ৩,০০০ হস্তলিখিত গ্রন্থ রয়েছে যার মধ্যে বেশিরভাগ আরবী এবং তার সঙ্গে ফার্সি, উর্দু, ইংরাজী ভাষায় লেখা। উপমহাদেশের সেরা গ্রন্থাগারগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। প্রতিবেদনটি ১০ বছর আগে লেখা হয়েছিল। গ্রন্থাগারে এখন ১২৫,০০০ বই রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের প্রধান
বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হলেন মওলানা আবুল-হাসান আলী নদভী। আলী মিয়াঁ, যে নামে তিনি দেশে বিদেশে সরকারী ও বেসরকারী মহলে, পণ্ডিতদের মধ্যে সকলের কাছে পরিচিত, নিঃসন্দেহে তিনি আজকের দিনে সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম শিক্ষক ও ব্যক্তিত্ব।
তিনি ‘জামাত-ই-ইসলামী’ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন। কিন্তু মাওলানা মওদুদীর সঙ্গে মতবিরোধের কারণে তিনি এই সংগঠন ত্যাগ করেন। এখন তিনি ‘মুসলিম পার্সোন্যাল ল বোর্ড’এর চেয়ারম্যান। তিনি ‘রাবতা আলম-ই-ইসলামী’ সংগঠনেরও প্রতিষ্ঠাতা। সংগঠনটি একটি সর্বব্যাপী ইসলামিক সংগঠন যার কেন্দ্রস্থল মক্কায় অবস্থিত। এটি অন্যান্য কাজের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ইসলামিক সংগঠনগুলির আর্থিক অনুদান নির্ধারণ করে।
১৯৬১ সাল থেকে ২৫ বছরের বেশি সময়ের জন্য তিনি দারুল উলুম নাদওয়াতুল-উলমার নাজিম অর্থাৎ অধ্যক্ষ ছিলেন। নাদওয়া তার ক্রমবর্ধমান উন্নতি, নতুন উদ্যোগ ও জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় যোগাযোগের জন্য অনেকটাই আলী মিঞার কাছে ঋণী।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যেমন রাজীব গান্ধী, বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ, চন্দ্রশেখর তাঁর ওপর ভরসা রাখতেন।
তিনি অনেকগুলি পুস্তক রচনা করেছিলেন যার মধ্যে ‘ইনসানি দুনিয়া পর মুসলমানো কি উরজ ও জভাল কা আসর’ (মানবজীবনের ওপর মুসলিমদের উত্থান ও পতনের ফলাফল) অন্যতম এবং এটিকে ইসলামিক ল, ব্যবহার শাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদির প্রামাণ্য হিসেবে দাখিল করা হয়। ভারতের মুসলিম রাজনীতির ওপর তাঁর প্রচুর প্রভাব রয়েছে।
তাঁর পিতা ও তাঁর বই
তাঁর পিতা মৌলানা হাকিম সৈয়দ আবদুল হাইও ছিলেন খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি। মৌলানা মহম্মদ মনঘ্রি, নাদওয়ার প্রথম অধ্যক্ষের উদ্যোগে ১৮৯২ সালে নাদওয়ার প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে তিনি মৌলানা আবদুল হাই মহাশয়কে উপাধ্যক্ষের পদে নিয়োগ করেন।
আবদুল হাই ১৯১৫ সাল পর্যন্ত উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার পালন করার পর তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন।
তাঁর পাণ্ডিত্য ও ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর কাজের জন্য ১৯২০ সালে তিনি পুনরায় অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন এবং ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস অবধি আমৃত্যু তিনি এই পদে আসীন ছিলেন।
তিনিও অনেক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে সাম্প্রতিক কালে হায়দ্রাবাদ থেকে পুনঃপ্রকাশিত একটি তথ্যপঞ্জী উল্লেখযোগ্য। ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যে সব মুসলিমরা ভারতের বিপুল সংখ্যক জনসাধারণ কে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিলেন তাঁদের কথা সেই বইতে লেখা আছে।
কর্মসূত্রে আমি তাঁর লেখা একটি বইয়ের সম্পর্কে জানতে পারি এবং সেটি সংগ্রহের চেষ্টা করি।
বইটি বিভিন্ন বিষয় যেমন ভৌগোলিক বর্ণনা, উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ, ভাষা, ভারতের অধিবাসী ও অঞ্চল ইত্যাদি সম্পর্কে একটি সুবিশাল বর্ণনা সম্বলিত। বইটি আরবী ভাষায় লেখা হয়েছিলো সেখানকার লোকেদের জন্য।
১৯৭২ সালে নাদয়াতুল-উলমা বইটির উর্দু ভাষান্তর করে, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরিচ্ছেদগুলি একটি বই এর আকারে প্রকাশ করে; যার নাম ‘হিন্দুস্তান ইসলামী আহাদ মেইঁ’ (ইসলামী শাসনে হিন্দুস্তান)। আলি মিঞা বইটির ভূমিকা লেখেন এবং তাঁরই নির্দেশে বইটি প্রাধান্য পায়। পূর্বোক্ত বইটিতে ভৌগোলিক বর্ণনা সংক্রান্ত পরিচ্ছেদগুলি বাদ দেওয়া হয়েছিলো কারণ সেটি ভারতীয় পাঠকদের কাছে অজানা ছিল না।
অপ্রত্যাশিত অনাগ্রহ
একটি ঘটনা আমাকে খুব অবাক করে। যাঁদের এই বইটি সম্পর্কে অবগত থাকার কথা তারা হঠাৎই এই বইটি সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যান। এমনকি আমি এটাও শুনেছিলাম যে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে বইটির অনুলিপিগুলিও অপসারণ করা হয়েছিল। অনেকে এটাও জানিয়েছিলেন যে ৩-৪ বছর আগে বইটির সমস্ত অনুলিপিগুলি প্রত্যাহার করার একটি সক্রিয় প্রচেষ্টা হয়েছিলো।
সৌভাগ্যক্রমে সেটি সফল হয়নি। কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থাগারে যেমন দিল্লির ‘জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া’, হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত গ্রন্থাগার গুলি যেমন ‘ডাইরুতুয়াল মারিফাল-ওসমানিয়া’, ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজাম ট্রাস্টের ‘সালার জঙ্গ মিউজিয়াম’, কুতুবখানা-ই-সাইদিয়াতেও এই বইটি ছিলো না। নাদওয়া গ্রন্থাগার, পাটনার খুদাবক্স গ্রন্থাগার এবং দিল্লির ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক স্টাডিজে বইটি পাওয়া যায়।
এই গ্রন্থাগারগুলিতে বইটির প্রাপ্তি আমায় স্বস্তি দিয়েছিলো। আমার মনে হয়েছিল যে প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রচারকরা যদি এতটাই সুসংহত হয়ে যান যে যাতে তাঁরা তাঁদের অপছন্দের বইটিকে সমস্ত গ্রন্থাগার থেকে সরিয়ে ফেলতে পারেন তাহলে সেটি আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের। স্পষ্টতঃ তাঁরা ততটাও করিৎকর্মা ছিলেন না।
পারতপক্ষে বইটির উপস্থিতি আমাকে আরো একটি আশ্বাস দেয় যে মুসলিম মৌলবাদীদের মধ্যে দলীয় লড়াই আছে, যেমনটি অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। বইটির অপ্রাপ্তির পিছনে কিছু আঁতাত থাকতে পারে, এই সম্ভাবনা কিছু দায়িত্বশীল মুসলিম মহল থেকেই এসেছিল।
মূল্যবান উপহারটি একটি ঐতিহাসিক স্বাক্ষ্য
বইটি মজলিশ তেহিকিকাত ওয়া নশরিয়াত ইসলাম প্রকাশনা সংস্থার ৬৬তম প্রকাশনা। এটি নাদওয়াতুল-উলমা, লখনৌয়ের প্রকাশনা সংস্থা। এর আরবী সংস্করণটি ১৯৭২ সালে হায়দ্রাবাদে এবং উর্দু সংস্করণটি ১৯৭৩ সালে লখনৌতে প্রকাশিত হয়। একটি ইংরেজি সংস্করণও ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি উদাহরণ হিসেবে উর্দু সংস্করণটি ব্যবহার করবো।
মৌলানা আবুল হাসান আলি নদবী অর্থাৎ আলি মিঞা নিজেই বইটির ভূমিকা রচনা করেছেন। ভূমিকাটি একটি কাব্যের ন্যায় প্রাঞ্জল।
তিনি লিখেছেন যে, ইসলাম তার অনুসারীদের সত্যের সন্ধানে এবং দেশপ্রেমের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে ও মুসলিমদের প্রকৃতি ও তাদের সংস্কৃতি তাদেরকে সত্য ইতিহাসের লেখক করে তুলেছে।
তিনি লিখেছেন মুসলিমদের কেবল একটি দেশে পৌঁছনোর অপেক্ষা ছিলো সেই দেশের শত সহস্র বছরের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাগ্যকে আলোকিত করার জন্য। তিনি লিখেছেন : এর পরেই দেশটি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আরোহণ করবে, বিস্মৃতি এবং অস্পষ্টতা থেকে নােন্সরম এবং খ্যাতির শিখরে পৌঁছে যাবে। সঙ্কীর্ণতার গণ্ডী ছাড়িয়ে তারা বৃহত্তর মানব সংসারের অংশ হয়ে উঠবে এবং ঈশ্বরের বিস্তৃত সৃষ্টিতে যোগদান করতে পারবে। তিনি লিখেছেন: এর মধ্যে দিয়ে ইসলামের উজ্জ্বলতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি লিখেছেন, পশ্চিমী শক্তিগুলির মত দেশের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে তারা অন্যত্র সঞ্চয় করেনি। বরং তারা পরিশীলন, সংস্কৃতি, উপকারী প্রশাসন ও প্রশান্তির বাহক হয়েছে। বর্বরতার যুগ থেকে অগ্রগতির যুগে দেশকে উন্নীত করেছে যা শৈশব থেকে সাবালকত্বে উন্নীত হবার সমান। তারা অনুর্বর ভূমিকে চাষযোগ্য করেছিল, বন্য ঝোপের পরিবর্তে ফলের বাগান সৃষ্টি করেছিলো যা সেখানকার অধিবাসীরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ইত্যাদি।
এরপর তিনি মৌলানা আবদুল হাইয়ের তাঁর আটটি খণ্ডের কাজটির বিস্তৃত জ্ঞানার্জনের এবং প্রগঠিত পরিশ্রমের কথা স্মরণ করেন যাতে তিনি ৪৫০০ জন মুসলমান যারা ভারতে ইসলামের পক্ষে কাজ করেছেন, তাঁদের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন।
তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে কীভাবে এই বইগুলি শেষ করার মধ্য দিয়ে মৌলানা অস্পষ্ট বিষয়গুলিকে সুস্পষ্ট করেছিলেন। তাঁর এই পরিশ্রম প্রবাদপ্রতিম মৌমাছির মত যারা বিভিন্ন প্রকার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে। তিনি মৌলানার পাণ্ডিত্যের বিস্তৃত বিবরণ বর্ণনা করেছেন। মৌলানা কীভাবে বিরল তথ্য একক হাতে সংগ্রহ করেছিলেন এবং সেগুলি সম্পাদিত করেছিলেন সেই কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বর্তমান বইয়ের কাঠামো বর্ণনা করেন। তিনি স্মরণ করেন যে এটি কীভাবে দীর্ঘকাল অবহেলিত থাকে, এমনকি পোকায় কাটা পাণ্ডুলিপিটি ১৯৩৩ সালে আজমগড় থেকে পুনঃলিখিত হয় এবং তা প্রোভিডেন্সের অনুগ্রহে ধ্বংস ও অস্পষ্টতা থেকে রক্ষা পায়।
তিনি লিখেছেন যে বইটি ইসলামিক বিধি-বিধানের সেই বৈশিষ্ট্যগুলিকে সাহসীভাবে ব্যাপ্ত করেছে যেগুলি পশ্চিমী ও ভারতীয় ঐতিহাসিকদের দ্বারা অন্যায় এবং অসত্য ভাবে ব্যক্ত হয়েছিলো; এমনকি অনেক মুসলিম ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতেরা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ও এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে অবহেলা ও প্রশংসার অভাবের মধ্য দিয়ে ব্রাত্য করে রেখেছে।
মৌলানা আবদুল হাইকে কীভাবে একটি বিষয়ে কয়েক হাজার পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করতে হয়েছিল তা স্মরণ করে আলী মিঞা লিখেছেন যে কেবল তিনিই এই প্রচেষ্টাটির প্রশংসা করতে পারেন যিনি নিজে এই বিষয়ে কাজ করেছেন। তিনি তাঁর পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে: এই বইয়ের এক-একটি অধ্যায়ে যে সারাংশ পাবেন তা আপনি অনেকগুলি বই পড়েও পাবেন না। এটি সম্ভব হয়েছিল কারণ লেখক এই পরিশ্রম করেছিলেন ঈশ্বর লাভের আনন্দের জন্য, শেখার জন্য এবং নিজের আত্মার পরিপূর্ণতার জন্য। এই লেখার জন্য লেখক কোন পুরস্কার বা কোনো করতালি আশা করেননি। কাজই ছিল তাঁর সম্পূর্ণ তৃপ্তি। এভাবেই তিনি তাঁর সমগ্র জীবন একটি বিষয়ের উপর উৎসর্গ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তিনি উপসংহারে বলেন, এই ঐতিহাসিক স্বাক্ষ্যটি উপস্থাপন করতে পেরে তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট। এবং তিনি আশা করেন যে দেশবাসী এবং আল্লাহ্ এই সেবার কাজটি গ্রহণ করবেন এবং পণ্ডিতেরাও এটি শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করবেন ও অনুমোদন করবেন।
ব্যাখ্যা
এইরকম লেখকের বিশিষ্টতা এবং কাজের মহত্ত্ব সত্ত্বেও এই বইটি কেন মৌলবাদীদের মনোযোগের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠেনি?
উত্তরটি হিন্দুস্তান কী মসজিদেঁ, “হিন্দুস্তানের মসজিদসমূহ” অধ্যায়ে রয়েছে। সতেরো পৃষ্ঠায় বিষয়টি সহজভাবে লেখা আছে। প্রধান কয়েকটি মসজিদ সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য কয়েকটি বাক্যে বর্ণিত আছে। ঘটনাগুলি সুপরিচিত, এবং এগুলি এতটাই প্রাথমিক যে সেগুলিকে কয়েকটি বাক্যে উপস্থাপিত করলে তা কোন দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না। তবুও সেগুলিকে নিয়ে এতটা গোপনীয়তা রক্ষা করার চেষ্টা কেন? সাতটি মসজিদের বিবরণে আমরা সেই উত্তর পাবো।
মৌলানা আবদুল হাই লিখেছেন যে : ধর্মপ্রাণরা এতগুলি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, তাঁরা এতো বিপুল পরিমাণ শ্রম ও অর্থব্যয় করেছিলেন যা ঠিকমতো পরিমাপ করা সম্ভব ছিল না। প্রতিটি মসজিদ গ্রাম, শহরতলি এবং শহরের প্রধান সৌন্দর্যের কেন্দ্রস্থল হিসাবে জায়গা করে নিয়েছিল। তিনি লিখেছেন, সেই জন্য তাঁকে তাঁর বর্ণনা অল্প কয়েকটি মসজিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছে।
তিনি সাতটি মসজিদ সম্পর্কে যা বলেছেন তা এইরকম :
কওয়াত উল-ইসলাম মসজিদ:
আমার অনুসন্ধান অনুসারে দিল্লির প্রথম মসজিদটি হল কুব্বাত অল-ইসলাম বা কওয়াত-উল-ইসলাম মসজিদ। জানা যায় যে কুতুবুদ্দীন আইবক ৫৮৭ হিজরী সনে এটি নির্মাণ করেছিলেন রাজা পৃথ্বীরাজ নির্মিত একটি মন্দির ভেঙে, যাতে মন্দিরের (অর্থাৎ এই মসজিদের) কিছু অংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়। পরে ৫৯২ হিজরী সালে তিনি গজনী থেকে ফিরে আসার পর শিহাবুদ্দীন ঘোরীর আদেশে এটিকে একটি সুবিশাল অতুলনীয় লাল পাথরের মসজিদে রূপদান করা হয়। মন্দিরের কিছু অংশ মসজিদের মধ্যে সংযুক্ত হয়ে থেকে যায়। এর পর সামসুদ্দিন ইলতুৎমিস মসনদে আসীন হলে তিনি মসজিদের দুই পাশে সাদা পাথরের অট্টালিকা নির্মাণ করেন। এর এক পাশে তিনি পৃথিবীর উচ্চতম এবং সুন্দরতম স্তম্ভ নির্মাণের কাজ শুরু করেন।
জৌনপুরের মসজিদ:
এটি সুলতান ইব্রাহিম শরকি খোদিত পাথর দিয়ে তৈরি করেছিলেন। এটি একটি হিন্দু মন্দির ছিল, যেটিকে ভেঙে তিনি এই মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি আটালা মসজিদ নামে পরিচিত। সুলতান এখানেই তাঁর শুক্রবারের এবং ঈদের প্রার্থনা করতেন। কাজী শিহাবুদ্দীন এটিতে পড়াতেন।
কনৌজের মসজিদ:
এই মসজিদটি কনৌজের দুর্গের অভ্যন্তরে একটি উচ্চ ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে। এটি সুপরিচিতভাবেই একটি হিন্দু মন্দিরের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি একটি সুন্দর মসজিদ। তারা বলে যে এটি ইব্রাহিম শরকি কর্তৃক ৮০৯ হিজরী সনে নির্মিত হয়েছিল। এমনটাই ঘারাবাত নিগারে লিপিবদ্ধ আছে।
এটোয়ার জামিয়া মসজিদ:
এই মসজিদটি এটোয়ার যমুনার তীরে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল সেই জায়গায় একটি একটি হিন্দু মন্দির ছিল। এটি কানৌজের মসজিদের আদলে নকশাকৃত। সম্ভবতঃ এটি শরকি সুলতানদের অন্যতম স্মৃতিস্তম্ভ।
অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ:
এই মসজিদটি বাবরের দ্বারা অযোধ্যাতে নির্মিত হয়েছিল, যাকে হিন্দুরা রামচন্দ্রজির জন্মস্থান বলে। তাঁর স্ত্রী সীতা সম্পর্কে একটি বিখ্যাত গল্প রয়েছে। কথিত আছে যে সীতার এখানে একটি মন্দির ছিল যেখানে তিনি থাকতেন এবং স্বামীর জন্য খাবার রান্না করতেন। ঠিক একই জায়গায় বাবর ৯৬৩ হিজরী সনে এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।
আলমগীরের মসজিদ (আওরঙ্গজেব):
কথিত আছে যে বেনারস মসজিদটি বিশ্বেশ্বর মন্দিরের স্থানে আলমগীর তৈরি করেছিলেন। যে মন্দিরটি হিন্দুদের মধ্যে অত্যন্ত উঁচু এবং পবিত্র বলে স্বীকৃত ছিল। একই স্থানে একই পাথরগুলি দিয়ে তিনি এই সুউচ্চ মসজিদটি নির্মাণ করেন। মন্দিরের প্রাচীন পাথরগুলি পুনর্বিন্যাস করে মসজিদের দেওয়ালে স্থাপন করা হয়। এটি হিন্দুস্তানের বিখ্যাত মসজিদগুলির মধ্যে একটি।
বেনারসের দ্বিতীয় মসজিদ:
এটি আলমগীর গঙ্গার তীরে খোদিত পাথর দিয়ে তৈরি করেছিলেন। এটিও হিন্দুস্তানের একটি বিখ্যাত মসজিদ। এটির ২৮টি স্তম্ভ রয়েছে যার প্রতিটি ২৩৮ ফুট লম্বা। এটি গঙ্গার তীরে অবস্থিত এবং এর ভিত্তি জলের গভীর পর্যন্ত প্রসারিত। আলমগীর মথুরায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। কথিত আছে যে এই মসজিদটি গোবিন্দ দেবের মন্দিরর স্থানে নির্মিত হয়েছিল, যা ছিল অত্যন্ত মজবুত এবং পাশাপাশি অত্যন্ত সুন্দর ও মনোরম।
“এটা বলা হয়”
এইগুলি মৌলানা প্রমাণসাপেক্ষ রূপে উপস্থাপিত করেননি। তিনি কেবল যা বিশ্বাস করা হয় তা জানাচ্ছেন। তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন, “এটা বলা হয়”। হতে পারে যে এটা তাঁর লেখার একটি ভঙ্গিমা। উদাহরণস্বরূপ, তিনি যখন কুতুবউদ্দীন আইবকের কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ নির্মাণের বর্ণনা দেন তখনও তিনি এই “এটা বলা হয়” বাক্যাংশটি ব্যবহার করেন।
যদি ঘটনাগুলি সন্দেহাতীত না হত তবে এটা আশা করাটা যুক্তিসঙ্গত যে, আলি মিয়াঁর কঠিন পরিশ্রম ও অধ্যবসায় সেই বিষয়গুলিতে নিশ্চয়ই আলোকপাত করতো, বিশেষতঃ তিনি যেখানে কাজটির সম্পূর্ণতার এরকম ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বস্তুতঃ তিনি সেগুলি পুনঃপ্রকাশের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতেই পারতেন, যেখানে তিনি মূল বইয়ের একটি সুবিশাল অংশকে পুনপ্রকাশের থেকে বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদি পণ্ডিতরা মনে করতেন যে অনুচ্ছেদগুলি সহজেই নিষ্পত্তি করা যেতে পারে, তবে তাঁরাই বা কেন বইটি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন, যেখানে আলি মিয়াঁর মর্যাদার একজন পণ্ডিত ব্যক্তি এটির এমন সুপ্রশংস মূল্যায়ন করে গেছেন? কেন এটা করার দরকার হয়েছিল?
বেনারসের মসজিদের মত প্রতিটি মসজিদ যেগুলির নির্মাণের জন্য ওই স্থানের মন্দিরগুলি ধ্বংস করা হয়েছিলো সেই সংক্রান্ত তথ্যাবলী এই গ্রন্থের ইংরেজি সংস্করণ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সাতটি মসজিদের প্রতিটিরই এই সংক্রান্ত তথ্যগুলি ইংরেজি সংস্করণ থেকে হারিয়ে গেলো! এটা কি শুধুই কাকতালীয় ঘটনা?
প্রকৃতপক্ষে কেবল বাদ দেওয়াই নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে বাক্য প্রতিস্থাপনও হয়েছে। উর্দু খণ্ডে কনৌজ মসজিদ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে “এই মসজিদটি কনৌজের দুর্গের অভ্যন্তরে একটি উঁচু ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে। এটি সর্বজনবিদিত যে এটি এখানে হিন্দু মন্দিরের ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছিল।” ইংরেজী খণ্ডে আমাদের একই মসজিদ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে “এটি একটি উঁচু জায়গার ওপর তৈরী করা হয়েছে যা পুরানো এবং ক্ষয়ে যাওয়া দুর্গের একটি অংশ”।
অনুচ্ছেদগুলি যদি “এটি বলা হয়” উল্লেখ করে এত সহজে ব্যাখ্যা করা যেত, তবে কেন এই অনুচ্ছেদগুলি ইংরেজী সংস্করণ থেকে অপসারণের প্রয়োজন হত, এটি সেই সংস্করণ যা অন্য ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদের পড়ার সম্ভাবনা ছিল সব থেকে বেশি? কেন কেউ একজন বড় পণ্ডিতের বইকে এভাবে পরিবর্তন করবেন?
উপসংহার
তবে মন্দিরগুলি যে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের জায়গায় মসজিদগুলি নির্মিত হয়েছিল তা সর্বজনবিদিত হলেও সেটা সবথেকে বড় কথা নয়। এমনকি মন্দিরের ভাঙা পাথর ও মূর্তির অংশ মসজিদ তৈরীতে পুনর্ব্যবহৃত হয়েছিল সেটাও ততটা বড় কথা নয়। এটিকে আধিপত্য ঘোষণা করার উপায় হিসেবে মনে করা হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল যে এটিই ছিল বিজিতদের উপরে মানসিক আঘাত হানার উপায়, সেই সময়ে মন্দিরগুলি কেবল উপাসনার স্থান ছিল না; ছিল শিক্ষা ও সমাজ জীবনের পীঠস্থান।
সুতরাং বইটির লেখাগুলি কখনোই পৃথিবী কাঁপানোর মতো তাৎপর্যপূর্ণ নয়। তাদের আসল তাৎপর্য, এবং এটা আমি সাহস করে বলতে পারি, যে এগুলি ‘মসজিদ-মন্দির ব্যবসায়িক মিথ্যা’ ও সে সম্পর্কিত ছল-চাতুরী ও লুকোচুরির মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র ও নিরীহতম উদাহরণ। আমার কাছে এটি একেবারেই অজ্ঞাত নয় যে অনুচ্ছেদগুলি দীর্ঘকাল ধরে পরিচিত ছিল এবং যারা বাবরি মসজিদ ইস্যুতে অবগত তাদের কাছেও এগুলি অজ্ঞাত থাকাটা অসম্ভব। (সূত্র-১) তবে এটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাঁরা নিজেদের প্ররোচনাটি সম্পর্কে অবহিত, সত্যকে নিশ্চিত করার চেয়ে লুকিয়ে রাখা এবং কবর দেওয়াতেই তাঁদের স্বার্থসিদ্ধি।
আমার কোনো সন্দেহ নেই যে “বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি জট” সমস্যাটির একটি জাতীয় সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব যা সকলের ধর্মের অনুভূতি, প্রয়োজনীয়তা ও আবেগকে যথাযথ সম্মান করবে। তবে সমাধানটি যদি উভয় পক্ষের শক্তি প্রদর্শনের উপলক্ষে তৈরি করা হয় অথবা ‘কার কথা শেষ কথা হিসাবে প্রাধান্য পাবে’ সেটা ভেবে তৈরী করা হয় তবে, স্বাভাবিক ভাবেই তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
মৌলানা আবদুল হাইয়ের লেখাগুলির পরিণতি, এবং আমি জানি না যে উর্দু সংস্করণটি নিজেও মূল আরবি খণ্ডের ‘সুবিধামাফিক পরিবর্তিত’ সংস্করণ ছিল কি না, একটি জিনিসকে পরিষ্কারভাবে দেখায়; তা হলো, যারা ধর্মের আবেগকে হাতিয়ার করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করে তাদের কাজ করার পদ্ধতিটি কেন সবসময় ছদ্মবেশে ঢাকা থাকে। যারা এ জাতীয় ছদ্মবেশী স্বার্থে এগিয়ে যায় তারা আমাদের সকলের জন্যই ভয়ঙ্কর; তারা মুসলমানদের জন্য, হিন্দুদের জন্য, সকলের জন্য সর্বনাশ বপন করে।
যাঁরা এই ধরনের অপকর্ম দেখেও নীরব থাকেন, প্রক্রিয়াটি তাঁদেরও ধ্বংস ডেকে আনে। আমরা কি আমাদের আক্রমণ ও সত্যগোপনের মনোভাবকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হব? আমরা কি শেষ পর্যন্ত কথা বলতে এবং পুরো সত্যের মুখোমুখি হতে শিখব? কখনো কি দেখতে শিখবো কী করে এক দলের সাম্প্রদায়িকতা অন্য গোষ্ঠীর মধ্যেও আগুন ছড়ায়? কখনো কি বুঝতে পারবো যে এই “নেতারা” ধর্ম বা ধর্মস্থানের বিষয়ে আগ্রহী নয়, তাদের আগ্রহ শুধুই তাদের ব্যক্তিগত ক্ষমতায়? তাদের জন্য, ধর্ম কেবল একটি উপকরণ, একটি যন্ত্র যা এত আকর্ষণীয় কারণ এটির ঝাঁকুনির প্রভাব সবসময় অন্যের উপরই পড়ে, তাদের বা তাদের অনুসরণকারীদের উপর নয়?
আমরা কি তাদের কখনও থামাব না?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৮৯
পাদটীকা:
১
বেশ কয়েকজন আধুনিক মুসলিম ঐতিহাসিক এবং লিপিবিদরা এই সত্যকে মেনে নিয়েছেন যে, অযোধ্যার বাবরী মসজিদ সহ আরও অনেক মসজিদ হিন্দু মন্দিরগুলির স্থানে দাঁড়িয়ে আছে।