১) জন্মসূত্রে আপনার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সম্পর্ক পরিবারিক পরিচয় কী?
উত্তর— আমার জন্মই সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে, পিরোজপুর জেলার মাজিরপুর থানা এলাকার বালিয়াড়ি গ্রামে। পূর্বপুরুষরা ছিলেন জোতদার। তিন ভাই, দু বোন। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে। স্নাতকোত্তর করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু নিরন্তর নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের পাশে সক্রিয়ভাবে দাঁড়ানোর জন্য দেশ ছাড়তে হয়। ২০১৯-এর ১৬ জুলাই থেকে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা।
প্রশ্ন ২— পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের অবস্থা কোন সময়ে, কীভাবে আপনার মনে দাগ কেটেছিল?
উত্তর— আমার বোধ হওয়ার পর থেকেই। ধলেশ্বরী নদীর ধারে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ আমাদের গ্রাম ছিল হিন্দুপ্রধান। ১৯৭১ সালে আশপাশে কিছু অঞ্চলে হিন্দুদের বাড়িতে লুঠপাট হয়। এলাকায় আমাদের পরিবারের একটা প্রভাব ছিল। এক রাতে বেশ কিছু মুস্লিম এসে বাবাকে বাইরে আসতে বলেন। মা বেড়িয়ে এসে কারণ জানতে চান। ওরা বলে, “না। কাকার সঙ্গে কথা বলব।“ মা-ও নাছোড়। বলেন, “জগদীশের বাবাকে নয়, যা বলার আমাকেই বলো।” জগদীশ ছিল আমার দাদার নাম। তর্ক শুরু হয়। মা বলেন, “দরকার হলে আমি আগে কালী হয়ে তোমাদের বলি দেব।“ শেষ পর্যন্ত ওরা পিছু হটে। বলে যায়, “চারদিকের অবস্থা খারাপ! এই রাতেই চলে যান আপনারা।“ সব বাড়িতে বিষয়টা জানানো হল। দল বেঁধে আমরা পাড়া ছাড়তে বাধ্য হলাম। আমার তখন ছ’বছর বয়স।
প্রশ্ন ৩— কোন পরিস্থিতিতে দেশান্তরী হতে বাধ্য হলেন?
উত্তর— বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র সংগঠনের রোকেয়া হলের সমাজ সেবা সম্পাদক ছিলাম। বিএনপি আমলে প্রশাসনিক দায়িত্ব হিন্দুদের দেওয়া হত না। ১০ শতাংশ মহিলা সংরক্ষণও মানা হত না। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চূড়ান্ত পর্যায়ে চার বার মৌখিক পরীক্ষায় বাতিল হয়ে যাই। ১৯৯৩ থেকে প্রায় ৮ বছর ঢাকার একটি বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজে যুক্ত ছিলাম। তখন দেখেছি, কীভাবে গরিব হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে। ২০০১ সালে তৈরি করি ‘সেল্ফ হেল্প অ্যাসোসিয়েশন ফর রুরাল পিপল থ্রু এডুকেশন অ্যান্ড এন্ট্রিপ্রিনিওর’, সংক্ষেপে শারি। মূলত দলিত হিন্দু জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতাম। ’৯৮-এ প্রান্তিক পেশাজীবীদের ওপর আমার একটা কাজ বিশেষ স্বীকৃতি পায়। বিরোধিতা সত্বেও নিষ্ঠা সহকারে কাজ করতে থাকি।
ছবি: হিন্দুদের সম্পত্তি লুট, অগ্নিসংযোগের বিরাম নেই।
আমি বাংলাদেশের মহিলা ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক-সহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ১৬ জন মন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন। রাষ্ট্রদ্রোহের ১০টি মামলা রয়েছে আমার বিরুদ্ধে। ’১৯-এ যখন দেশ ছাড়ি ঢাকায় আমার প্রতিষ্ঠানে ১০৩ জন সর্বক্ষণের কর্মী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেশান্তরী হতে হয় আমাকে। আমার স্বামী, ভাইবোনরা আছেন বাংলাদেশেই।
প্রশ্ন ৪— কেন সাবেক পূর্ববঙ্গ এবং পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা এভাবে কমে গেল?
উত্তর— প্রথমত খোলাখুলি হিন্দু নির্যাতন। আমাদের পারিবারিকভাবে ৩০০ একরের ওপর জমি ছিল। ওখানে চাষাবাদের ফসল জোর করে নিয়ে যায়। ১০০টা চিংড়ির ঘেড়ি আছে। সব মাছ নিয়ে যায়।
তারা প্রধানমন্ত্রীর ভাই এমপি শেখ হেলালের নাম করে। আমি তাঁর কাছে ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছি। পুলিশের কাছে, প্রাণীসম্পদ মন্ত্রীর কাছে গিয়েছি। কোথাও সুবিচার পাইনি।
আমার বাড়ি মার্চ ৩, ২০১৯ সালে রাতের বেলায় পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ২০০৪ সাল থেকে আমাদের এলাকার সকল সম্পত্তি ৭ দলীয় সন্ত্রাসী দল মুজিবুর রহমান শামীমের নেতৃত্বে জামাত ইসলামের লোক দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর লোকজনদের নিয়ে দখল করে খায় এবং বিএনপি আওয়ামী লীগ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনও আমলেই আমাদের সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার কোনও চেষ্টা করা হয়নি। বর্তমানে মুজিবুর রহমান শামীম এমপি শেখ হেলালের নাম ব্যবহার করে। এসবের জন্য কোনও বিচার আমরা আজও পাইনি।
ছবি: এখনও পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হচ্ছে হিন্দুদের বাড়ি।
এভাবেই সর্বত্র নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। কেবল আমাদের ওই অঞ্চলে ২০০৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৪০টা পরিবারের মধ্যে ২৭টা পরিবার পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছে। ওঁদের অনেকেই খুব সংগ্রামের মধ্যে বাঁচার চেষ্টা করছে।
এই অবস্থার আর একটা একটা উত্তর, আমরা ওখানকার হিন্দুরা নিজেদের বাঁচাতে পারিনি। শিক্ষা, প্রতিষ্ঠা, মর্যাদা— সব ছিল। ছিল না, প্রকৃত ঐক্য, হিংসার মোকাবিলা করার মত সংগঠন। পালটা দিতে হবে। চারপাশের সামাজিক জীবনে দেখুন! প্রয়োজনে একজন পিএইচডি-কে সক্রিয়ভাবে পাশে পাবেন না। কিন্তু তথাকথিত দুষ্টু ছেলেরাই রাস্তায় নামে।
প্রশ্ন ৫— কিন্তু গোপাল পাঁঠাদের কি বারবার পাওয়া যায়?
উত্তর— গোপাল পাঁঠা ঘরে ঘরে আছে। তাঁদের মধ্যে চেতনা জাগাতে হবে। এ ব্যাপারে প্রচারমাধ্যমের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। একটা উদাহরণ দিই। ২০০৪ সালে ‘ইউএস এড‘-এর প্রতিনিধিদলের সঙ্গে গুজরাটে গিয়েছিলাম স্বায়ত্বশাসনের কাঠামো দেখতে। সে সময়ে জানলাম, ওখানকার লোকেরা অধিকাংশই বাংলাদেশের কথা কিছু জানেন না। পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে সেটা খবর হয়। কিন্তু পাকিস্তানে হিন্দু নির্যাতনের কথা জানেন না। বিষয়গুলো নিয়ে যথেষ্ঠ চর্চা, লেখালেখি না হলে মানুষ জানবে কী করে? তাদের মধ্যে চেতনাই বা জাগবে কী করে?
ছবি: গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় (গোপাল পাঁঠা)।
প্রশ্ন ৫— প্রতিবেশী ভারত কতটা সক্রিয়তা দেখিয়েছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে?
উত্তর— মোটেই সেভাবে দেখায়নি। ১৯৭১-এ ৩০ লক্ষ হিন্দু খুন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। ৪ লক্ষ ৬২ হাজার মা-বোনের ইজ্জত গিয়েছে। ১০ লক্ষ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু কোন রাজ্যের ক’টি পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে ঝড় উঠেছিল বলুন? পূর্ববঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে নির্যাতিতরা বা নিরাপত্তার আশায় হিন্দুরা যেখানে যেখানে গিয়েছেন, সেগুলোয় বামপন্থীদের প্রভাব ছিল। কিন্তু প্রতিটি রাজনৈতিক দলই শরনার্থীদের সস্তার শ্রমিক ও ভোটে তুরূপের তাস হিসাবে ব্যবহার করেছে। কেউ ওই অসহায়দের বুকে টেনে নেয়নি। পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে মানবাধিকারের প্রশ্নটা। দেশ ভাগ পর্যন্ত আমি এবং অনেকে সংখ্যাগুরু ছিলাম। রাতারাতি সংখ্যালঘু হয়ে গেলাম।
প্রশ্ন ৬— বাংলাদেশে হিন্দু জনশতাংশ হ্রাস ও ভারতে এই শতাংশ বৃদ্ধির হারের মধ্যে তো সমতা নেই। তাহলে বাংলাদেশে হিন্দু জনশতাংশ এত বেশি কমার কারণ কী?
উত্তর— হ্যাঁ। পূর্ববঙ্গে ১৯৬১-র আদমসুমারী আর বাংলাদেশে ’৭৪-এর সমীক্ষায় হিন্দু জনশতাংশ ছিল যথাক্রমে ১৮.৫ ও ১৩.৫। স্বাধীনতা যুদ্ধে হত্যা করা হয় ২৭ লক্ষ হিন্দুকে। ১৯৬১ থেকে ’৭০-এ ভারতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া উদ্বাস্তুর সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ। যে হারে বাংলাদেশে মুস্লিম বেড়েছে, সেই হারে হিন্দু বাড়লে ওই সময়ে আরও ৩৮ লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশে থাকার কথা ছিল। ভারতে আশ্রয় অবশ্যই একটা কারণ। কিন্তু পরোক্ষ কারণের মাত্রাটাও যথেষ্ঠ গভীর।
ছবি: নোয়াখালি দাঙ্গার পর দেশ ছাড়ছে হিন্দুরা।
১) নোয়াখালির হত্যাকাণ্ডের পর প্রচুর পরিমাণে হিন্দু নারীকে জোর করে ধরে নিয়ে হাটে বিক্রি করা হয়েছিল। তাঁদের গর্ভে জাত বাচ্চারা মুস্লিম গোষ্ঠীতে যুক্ত হয়েছে।
২) স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবার পরিকল্পনার কাজে কেবল হিন্দু মেয়েদের স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে নেওয়া হয়েছিল। যে কোনও মুস্লিম প্রধান অঞ্চলে তাঁদের যাওয়া ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু লাইগেশনের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দেওয়া হয়। ওই স্বেচ্ছাসেবীরা তখন হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে তাঁদের পরিচিতদের মাধ্যমে সম্মত নারীদের চিহ্ণিত করেছে। এভাবে রাশ টানা হয়েছে হিন্দু জনসংখ্যায়, যা হয়নি মুস্লিম জনসংখ্যার ক্ষেত্রে।
৩) মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের যে সব হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তাদের ৮০ শতাংশকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সংখ্যাটা প্রায় এক থেকে দেড় লাখ হবে। ওরা বিভিন্ন (বিশেষ করে লবন হ্রদ) শরনার্থী শিবিরে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পাঁচ বছরের কম এবং ৫০ বছরের বেশি বয়সীরা প্রায় কেউই ফেরেনি। অন্তঃসত্বাদের গর্ভের শিশুরাও বাঁচেনি। ১৯৭১-এ রিফিউজি ক্যাম্পে শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী ও কলেরা মহামারীর কারনে লক্ষাধিক লোক মারা যায়। এভাবে একটা বড় ধাক্কা আসে হিন্দু জনসংখ্যায়।
৪) স্থায়ী সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়া, চরম অনটন, অসুস্থতা ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মত নানা কারণে বাংলাদেশে হিন্দুদের অনিশ্চয়তার মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। সন্তান ধারণে অনেকের মধ্যে দেখা যায় অনীহা।
দীর্ঘ তিন দশকের ওপর নারী-শিশু, জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর গভীর মনোনিবেশ করেছি। তার ভিত্তিতে এই কথাগুলো বললাম। এটাও বলা প্রয়োজন, ভারতেও বরাবর জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রচার ও প্রকল্পগুলোর অভিমুখ হিন্দুরা। মুস্লিমদের এতে শরিক করা হয়নি বা করা যায়নি।
প্রশ্ন ৭—বিজেপি সরকার কেন্দ্রে আসার পরেও কেন বাংলাদেশের হিন্দুরা যথেষ্ঠ মনোবল পেলেন না?
উত্তর— একটা সমস্যা হল আন্তর্জাতিক বিধি মেনে ভারতে রিফিউজিদের স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা, বাংলাদেশি, আফগান, ওদিকে তামিল সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। এ ব্যাপারে স্পষ্ট কেন্দ্রীয় আইন নেই। বিশেষ পরিস্থিতিতে সাময়িক ব্যবস্থা হতে পারে মাত্র।
ছবি: হিন্দুদের ওপর বিরামহীন সন্ত্রাস।
প্রশ্ন ৮— আপনার কি মনে হয় ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হলে এই অবস্থার উন্নতি হতে পারে?
উত্তর— আগে তো তাই ছিল। সিমলা চুক্তি এবং সংশ্লিষ্ট নথিগুলো পড়ে দেখুন। ভারত কাদের জন্য কেন তৈরি হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ঘোষণা করেন। আবার ভারত চাইলে সংবিধানের মাধ্যমে আগের অবস্থানে ফিরে যেতেই পারে। এটা ভারতের ব্যাপার। আমি পরামর্শদাতা নই। মানবাধিকার কর্মীমাত্র। সীমাবদ্ধ অধিকারের মধ্যে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি।