পাকিস্তান ভারতের বিবাদ নতুন কোনো বিষয় না। তবে দু’দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো না হলেও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ইদানিং শান্তি বজায় রেখেছে দু’ দেশ। কিন্তু তার মধ্যে এমন একটি বিষয় সামনে উঠে এসেছে যাতে ফের-দু’দেশের সম্পর্ক বিগড়ে যেতে পারে। পাকিস্তান সরকার অনুমোদিত অষ্টম, নবম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ের বেশ কিছু ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। যে বইয়ের লাইনে লাইনে ছড়িয়ে রয়েছে ভারত এবং ভারতীয় হিন্দুদের প্রতি ঘৃণ্য ভাষার প্রয়োগ এবং অপপ্রচার। এমনকি জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে একরকম খলনায়ক তৈরি করা হয়েছে এই বইতে।
ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত সেই পাঠ্য বইয়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বলে তোপ দাগা হয়েছে। একটি জায়গায় লেখা রয়েছে অনেক ভারতীয় ভারতের জাতীয়তাবাদের দাবিতে হাত মিলিয়েছিল, যারা ধর্মে খাঁটি হিন্দু। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সারা ভারতের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠার বদলে জাতীয় কংগ্রেসও মূলত একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধে বইয়ের পাতায় শুধুই বিদ্বেষ ছড়ানো রয়েছে। জাতির পিতাকে সেখানে শুধুই একজন হিন্দু নেতা গান্ধী এবং তার তরুণ সমর্থকরা কংগ্রেসের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুসলমানদের অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা ঘৃণা ঈর্ষা ও সংকীর্ণ মানসিকতা তৈরি করে, এমনটাই দাবি করা হয়েছে পাক পাঠ্য বইতে।
ভারতীয় মুসলিমরা নাকি কোনো ভাবেই হিন্দুদের বিশ্বাস করতে পারেননি। সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের কাছে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণে অক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে বঙ্গভঙ্গের প্রসঙ্গ তুলে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, বঙ্গভঙ্গের পর শেষমেষ মুসলমানদের উপলব্ধি হয় যে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কাছ থেকে কোনো ন্যায়-নীতিপূর্ণ আচরণ আশা করতে পারে না। তাই নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য মুসলিম নেতারা তাদের সাম্প্রদায়ের জন্য একটি পৃথক নির্বাচক মন্ডলী তৈরীর পরিকল্পনা করেন। এর থেকে মুসলমানরা একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখেছিল যে তারা হিন্দু ও ব্রিটিশদের বিশ্বাস করতে পারে না।
বইতে বলা হয়েছে খিলাফত আন্দোলন ভারতের মুসলমানদের জন্য জাতীয়তাবাদের ধারণা নিয়ে এসেছিল। কংগ্রেস নিজেদের একটি জাতীয়তাবাদী দল বলে দাবি করলেও দেশ ভাগের প্রশ্নে তারা শুধুই একটি সাম্প্রদায়িক হিন্দু সংগঠনের মত আচরণ করেছে। বইয়ের সর্বত্রই বিষয়টির উপর জোর দেওয়া হয়েছে যে ভারতের মুসলমানরা সবসময় একটি মুসলিম জাতি হিসেবে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে ভারতীয় মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল তাদের কথা উল্লেখ করা হয়নি বইতে। এমনকি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের অংশগ্রহণকে বারবার মুসলিম জাতীয়তাবাদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বইতে।
বইটির একটি অধ্যায়ের শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে মুসলিম জাতীয়তাবাদের সমর্থনে উল্লেখিত সমস্ত নেতাদের ভূমিকা আলোচনা করতে বলা হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে কিভাবে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের হাতে নির্যাতিত হয়েছিল। নবম শ্রেণির পাঠ্য বইতে গর্ভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া ১৯৩৫ অ্যাক্টের অধীনে প্রাদেশিক বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কংগ্রেস শাসনকালকে কুশাসন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কংগ্রেসের কুশাসক ছিল। ওই সময় পুরোটাই রাজনৈতিক দুর্নীতিতে ভরে গিয়েছিল এবং সরকারের বদলে দলের শাসন চলতো। কংগ্রেস সরকার বিদ্যামন্দির এবং গান্ধীজীর ওয়াধারের মত প্রকল্প নিয়ে এসেছিল যা মুসলিমদের কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্য ছিল না।
সরকার উর্দু ভাষার বদলে হিন্দি ভাষা চালু করার চেষ্টা করে এবং বন্দেমাতরমকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রবর্তনের চেষ্টা করে। মুসলিম বিরোধী পটভূমিকায় রচিত এই গান মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উস্কে দিয়েছিল। কংগ্রেস শাসন শেষ হবার পর মুসলিমরা নাকি স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল এমনটাই দাবি করা হয়েছে বইতে। এমনকি দেশভাগের পরেও পাকিস্তানে প্রশাসনিক সমস্যা, উদ্বাস্তুদের থাকা খাওয়ার সমস্যা অভিবাসনের জন্য দায়ী করা হয়েছে ভারত সরকারকে।