বাড়িতে থাকে ১৫ থেকে ২০টি কুকুর ও বিড়াল। রোজ খেতে আসে রাস্তার অন্তত ৫০টি কুকুর আর ৩০ থেকে ৪০টি বিড়াল। ওদের ছেড়ে তিনি আরামে থাকবেন আর ওরা কষ্ট পাবে? খেতে পাবে না? ওদের কী হবে? বৌবাজারের ভগ্নপ্রায় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে টানা এমন প্রশ্ন করে গেলেন ৬/১এ, রামকানাই অধিকারী লেনের বাসিন্দা মালা পাত্র। তাঁর দাবি, পোষ্যদের একটা ব্যবস্থা না হলে তিনি এই বাড়ি ছেড়ে নড়বেনই না। জানালেন, ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস’ রাখেন। তাই তাঁর কিছু হবে না।
মঙ্গলবার সকালে ৬/১এ, রামকানাই অধিকারী লেনের বাড়িটির একটি ঘরের ছাদের বড় অংশ ভেঙে পড়েছে। অভিযোগ, পাশে বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে। তার অভিঘাতেই ইংরেজ আমলে তৈরি বাড়ির ছাদের একাংশ ভেঙে পড়েছে। কাউন্সিলরের তরফে সুরক্ষার খাতিরে বাসিন্দাদের অন্য জায়গায় সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু মালা নাছোড়। তিনি বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। তাঁর কথায়, ‘‘আমার অংশই ভেঙে পড়েছে। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে যাব কী করে? বাড়ি ভর্তি অবোলারা রয়েছে।’’ ঘরের ছাদের অংশ যখন ভেঙে পড়ে, তখন ভয়ে বাড়ি থেকে কিছু পোষ্য বেরিয়ে যায়। কিছু বাড়িতেই রয়েছে। এ দিক-ও দিক লুকিয়ে পড়েছে। তার পর থেকে তাদের আর দেখতে পাননি, উদ্বেগ মালার। তিনি বলেন, ‘‘কেউ খাটের তলায়, কেউ ছাদের উপরে, কেউ শৌচালয়ে লুকিয়ে রয়েছে। এদের ছেড়ে কী করে যাব? আমি আরাম করে থাকব আর ওরা কষ্ট পাবে?’’
মালা জানিয়েছেন, প্রতি দিন ১৮ কেজি চালের ভাত রান্না করেন তিনি। অতিমারিকালে লকডাউনের সময় গোটা এলাকার চারপেয়েদের খাওয়ানোর দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর কাঁধে। সেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন লালবাজারের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার (এসি) পদমর্যাদার এক আধিকারিক। রোজ ৪০ কেজি চালের ভাত রেঁধে খাওয়াতেন বিড়াল-কুকুরদের। রান্নার জন্য জায়গা দিয়েছিলেন কাউন্সিলর। তবে তিনি এ সবের জন্য কখনও প্রচার চাননি। মালার কথায়, ‘‘আমার প্রচারের দরকার নেই। আমি অবোলাদের জন্য করি, মনে করি আসল ভগবানের সেবা করছি।’’
মঙ্গলবার সকালে যখন ঘরের একাংশ ভেঙে পড়ে, তখন সাত লিটারের প্রেশার কুকারে ভাত চাপিয়েছিলেন মালা। তার পরেই সকলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। পোষ্যেরা এ দিক-ও দিক ছুটে পালিয়েছে। লুকিয়ে রয়েছে। বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। তাদের খেতে দিতে পারেননি মালা। তাই তিনি ঘরে ফিরতে মরিয়া। ফিরে পোষ্যদের খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তাঁর কথায়, ‘‘পোষ্যদের ব্যবস্থা না হলে কোথাও যেতে পারব না। গিয়ে আগে খাবার তৈরি করব। যে ভাবে হোক করবই।’’
এই কাজটা বিয়ের দু’বছর পর থেকেই করে চলেছেন মালা। জানালেন, ৪৮ বছর আগে বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে এসেছিলেন। প্রথম দু’বছর ‘নতুন বৌ’ লজ্জায় বাড়ি থেকে বেরোতে পারেননি। লজ্জা কাটতেই পোষ্য করেছিলেন দুই সারমেয়— ডুংরি এবং ঘিনুয়াকে। সেই সংসার বেড়ে এখন সদস্যসংখ্যা প্রায় একশো। প্রতিবেশীরাও সকলেই জানেন তাঁর পোষ্য-প্রীতির কথা। বয়স বাড়ছে মালার। এখন চারপেয়েদের দেখভালে সাহায্য করেন ছোট ছেলে সৌগত পাত্র। তিনিও স্পষ্টই বললেন, ‘‘পুরপ্রতিনিধি বলেছেন, অন্য কোথাও শিফ্ট করার জন্য। আমরা যাব না। গেলে ওদের কে খেতে দেবে? রান্না হবে কোথায়?’’ মালার বিশ্বাস, ঈশ্বর ঠিক দেখবেন তাঁকে। কিছু হতে দেবেন না। কারণ রোজ ঈশ্বরেরই সেবা করেন তিনি।