মৃত্যুকে সাক্ষাৎ দেখেছেন চার বার, হুইলচেয়ারে বসা ঘাটালের অপূর্ব এখন জলে নামেন দেশের স্বপ্ন হয়ে

তখন কোনও স্বপ্নই ছিল না ছেলেটির চোখে। পরিবারের লোকেদের চিকিৎসক বলেই দিয়েছিলেন, হাতে বেশি সময় নেই। ভগবানকে ডাকার পাশাপাশি, ছেলে যা যা ভালবাসে, সে সব খাওয়ানোর কথাও বলেছিলেন। দিয়েছিলেন, শেষ দিনগুলো সুখে কাটানোর পরামর্শও। যাঁর সম্পর্কে এই সব পরামর্শ, সেই অপূর্ব সামন্তও তখন নিজের মৃত্যুই চেয়েছেন।

কিন্তু এখন ঘাটালের সেই যুবক অপূর্ব স্বপ্ন দেখান অনেককে। হুইলচেয়ারে বসেই দেশকে সম্মানিত করার স্বপ্ন দেখেন। এ বার প্রথম বিদেশেও যাচ্ছেন স্বপ্ন সফল করতে। আগামী সোমবার থেকে তাইল্যান্ডে শুরু হওয়া ‘ড্রাগন বোট বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ’-এ ভারতীয় প্যারাদলের প্রতিনিধি অপূর্ব বললেন, ‘‘আপাতত আমার একটাই স্বপ্ন। দেশের হয়ে পদক জয়।’’

 তাইল্যান্ড যাওয়ার আগে সতীর্থদের সঙ্গে ইকো পার্কে অনুশীলন অপূর্বের।

পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল শহর থেকে অনেকটাই দূরে দাসপুরের দুবরাজপুর গ্রামে বাড়ি অপূর্বের। লেখাপড়া করা হয়নি খুব বেশি। সেই ছোটবেলায় নিখোঁজ হয়ে যান বাবা। সেটা এত কম বয়সে যে, বাবার কথা কিছুই মনে পড়ে না বছর তিরিশের অপূর্বের। এক মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে মা সংসার চালাতেন মূলত জনমজুর খেটে। একশো দিনের কাজই প্রধান ভরসা। লেখাপড়া ছেড়ে অপূর্ব তাই গয়নার কাজ শেখেন। কিছুটা শেখার পরে কাজও জুটে যায়। কিন্তু বাড়ি থেকে অনেক দূরে, অন্য দেশে। নেপালবাসী হয়ে যান অপূর্ব।

চলছিল ভালই। কিন্তু কাল হল এক বার লম্বা ছুটি নিয়ে কাঠমান্ডু থেকে ঘাটালে ফেরার পরে। ২০১৭ সালে মারাত্মক বাইক দুর্ঘটনা। বাইকের হ্যান্ডেলটা ভেঙে ঢুকে গিয়েছিল কোমরে। প্রথম বার সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরলেন। কিন্তু মেরুদণ্ডের আঘাত শয্যাশায়ী করে দেয়। দিনের পর দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে ‘বেড সোর’ হয়ে যায়। এক সময়ে পিঠে ‘সংক্রমণ’ হয়ে যায়। তখনই জবাব দিয়ে দেন স্থানীয় চিকিৎসকেরা। চোখের জল আড়াল করতে ছেলের ঘরেই ঢুকতেন না অপূর্বের মা। আর অপূর্ব কোনও রকমে বাইরের দিকে চেয়ে থাকতেন এক ফালি জানলা দিয়ে।

Apurba Samanta

জানলা নয়, অপূর্ব প্রথম বার আলো দেখতে পেয়েছিলেন ফেসবুকে। তার শরীরের অবস্থার কথা জেনে ফেসবুকেরই এক বন্ধু জানান, চিকিৎসা আছে। সঠিক জায়গায় গেলে চিকিৎসা করানো যায়। একটু একটু করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন অপূর্ব। তাইল্যান্ড রওনা হওয়ার আগে কলকাতায় বসে অপূর্ব যখন আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন অবশ্য তাঁর চোখেমুখে অনেক স্বপ্ন। তিনি বললেন, ‘‘জানেন, আমি আরও দু’বার মৃত্যুকে দেখেছি। বিছানা ছেড়ে উঠতে খুব কষ্ট হত, তবু এক বার মায়ের শাড়ি দিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলে পড়েছিলাম। এক বার হাতের শিরা কেটে ফেলেছিলাম। কিন্তু আজ আমি এই জায়গায় আসব বলেই হয়তো কেউ না কেউ আমায় ঠিক বাঁচিয়ে দিয়েছেন।’’ জানালেন, টাকাপয়সাও ছিল না। তবু বন্ধু ও প্রতিবেশীদের সাহায্যে চিকিৎসা হয়েছে ওড়িশার একটি হাসপাতালে।

ওড়িশার ওই হাসপাতাল অপূর্বের কাছে শুধু চিকিৎসাকেন্দ্রই নয়, একটা মস্ত বড় জানলা। তিনি বললেন, ‘‘ওখানে গিয়ে দেখলাম আমি একা নই, আমার মতো অনেকে রয়েছেন। তাঁরা সুস্থও হয়ে উঠছেন। মনোবল ফিরে পেলাম। আস্তে আস্তে আমিও এক দিন হুইলচেয়ারে বসলাম। তার পরে সেই চেয়ারটা চলতে শুরু করল। এখন গোটা দেশে ঘোরে আমার এই চেয়ারের চাকা। এ বার চাকা ঘুরতে ঘুরতে বিদেশ চলল।’’

অপূর্বের চাকরিটাও হুইলচেয়ারের সঙ্গে জড়িয়ে। শিলিগুড়ির একটি হাসপাতালে তিনি ‘হুইলচেয়ার ট্রেনার’ হিসাবে কাজ করেন। এ জন্যও তাঁকে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। সেটা নিয়েছেন চণ্ডীগড়ের একটি সংস্থা থেকে। ওই প্রশিক্ষণ তাঁকে দিয়েছে নতুন জীবন। শুরু হয়ে যায় ‘হুইলচেয়ার গেম’-এ অংশ নেওয়া। আগে হুইলচেয়ার ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন। বাস্কেটবল, ভলিবলও খেলেছেন। কিন্তু এখন ড্রাগন বোটই তাঁর মূল খেলা।

ড্রাগন বোট খেলা এখনও ভারতে তেমন জনপ্রিয় না-হলেও দিন দিন তা বাড়ছে বলে দাবি করলেন অপূর্ব। তিনি জানালেন, সম্প্রতি জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা হয় বিহারে। সেখানে বাংলার প্যারা দল চ্যাম্পিয়নও হয়। এ বার ভারতীয় প্যারা দলে অপূর্ব-সহ রয়েছেন পাঁচ জন। তবে তিনিই একা হুইলচেয়ারে বসা প্রতিনিধি। কলকাতায় এক বার একটি প্যারা ম্যারাথনে যোগ দিতে এসেছিলেন অপূর্ব। সেই সময়ে আলাপ হয় কলকাতার নিউরো রিহ্যাব চিকিৎসক সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পরে অপূর্বের প্রশিক্ষণ থেকে এই বিদেশযাত্রায় পাশে রয়েছেন সুপর্ণ। তিনি বলেন, ‘‘অপূর্বের খেলাধুলোর চেয়েও বড় যে কাজটি ও মূল করে। হুইলচেয়ারে বসে হুইলচেয়ার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ খুবই বড় একটা কাজ। ও শেখায়, হুইলচেয়ারে বসেও কী ভাবে ব্যালান্স রেখে খেলাধুলো করা যায়, কী ভাবে সব কাজ স্বনির্ভরতার সঙ্গে করা যায়।’’

আর অপূর্ব নিজের কাজকে এখন ‘ব্রত’ মনে করেন। বিদেশযাত্রার আগে রাজারহাটের ইকো পার্কে অনুশীলনের ফাঁকে তিনি বলেন, ‘‘আমি হুইলচেয়ারে বসে হুইলচেয়ারের প্রশিক্ষণ দিই। এটা বাড়তি প্রেরণা জোগায়। আমায় দেখে শিক্ষানবিশেরা বুঝতে পারে, সবই ‘সম্ভব’। আমায় তাই আরও সফল হতে হবে। সেটাও বাকিদের প্রেরণা দেবে।’’

কাজ, খেলার অনুশীলন, প্রতিযোগিতা এ সবের মধ্যেও ‘মাই লাইফ অপূর্ব’ নামের একটা ইউটিউব চ্যানেল চালান অপূর্ব। সেটিরও লক্ষ্য ‘লড়াই’ শেখানো। অপূর্ব বলেন, ‘‘আমি সব কিছু দিয়েই আসলে বোঝাতে চাই একটা কথা— সম্ভব। মরে যেতে বসেছিলাম। এক দিন নিজেই মরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মরিনি। আমার মতো এমন অনেকে অন্ধকার ঘরে বসে রয়েছেন। তাঁদের সবাইকে বোঝাতে চাই, হুইলচেয়ারে বসেও স্বপ্ন সফল হয়। স্বপ্নটা শুধু দেখতে হবে। আমাকে অন্যেরা স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আমিও সবাইকে দেখাতে চাই।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.