হরিদেবপুরকাণ্ড: ক্যামেরায় বন্দি ঘনিষ্ঠতাই কি ডেকে এনেছিল বিপদ? তদন্তে কী জানতে পারল পুলিশ?

বিশেষ মুহূর্তের স্মৃতি ধরে রাখা হচ্ছে! এমন আশ্বাস দিয়ে তোলা ঘনিষ্ঠ ছবি বা ভিডিয়ো হাতিয়ার করে শুরু হচ্ছে ব্ল্যাকমেল, চলছে টাকা হাতানো থেকে ধর্ষণ! কখনও আবার তুলে রাখা হচ্ছে ধর্ষণের ভিডিয়ো। পরে সেই ভিডিয়োর জোরেই চলছে যেমন খুশি কাজ করানো। অশ্লীল ছবির বাজারে চড়া দামে সে সব বিক্রিও করা হচ্ছে যখন-তখন। অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রেই পুলিশ-প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও সুরাহা মিলছে না। তাই অনেকেই বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ।

গত মঙ্গলবার হরিদেবপুরে এক মহিলার আত্মহত্যার ঘটনায় সামনে এসেছে এমনই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিয়ো তুলে তা ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকির অভিযোগ। যাঁর সঙ্গে মহিলার সম্পর্ক ছিল, তাঁর বাড়ির দরজার বাইরেই গায়ে আগুন দিয়ে আত্মঘাতী হন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, গায়ে আগুন দেওয়ার আগে মহিলা বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিয়ে বার বার খোলার অনুরোধ করেন। আগুন দিয়েও দরজায় ধাক্কা দিতে থাকেন। কিন্তু ভিতর থেকে বলা হয়, ‘‘দরজা খোলা যাবে না।’’ মহিলার স্বামী ২০১৭ সালে মারা যান। তাঁর এক ছেলে রয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিও স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন না। এই ঘটনায় কেন ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছিল এবং কেনই বা সেগুলি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল, পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে।

সাইবার শাখার কর্তারা জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরে এমন ভিডিয়ো তোলার প্রবণতা বেড়েছে। অভিযোগও আসছে বিস্তর। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘একে বলে ‘রেপ ইন্ডাস্ট্রি’। সম্পর্ক তৈরি করে ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত ক্যামেরায় তুলে রাখা, অশ্লীল ছবির বিশ্ব বাজারে চড়া দামে সে সব বিক্রি করা। বাধা এলে ব্ল্যাকমেল করে ধর্ষণ করো, এর পরে সেই মুহূর্তও ক্যামেরাবন্দি করো।’’ ভাইরাল ভিডিয়োয় ধর্ষণকারীদের চেনা গেলেও পরোয়া নেই কারও। লাইক, কমেন্ট, ভিউয়ের বন্যা বয়ে যায়!

আইনজীবী থেকে মনোরোগ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এমন ভিডিয়ো তুলে রাখার পিছনে আরও কিছু কারণ থাকে। যেমন, বন্ধুবান্ধবদের তা দেখিয়ে কৃতিত্ব জাহির করা: ‘দেখো, আমি কেমন পুরুষ। একটি মেয়েকে কী ভাবে দখল ও ভোগ করলাম।’ আবার ওই ভিডিয়ো হাতে থাকলে মেয়েটিকে বা তাঁর পরিবারকে ব্ল্যাকমেল করা যায়। পুলিশে যাওয়া থেকে নিরস্ত করা যায়। যখন খুশি ডেকে ধর্ষণও করা যায়। রেকর্ড করা যায় সেই দৃশ্য। মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব বললেন, ‘‘বহু ক্ষেত্রেই বিষয়টি বিকৃত কামের অংশ হিসাবে সামনে আসে।’’ আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আত্মহত্যার মতো পথ বাছার আগে আইনি বহু দিক যে খোলা আছে, এটা বোঝা দরকার।’’ আইনজীবী ও সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায় জানান, এমন ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার ধারায় যেমন মামলা হতে পারে, তেমনই তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারায় আপত্তিজনক ছবি ও ৬৭এ ধারায় যৌনতায় ভরা ছবি ছড়ানোর মামলা হতে পারে। ছবি ছড়ানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০৬ (অপরাধমূলক হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন) ধারাতেও মামলা হতে পারে।

কিন্তু এমন ভিডিয়ো যখন বহু লোকের নাগালেই থাকে, ধর্ষকদের দেখাও যায়, তখন পুলিশের সাইবার সেল বা অন্য তদন্তকারী সংস্থা কেন নিজে থেকে তদন্ত করে না? কেন আলাদা টাস্ক ফোর্স তৈরি করা হয় না? এমন পরিকাঠামো নেই কেন, যেখানে এমন অপরাধ সম্পর্কে যে কোনও নাগরিক সহজে অভিযোগ জানাতে পারবেন? লালবাজারের কর্তারা শুধু বলছেন, ‘‘বিষয়গুলি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হবে।’’ রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় যদিও স্পষ্ট বললেন, ‘‘কড়া হাতে এগুলো দেখা উচিত। বলতে সমস্যা নেই, বহু ক্ষেত্রেই সাইবার আইন পর্যাপ্ত ভাবে কার্যকর হচ্ছে না। তাই এমন সব ঘটনা কমছে না।’’ তা হলে উপায়? প্রশাসনের কোনও স্তরের তরফেই স্পষ্ট উত্তর মিলছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.