হাসপাতালে বন্ড সই করে হাবিব খেলেছিলেন জীবনের সেরা ম্যাচ

বহু ম্যাচ জিতেছেন। জিতিয়েছেন। পেয়েছেন বহু পুরস্কার। সম্মান। তিনি মহম্মদ হাবিব। ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। স্বাধীনতা দিবসের সন্ধ্যায় হেরে গেলেন জীবনের ম্যাচে। যে হাবিব মাঠে নামলে লড়াই ছাড়া কিছু বুঝতেন না, শেষ হয়ে গেল তাঁর লড়াই।

ইডেন গার্ডেন্সে ম্যাচ শেষ হওয়ার পর মোহনবাগানের ১০ নম্বরকে খুঁজে ছিলেন পেলে। সেই ১০ নম্বর, যিনি ম্যাচ শুরুর আগে প্রতিপক্ষ পেলের সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি হননি। এক জুনিয়র সতীর্থকেও নাকি বাধা দিয়েছিলেন। সেই ১০ নম্বর হাবিবের যুক্তি ছিল, পেলে হোক আর যেই হোক প্রতিপক্ষের সঙ্গে ম্যাচের আগে হাত মেলানো যাবে না। সৌজন্য বিনিময় হবে ম্যাচের পর। অথচ তাঁর খেলায় মুগ্ধ পেলে নিজেই ম্যাচের পর আলাপ করতে চেয়েছিলেন।

এই জন্যই বোধ হয় ভারতীয় ফুটবলে বড়ে মিঞা হাবিব। কলকাতার তিন প্রধান— ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডানের হয়ে খেলেছেন। খেলেছেন বাংলা, ভারতের হয়ে। হায়দরাবাদ থেকে বাংলায় খেলতে এসে কলকাতা ময়দানে পরিচিত হয়েছিলেন নিজের দক্ষতায়।

গত শনিবার ১৬৫৭ দিন পর মোহনবাগানকে হারিয়েছে ইস্টবেঙ্গল। আর ১৯৭০ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত হাবিব ইস্টবেঙ্গলে খেলার সময় ১৯৩২ দিন সবুজ-মেরুন শিবিরের কাছে হারেনি লাল-হলুদ ব্রিগেড। লিগ-শিল্ড-ডুরান্ড-রোভার্স মিলিয়ে ওই পাঁচ বছরে ক্লাবকে দিয়েছিলেন ১৩টা ট্রফি। পাঁচটা ফাইনালে গোল তাঁর। দক্ষতায় হাবিবকে টক্কর দেওয়ার মতো ফুটবলার তখন কলকাতা ময়দানে ছিলেন কয়েক জন। কিন্তু তাঁর লড়াকু মনোভাব এবং ফুটবল বুদ্ধিকে সমীহ করতেন সকলে। নাছোড়বান্দা হাবিবকে এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়ালে রাখার কথা ভাবতে পারতেন না কেউ।

লড়াই, লড়াই, লড়াই। হাবিবের ফুটবলের এক মাত্র মন্ত্র ছিল। সবাইকে নিয়ে খেলতেন। খেলতে খেলতে জুনিয়র সতীর্থদের শেখাতেন। ছোটদের গোলের ঠিকানা লেখা বল সাজিয়ে দিতেন। জুনিয়রদের স্নেহ করতেন, আবার শাসনও। শৃঙ্খলার সঙ্গে কখনও সমঝোতা করতেন না। অনুশীলনে আলগা দেওয়া তাঁর ধাতে ছিল না। হাবিব বিশ্বাস করতেন, বাংলার ছেলেরা ভাল ফুটবল খেলবেই। প্রতি দিন সময়ের আগেই পৌঁছে যেতেন মাঠে। কোনও সতীর্থ অনুশীলনে আসতে দেরি করলে হালকা শাসন করতেন।

ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে হাবিব (ডানদিকে)

৫ ফুট ৫ ইঞ্চির চেহারা নিয়েই দাপুটে ফুটবল খেলতেন। প্রতিটি বলের জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করতেন। হারার আগে হারতেন না। সেই চেষ্টাই তাঁকে দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারে পরিণত করেছিল। যেমন ষাটের দশকের সন্তোষ ট্রফি সেমিফাইনাল। বাংলা বনাম পঞ্জাব। ইন্দর, গুরকৃপাল, মনজিত, ভাটিয়া, গুরদেব, কিষেন— সব সিংহের ঝাঁকে ঝাঁকে স-বুট লাথি নেমে এসেছিল হাবিবের ছোটখাটো শরীরের উপর। হাবিবও ছোড়নেওয়ালা ছিলেন না। বল নিয়ে বার বার বক্সে ঢুকে পড়েছেন। পঞ্জাবি ফুটবলারদের ট্যাকলের নামে সটান মারা লাথি খেয়ে মাঠে লুটিয়ে পড়েছেন। আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। কখনও সেন্টার লাইন পেরোলেই লাথি, চোরাগোপ্তা ঘুসি, কনুইয়ের বিপজ্জনক আক্রমণ হামলে পড়ছে হাবিবের পা, কোমর, ঘাড়, মুখে। তবু পুরো সময় খেলেছিলেন হাবিব। কিন্তু মাঠ থেকে বেরিয়েই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে সারা রাত স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল বেহুঁশ হাবিবকে। পরের দিন ছিল ড্র সেমিফাইনালের রিপ্লে। হাসপাতালে ভর্তি থাকা হাবিবকে বাদ দিয়ে বাংলা পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। কিন্তু ম্যাচের আগে আচমকা টিম হোটেলে হাজির হয়েছিলেন অকুতোভয় বড়ে মিঞা! তাঁকে দেখে চমকে গিয়েছিল গোটা দল। রিপ্লেতেও মাঠে নেমেছিলেন যোদ্ধা হাবিব। নিজেই স্যালাইন খুলে হাসপাতালের বন্ডে সই করে ট্যাক্সি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন দলের হোটেলে। মাঠে নেমে গোল করে বাংলাকে জিতিয়েছিলেন তিনি। পেয়েছিলেন ম্যাচের সেরার পুরস্কারও। এই ম্যাচকেই খেলোয়াড়জীবনের সেরা বলে মনে করতেন হাবিব।

এই হাবিবই এক বার মুখে মেখেছিলেন নিজের থুতু। ইস্টবেঙ্গল একটি ম্যাচ খারাপ খেলায় সমর্থক, দর্শকেরা তীব্র বিদ্রুপ করেছিলেন ইস্টবেঙ্গল ফুটবলারদের। খেলা শেষ হওয়ার পর মুখ থেকে হাতে থুতু নিয়ে সারা মুখে মেখেছিলেন হাবিব। তৎকালীন ক্লাব সচিব সুপ্রকাশ গড়গড়ি কারণ জানতে চাইলে হাবিব বলেছিলেন, আমরা যা খেলেছি তাতে থুতুই মাখা উচিত। সেই সুপ্রকাশও একই দিনে প্রয়াত হলেন।

ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন কর্তা জ্যোতিষ গুহ হাবিবকে প্রথম বড়ে মিঞা বলে ডেকেছিলেন। ১৯৬৬ সালে ইস্টবেঙ্গলে সই করার পর প্রথম ম্যাচেই মোহনবাগানের বিরুদ্ধে গোল করেছিলেন হাবিব। তার পরেই তাঁর এই নাম দিয়েছিলেন জ্যোতিষ গুহ। তাঁর হাত ধরেই ভাই আকবরকে নিয়ে কলকাতা ময়দানে পা রেখেছিলেন হাবিব। সেই সময় ফুটবলকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন হাবিব। কখনও চাকরি করেননি। তাই বার বার দল বদল করেছেন। লাল-হলুদ থেকে সবুজ-মেরুন। সেখান থেকে সাদা-কালো জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন। টাকা নিয়ে ফুটবল খেলার মধ্যে অন্যায় দেখতেন না। তবে শুধু টাকার অঙ্ক দেখে ক্লাব বাছতেন না। দলের শক্তি দেখে ক্লাব বাছতেন। হারতে পছন্দ করতেন না। কোনও ক্লাব প্রীতি ছিল না তাঁর। যখন যে জার্সি পরতেন , সেই জার্সির জন্য জান লড়িয়ে দিতেন। জার্সিকে মনে করতেন ‘মা’। ইস্টবেঙ্গলের টানা ছ’বার লিগ জেতার বছরে ক্লাব ছাড়ার যন্ত্রণা বয়ে বেড়িয়েছেন আজীবন। ১৯৭৫ সালে ইস্টবেঙ্গল ছাড়ার জন্য পরবর্তী সময়ে নিজেকে ধিক্কার দিতেন হাবিব।

কলকাতা ময়দানে একটি ম্যাচে হাবিব।

১৯৭০ সালে এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ জয়ী ভারতীয় দলের সদস্য ছিলেন হাবিব। ১৯৮০ সালে পেয়েছেন অর্জুন। রাজ্য সরকার ২০১৮ সালে বঙ্গবিভূষণ দিয়ে সম্মানিত করেছিল হাবিবকে। লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার দিয়েছে মহমেডান। ইস্টবেঙ্গল দিয়েছে ‘ভারত গৌরব’ পুরস্কার। এ সবের কোনও কিছুতেই মাপা যায় না ফুটবলার হাবিবকে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে আকবরের বিখ্যাত ১৭ সেকেন্ডের গোলের পিছনেও ছিল হাবিবের ক্ষুরধার ফুটবল মস্তিষ্ক। পাঁচ ভাইয়ের তৃতীয় হাবিব দুই দাদা আজম আর মইনের খেলা দেখে ফুটবলের প্রেমে পড়েছিলেন। পরে নিজের ফুটবলের প্রেমে ফেলেছিলেন গোটা দেশের ফুটবল জনতাকে।

তিনটে এশিয়ান গেমস খেলেছেন। সত্তরে ব্রোঞ্জজয়ী পিকের ভারতের প্রথম ম্যাচে তাইল্যান্ডের সঙ্গে ০-২ পিছিয়ে থাকা ম্যাচে হাবিবের কীর্তি ভোলার নয়। ২০ গজ দূর থেকে ভলিতে নিজে গোল করেছিলেন। ২-১। তার পর সুভাষ ভৌমিককে দিয়ে দ্বিতীয় গোল করান। অবিশ্বাস্য ভাবে ম্যাচ ২-২ ড্র। একাত্তরে পেস্তা সুকান চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের হয়ে ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে পর পর দু’ম্যাচে জোড়া গোল। উনসত্তরের সন্তোষ ফাইনালে সার্ভিসেসকে বাংলার হাফডজন গোলের মধ্যে হাবিবেরই পাঁচটা!

বিদেশি ক্লাব দেখলেও একই ভাবে জ্বলে উঠেছেন। পেলের কসমস। শিল্ডের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী বিদেশি টিম আরারাত। দুটো ম্যাচেই গোল রয়েছে হাবিবের। ডিসিএমে সাত জন নর্থ কোরিয়ান বিশ্বকাপার ভরা ডক রো গ্যাংয়ের সঙ্গে তো দুর্ধর্ষ কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন প্রায় একা। ফরোয়ার্ড আর হাফলাইনের মাঝে হাবিব সে ম্যাচে তুখড়। পর পর দু’দিন ফাইনাল গোলশূন্য ড্র রাখার পর বিদেশিরা ফিরে গিয়েছিলেন। ট্রফি ইস্টবেঙ্গলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা।

ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পরও ফুটবলের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন। আসলে ফুটবলই তাঁকে ছাড়তে চায়নি। কোচিং করিয়েছেন টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি, মহমেডানে। আইএফএ-র হলদিয়া অ্যাকাডেমির প্রধান কোচ হিসাবেও কাজ করেছেন। চেষ্টা করেছেন নিজের ফুটবল শিক্ষা পরের প্রজন্মকেও দিতে। সত্তরের দশকে ময়দানের শাহেনশা এক বার বলেছিলেন , ‘‘আমার ফুটবল দেখতে সাধারণ ছিল, কিন্তু রেজাল্টটা ছিল স্পেশ্যাল।’’ সেই বিশেষ অধ্যায়ের শেষ হল ভারতের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবসে। যে অধ্যায়ের শুরু ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.