কাদা আর বালির স্তূপে চাপা পড়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বাড়িগুলিতে কেউ আটকে নেই তো? সেই কাদা আর বালির স্তূপ ঘেঁটে ঘেঁটে প্রাণের খোঁজ চালাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা। সোমবারেও পাহাড়ের ঢালে ছিল সুদৃশ্য চুরালমালা, মুন্ডাক্কাই, অট্টামালা এবং নুলপুঝা গ্রাম। কিন্তু মঙ্গলবার সকাল থেকে সেই দৃশ্য একেবারে বদলে গিয়েছে। কোথায় সবুজ বনানী, কোথায় কফি বাগান, কোথায় পাহাড়ের কোলে সুদৃশ্য বাড়িগুলি! দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন একেবারে ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে। চার ঘণ্টায় চারটি ধস নেমে চারটি গ্রামকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
ওয়েনাড়ের যে অঞ্চলে ধস নেমেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মুন্ডাক্কাই এবং চুরালমালা। ছোট একটা সাজানো গোছানো গ্রাম। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এই চুরালমালা। প্রতি বছর বহু পর্যটক এখানে দৃষ্টিনন্দন জলপ্রপাতের আকর্ষণে ছুটে আসেন। সূচিপাড়া জলপ্রপাত ছাড়াও রয়েছে ভেলোলিপাড়া এবং সীতা হ্রদ। আর এই হ্রদ এবং পাহাড়ের কোলেই গড়ে উঠেছে গ্রামটি। ওখানে যে কোনও বসতি অঞ্চল ছিল, মঙ্গলবার থেকে তা বোঝাই যেন দায় হয়ে উঠেছে।
ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সোমবার রাত থেকে। কালপেট্টায়। ওয়েনাড় জেলার উপরিভাগে এই এলাকায় রাতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ২০০ মিলমিটার বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টিতে ধস নামে চুরালমালায়। তার পর সেই ধস নেমে আসে কয়েক কিলোমিটার দূরের গ্রাম মুন্ডাক্কাইয়ে। হড়পা বানের সঙ্গে ‘গোটা পাহাড়টাই’ যেন নীচের দিকে নেমে এসেছিল।
সোমবার গভীর রাত। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল কালপেট্টা, চুরালমালা, মুন্ডাক্কাই-সহ ওড়েনাড়ের বেশ কিছু জায়গায়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন পাহাড়ি গ্রামগুলিতে সেই মধ্যরাত থেকে ভোরের মধ্যে পর পর আছড়ে পড়ল প্রকৃতির রোষ। প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল চুরালমালায়। পুরো গ্রামকে ধসিয়ে, বালি-কাদার স্তূপের সঙ্গে হড়পা বান চালিয়ার নদী ধরে নীচের গ্রামগুলির দিকে দুরন্ত গতিতে নামছিল। একের পর এক ক্ষেত, বসতি নিশ্চিহ্ন করে এগিয়ে চলছিল। সেই ধস আছড়ে পড়ে মুন্ডাক্কাইয়ে। তার পর আছড়ে পড়েছিল অট্টামালা এবং নুলপুঝা গ্রামে।
চারটি গ্রাম মিলিয়ে ২২ হাজার লোকের বাস। মঙ্গলবারের ধসের পর থেকে কালপেট্টা থেকে নুলপুঝা পর্যন্ত ওয়েনাড়ের ভৌগোলিক চিত্রটাই বদলে গিয়েছে। ওয়েনাড়ের মানচিত্র থেকে প্রায় মুছে গিয়েছে মুন্ডাক্কাই। কত মানুষ নিখোঁজ তার ইয়ত্তা নেই। যাঁরা বেঁচে গিয়েছেন, তাঁরা এখন সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ইট, কাঠ বালি, কাদা সরিয়ে স্বজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মুন্ডাক্কাইয়ের এক বাসিন্দা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “ওয়েনাড়ের মানচিত্র থেকে মুছে গিয়েছে আমাদের গ্রাম। কিছু বেঁচে নেই। চার দিকে শুধু বালি, কাদা আর পাথরের স্তূপ। কোথায় খুঁজব আমার ছেলেটাকে? কোথায় যে হারিয়ে গেল ও। ৫০০টি বাড়ি ছিল গ্রামে। সব শেষ।”
চুরালমালা গ্রামের বাসন্দা আলিকোয়া। বেঁচে গিয়েছেন ধসের কবল থেকে। কিন্তু তাঁর পরিবারের সদস্যরা কোথায় হন্যে হয়ে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এক সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, “চুরালমালা গ্রামে যে কোনও ধস নামতে পারে তা কল্পনাতেও আসছে না। এই এলাকা ধসপ্রবণ নয়। কিন্তু কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল!” অট্টামালা, নুলাপুঝা গ্রামও পর্যটকদের বেশ পরিচিত। কিন্তু চুরামালা, মুন্ডাক্কাইয়ের মতোই এই দু’টি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। চারটি গ্রামে এখন শুধু প্রকৃতির ধ্বংসলীলা বিরাজমান। উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, সেনা। যাঁরা বেঁচে গিয়েছেন তাঁরাও ধ্বংসস্তূপের নীচে প্রাণ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। পরিস্থিতি এমনই যে চার গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারে স্বজন হারিয়ে কান্নার মতো লোকও নেই।
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এই চার গ্রামে মূলত চা এবং কফি শ্রমিকরাই থাকতেন। গভীর রাতে ধস নামায় কেউ পালানোর বা নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার সুযোগটুকুও পাননি। ফলে কাদা, বালি আর পাথরের নীচেই চাপা পড়ে গিয়েছেন। এখন ওই গ্রাম থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে মৃতদেহ উদ্ধার হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত এই ধসের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১৫১ জনের। দুশোরও বেশি মানুষ নিখোঁজ।