৪৫৪ দিন। দীর্ঘ বিরতির পর ফিরলেন প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে ফিরলেন ঋষভ পন্থ। মাঠে ফিরল তাঁর তাগিদ। ফিরল ক্রিকেটকে আঁকড়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জেদ। ফিরল ভয়াবহ পথ দুর্ঘটনার আতঙ্ককে হারিয়ে দেওয়া আত্মবিশ্বাস। অধিনায়ক ফিরে পেল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের দিল্লি ক্যাপিটালস। আসলে ভারতীয় ক্রিকেটে ফিরল স্বস্তি।
২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বরের কথা এখনও ভুলতে পারেনি ভারতের ক্রিকেটমহল। মনে রাখেননি শুধু এক জন। সেই দিনের কথা মনে রাখতে চান না পন্থ। পিছনে নয়, তাঁর চোখ ভবিষ্যতের দিকে। যে ভবিষ্যতের শুরুতেই রয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ভারতীয় দলে পন্থের সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত নয়। আইপিএলে তাঁর পারফরম্যান্স দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন জাতীয় নির্বাচকেরা। সে পরের কথা। ক্রিকেটপ্রেমীরা পন্থকে স্বাগত জানালেন মন খুলে। পঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে দিল্লির দ্বিতীয় উইকেট পড়ার পর ব্যাট করতে নামলেন পন্থ। উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানালেন মোহালির নতুন মহারাজা যাদবিন্দ্র সিংহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের দর্শকেরা।
পন্থ তা হলে সত্যিই মাঠে ফিরলেন। এটুকু শান্তির মধ্যেও জড়িয়ে ছিল উৎকণ্ঠা। পন্থ কি পারবেন আগের মতো খেলতে? পায়ে কোনও সমস্যা নেই তো? দিল্লির ইনিংসের নবম ওভারের তৃতীয় বল প্রথম খেললেন পন্থ। হরপ্রীত ব্রারের বল হাঁটু মুড়ে কাট করলেন। পয়েন্টের ফিল্ডার ধরতে না পারলেই চার। তা হয়নি। তবে ক্রিকেটমহলের স্বস্তির পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেল। স্বচ্ছন্দে হাঁটু মুড়লেন পন্থ। অর্থাৎ কোনও সমস্যা নেই। বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো এক জন মনে করিয়ে দিলেন, দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়েছিল পন্থের ডান পায়ের হাঁটু। হরপ্রীতকে কাট মারার সময় বাঁ হাঁটু বেশি ভাঁজ করতে হয়েছে পন্থকে! দ্বিতীয় বল ডিপ কভারে ঠেললেন পন্থ। ২ রান হতে পারত। ১ রান নিয়েই থামলেন দিল্লির অধিনায়ক। প্রথম রান নেওয়ার পর তাঁর মুখে হাসি দেখা গেল। পন্থকে চোখের সামনে খেলতে দেখেও যেন সংশয়মুক্ত হতে পারছিলেন না ক্রিকেটপ্রেমীরা। ১ রান করে নিয়ে নিজের ইনিংস এগোচ্ছিলেন পন্থ!
আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে অভ্যস্ত পন্থ তা হলে ১০০ শতাংশ ফিট নন? না কি এত দিন পর মাঠে ফিরে চাপে রয়েছেন? ক্রিকেটপ্রেমীদের একাংশ যখন প্রশ্নমালা সাজাতে শুরু করেছেন, ঠিক তখনই জবাব দিল পন্থের ব্যাট। রাহুল চাহারের একটু খাটো লেংথের বল পন্থ পুল করলেন ডিপ মিড উইকেটে। হর্ষল পটেলের ‘অলস’ প্রচেষ্টা কাজে আসেনি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পন্থের ৪০০তম চার সংশয়ী ভক্তদের আশ্বস্ত করল।
শনিবার পন্থের ১৩ বলে ১৮ রানের ইনিংস সাজানো ২টি চার দিয়ে। সংখ্যার নিরিখে এই ইনিংস ঋষভীয়। আবার হর্ষলের বলে আলগা শট খেলে আউট হওয়াতেও সেই পুরনো পন্থ! উইকেট ছুড়ে দেওয়ার জন্য অতীতে বহুবার সমালোচিত হতে হয়েছে তাঁকে। সব যখন ঠিকঠাক, তখনই দর্শকদের আশঙ্কা হঠাৎ বৃদ্ধি করলেন সৌরভেরা। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে দিল্লি নামিয়ে দিল বাংলার উইকেটরক্ষক-ব্যাটার অভিষেক পোড়েলকে। তা হলে কি উইকেটের পিছনে দস্তানা হাতে দাঁড়াবেন না পন্থ? জল্পনা মতো শুধু ব্যাটার হিসাবে আইপিএল খেলবেন পন্থ? সেই জল্পনার অবসান ঘটল পঞ্জাবের ইনিংস শুরুর আগেই। প্যাড-গ্লাভল পরে মাঠে নেমে পড়লেন পন্থ। আর কোনও সংশয় থাকল না ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে। পন্থ ফিট। উইকেটের পিছনেও স্বচ্ছন্দ দেখিয়েছে। আঁচ লাগেনি তাঁর রিফ্লেক্সেও। জীতেশ শর্মাকে স্টাম্পকে আউট করার মধ্যেই তা স্পষ্ট। পন্থের মাঠে ফেরা উদযাপন করল গুগলও!
মাঝের এক বছরের সময়টা ছিল অস্থিরতার, অনিশ্চয়তার। পন্থের। রাহুল দ্রাবিড়ের। রোহিত শর্মার। জয় শাহদের। অজিত আগরকরদের। ক্রিকেটপ্রেমীদেরও। এই সময় শ্রীকর ভরত, ঈশান কিশন, জীতেশ শর্মা, ধ্রুব জুড়েলদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে এক এক করে। লোকেশ রাহুলকে দিয়ে বিশ্বকাপ-সহ বেশ কিছু ম্যাচে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। আসলে পন্থের অনুপস্থিতির জন্য পরীক্ষার রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন নির্বাচকেরা। আর নজর ছিল পন্থের দিকে। আস্থা ছিল বিসিসিআইয়ের মেডিক্যাল স্টাফদের উপর।
দুর্ঘটনায় পন্থের ডান হাঁটুর প্রতিটি লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে সময় তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো বাঁচবেন না। সুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসক এবং বিসিসিআইকে পন্থ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন দ্বিতীয় জীবন দেওয়ার জন্য। মনের জোরে বিদায় জানিয়েছেন সঙ্গী হয়ে যাওয়া হুইলচেয়ার, ক্রাচকে। মাটিতে পা ফেলেছেন যন্ত্রণা উপেক্ষা করে। এক পা এক পা করে হাঁটার চেষ্টা করেছেন। জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন ধাপে ধাপে চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে। অনিশ্চিত ক্রিকেট ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করেছেন। চিকিৎসকদের কৃতিত্ব অস্বীকার করার জায়গা নেই। কৃতিত্ব কম নয় ২৬ বছরের তরুণেরও। মনে করা হয়েছিল তাঁর মাঠে ফিরতে অন্তত ১৮ মাস সময় লাগবে। পন্থের একাগ্রতা সেই সময় তিন মাস কমিয়ে দিয়েছে।
এক পা করে এগোচ্ছেন পন্থ। সঙ্গে হয়তো আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের আশাও। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ‘উত্তরসূরি’ যত এগোবেন, ততই হয়তো আড়ালে চলে যাবেন মাহির ‘ঘরের ছেলে’। ব্যর্থতার হতাশায় যাঁরা ক্রিকেটকে দূরে সরিয়ে দেন, তাঁদের জন্য আগামীর পাঠক্রম হতে পারে পন্থের ৪৫৪ দিন।