ভারত-পাক সংঘাতে গত কয়েক দিনে প্রাণ হারিয়েছেন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পাঁচ বীর। রবিবার সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠকে এমনটাই জানালেন ভারতের সামরিক বাহিনীর ডিজিএমও স্তরের আধিকারিকেরা। ডিজিএমও লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই জানিয়েছেন, ‘অপারেশন সিঁদুরে’ ভারত পাকিস্তানের ৯টি জঙ্গিঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানোর পরেই পাল্টা হামলা চালায় পাকিস্তানও। এমনকি, আনুষ্ঠানিক ভাবে সংঘর্ষবিরতি ঘোষণার পরেও গোলাগুলি থামেনি। তাতেই প্রাণ গিয়েছে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পাঁচ সদস্যের।

সুরেন্দ্রকুমার মোগা, ভারতীয় বায়ুসেনার চিকিৎসক
শনিবার সকালে জম্মু-কাশ্মীরের উধমপুরে পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে মৃত্যু হয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনার চিকিৎসক সুরেন্দ্রকুমার মোগার। রাজস্থানের ঝুনঝনুর বাসিন্দা সুরেন্দ্র গত ১৪ বছর ধরে বায়ুসেনায় চিকিৎসাকর্মী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। উধমপুরে বায়ুসেনার ৩৯ উইং-এর সদস্য ছিলেন তিনি। সেনার তরফে শনিবার রাতে তাঁর মৃত্যুর খবর জানানো হয়। রবিবার দুপুরে সুরেন্দ্রর দেহ ঝুনঝুনুর বাড়িতে পৌঁছোয়। কফিনবন্দি দেহ আঁকড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন পরিজনেরা। সুরেন্দ্রর স্ত্রী এবং দুই সন্তান রয়েছে। তাদের এক জনের বয়স এগারো, অন্য জনের আট।

এম মুরলী নায়েক, ভারতীয় সেনার জওয়ান
জওয়ান এম মুরলী নায়েক। গত ৮ তারিখ নিয়ন্ত্রণরেখায় পাকিস্তানের ছোড়া গোলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। অন্ধ্রপ্রদেশের সত্যসাই জেলার বাসিন্দা মুরলী ২০১৮ সালে সেনার ৮৫১ লাইট রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন। মুরলীর বাবা এবং মা মুম্বইয়ে দিনমজুরের কাজ করতেন। সেনায় মুরলী চাকরি পাওয়ার পর সেই কাজ ছেড়ে গ্রামে ফেরেন তাঁর বাবা-মা। গত বুধবার রাতেও বাড়িতে ফোন করেছিলেন মুরলী। জানিয়েছিলেন, নিয়ন্ত্রণরেখায় প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে। তার পরেই বৃহস্পতিবার গভীর রাতে মুরলীর আহত হওয়ার খবর বাড়িতে পৌঁছোয়। ভোরের আলো ফুটতেই জানা যায়, ছেলে আর নেই!
মুরলীর বাবা শ্রীরাম নায়েকের কথায়, ‘‘ছোটবেলা থেকে সেনায় যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখত ছেলে। সেনার পোশাক ছিল ওর খুব প্রিয়। সবসময় বলত দেশের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করব।’’ এ হেন ছেলের মৃত্যুতে দিশাহারা হয়ে পড়েছে গোটা পরিবার।

মহম্মদ ইমতিয়াজ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী
শনিবার ভারত-পাক সীমান্ত-লাগোয়া আরএস পুরা সেক্টরে পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে প্রাণ গিয়েছে বিএসএফ জওয়ান মহম্মদ ইমতিয়াজের। ইমতিয়াজ বিএসএফের সাব-ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত ছিলেন। শনিবার সকালে জম্মুর আরএস পুরা সেক্টরে পাক হামলায় ইমতিয়াজ-সহ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আট জন জওয়ান গুরুতর জখম হন। তড়িঘড়ি তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই মৃত্যু হয় ইমতিয়াজের। এর পরেই সহযোদ্ধার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে বিবৃতি দেয় বিএসএফ। বিএসএফের উচ্চপদস্থ এক কর্তা বলেন, ‘‘ইমতিয়াজ আন্তর্জাতিক সীমান্তে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় সাহসিকতার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন। জাতির সেবায় বিএসএফের এই সাহসী সাব-ইন্সপেক্টরের আত্মত্যাগকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই।’’

ল্যান্সনায়েক দীনেশকুমার শর্মা, ভারতীয় সেনা
গত ৭ মে জম্মু-কাশ্মীরের পুঞ্চে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে নিহত হন ল্যান্সনায়েক দীনেশ শর্মা। দীনেশ পুঞ্চে সেনার এফডি রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। নিয়ন্ত্রণরেখায় পাকিস্তান টানা সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন করায় সেখানে মোতায়েন করা হয়েছিল ৫ এফডি রেজিমেন্টের জওয়ানদের। সেই দলে ছিলেন দীনেশও। কিন্তু বুধবার পাকিস্তানের ছোড়া গোলায় তিনি জখম হন। হাসপাতালে চিকিৎসা চলাকালীন মৃত্যু হয় তাঁর।
দীনেশরা পাঁচ ভাই। ভাইদের মধ্যে দীনেশই বড় ছিলেন। তাঁর আরও দুই ভাই সেনায় কর্মরত। এক তুতো ভাইও সেনার মেডিক্যাল বিভাগে কাজ করেন। সেই তুতো ভাই জানিয়েছেন, দীনেশের দুই সন্তান রয়েছে, দর্শন (৫) ও কাব্যা (৫)। তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা।

রাইফেলম্যান সুনীল কুমার, ভারতীয় সেনা
জম্মুর আরএস পুরা সেক্টরে পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে নিহত হয়েছেন রাইফেলম্যান সুনীল কুমার। সুনীল জম্মুর ত্রেওয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। ১১ মে তাঁর দেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। যথোচিত সম্মানের সঙ্গে সারা হয় শেষকৃত্য।
সাংবাদিক বৈঠকে ডিজিএমও ঘাই আরও জানিয়েছেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ পাকিস্তানের ৯টি জঙ্গিঘাঁটিতে হামলায় ইউসূফ আজ়হার, আব্দুল মালিক রাউফ, মুদস্সর আহমেদ-সহ ১০০-রও বেশি জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে। তার পর থেকে পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পাঁচ সদস্য ছাড়াও প্রাণ গিয়েছে সাধারণ মানুষেরও। গত ৭-১০ মে’র মধ্যে ভারতীয় সেনার জবাবি হামলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরও প্রায় ৩৫-৪০ জন জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে।