পশ্চিম বর্ধমানের পানাগড়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছে হুগলির চন্দননগরের এক তরুণীর। প্রাথমিক ভাবে অভিযোগ উঠেছিল, জাতীয় সড়কের কাছে ‘ইভটিজ়ার’দের দৌরাত্ম্যেই গাড়ি উল্টে তরুণীর প্রাণ গিয়েছে। সোমবার দিনভর এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে চাপানউতরের পর সন্ধ্যায় আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট জানিয়ে দিল, পানাগড়কাণ্ডে ‘ইভটিজ়িং’ হয়নি। তরুণীর গাড়িটি ধাওয়া করা হয়েছিল বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা-ও ‘অসত্য’। বরং, তরুণীর গাড়িই অন্য গাড়িটিকে ধাওয়া করেছিল বলে দাবি করল পুলিশ।
মৃতা সুতন্দ্রা চট্টোপাধ্যায় (২৬) চন্দননগরের বাসিন্দা। তিনি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই কাজেই রবিবার রাতে বিহারের গয়ায় যাচ্ছিলেন। অভিযোগ উঠেছিল, মধ্যরাতে পানাগড়ের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় জাতীয় সড়কের পাশে কাঁকসা থানা এলাকার একটি রাস্তায় কয়েক জন মত্ত যুবক গাড়ি নিয়ে তরুণীর গাড়ির পিছু নেন। তরুণীর গাড়িতে বার বার ধাক্কা দেন তাঁরা। ‘ইভটিজ়ার’দের হাত থেকে বাঁচতেই দ্রুত গতিতে চালাতে গিয়ে উল্টে যায় তরুণীর গাড়ি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সুতন্দ্রার। তাঁর দেহ আসানসোল জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল ময়নাতদন্তের জন্য। তরুণীর নীল রঙের গাড়ি এবং অভিযুক্তদের সাদা গাড়িটি আটক করেছে পুলিশ। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে তরুণীর গাড়িতে থাকা তাঁর দুই সহকর্মীকেও।
এমন অভিযোগ ওঠার পর থেকেই জাতীয় সড়কে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। প্রশ্ন উঠেছিল, ঘটনার পর ১৮ ঘণ্টা পার হলেও কেন অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা গেল না? এ নিয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন মৃতার মা তনুশ্রী চট্টোপাধ্যায়। পুলিশ অভিযুক্তদের আড়াল করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। মেয়ের মৃত্যুর খবর পাওয়া মাত্রই চন্দননগর থেকে আসানসোলে পৌঁছন। কাঁকসা থানায় অভিযোগও দায়ের করেন। এর পরেই সোমবার সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করে আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট। তদন্তে কী কী পাওয়া গিয়েছে, তা জানান পুলিশ কমিশনার সুনাল চৌধরি।
তদন্তে নেমে ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থলের আশপাশের কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। তার ভিত্তিতে সিপির বক্তব্য, সাদা গাড়িটি তরুণীর নীল গাড়িটিকে ধাওয়া করেনি। উল্টে তরুণীর গাড়িটিই ওই গাড়িটিকে ধাওয়া করছিল। সিসিটিভি ফুটেজে তেমনটাই দেখা গিয়েছে। সাংবাদিক বৈঠকে সেই ফুটেজ প্রকাশ্যেও আনা হয় পুলিশের তরফে। একটি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, তরুণীর নীল গাড়িটি একটি পেট্রল পাম্পে দাঁড়িয়েছিল রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ। আর একটি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, তরুণীর নীল গাড়িটি সাদা গাড়িটির পিছনে ছিল। গতিও বেশি ছিল তরুণীর গাড়ির।
পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘‘জাতীয় সড়কের পাশের একটি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তরুণীর গাড়িটিই সাদা গাড়িটিকে ওভারটেক করার চেষ্টা করছিল। সেই সময় সাদা গাড়িটি রাস্তার পাশের একটি গলিতে ঢুকে যায়। তরুণীর গাড়িটিও ওই গলিতে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু ওদের গাড়িটি ঢুকতে পারেনি। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেটি উল্টে যায়। তার ফলেই ওই তরুণীর মৃত্যু। পানাগড়ের ঘটনায় ইভটিজ়িংয়েরও ঘটনা ঘটেনি।’’
অন্য দিকে, তরুণীর সঙ্গে থাকা তাঁর এক সহকর্মী সোমবার সকালে দাবি করেছিলেন, বুদবুদ থানায় এলাকায় একটি পেট্রল পাম্পে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের গা়ড়িটি। তেল ভরার পর তাঁরা কাঁকসার দিকে যাওয়ার সময়েই কয়েক জন যুবক গাড়ি নিয়ে তাঁদের পিছু নেন। পিছন দিক থেকে বার বার তাঁদের গাড়িতে ধাক্কা দিতে থাকেন। যার জেরেই তরুণীর গাড়িটি উল্টে গিয়েছিল।
মিন্টু মণ্ডল নামে ওই ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘‘পেট্রল পাম্প থেকে বেরোনোর পরেই ওদের (মত্ত যুবকদের) গাড়িটা আমাদের গাড়িতে এসে ধাক্কা দেয় প্রথমে। এর পর ডান দিক দিয়ে আমাদের গাড়িটাকে চাপতে থাকে ওরা। আমাদের গাড়িটা ডিভাইডারে প্রায় উঠেই গিয়েছিল। এর পর পাশ কাটিয়ে চলে যায় ওরা। ওই গাড়িতে পাঁচটা ছেলে ছিল। যাওয়ার সময় ম্যাডামের দিকে হাত নেড়ে অশ্লীল ইঙ্গিতও করছিল ওরা। গাড়িতে ম্যাডাম রয়েছে। আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’’ মিন্টুর আরও দাবি ছিল, পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার কিছু ক্ষণ পরেই আবার তাঁদের গাড়ির কাছাকাছি চলে আসে যুবকদের গাড়ি। আবার তারা তরুণীর গাড়িতে ধাক্কা দেয়। যুবকদের হাত থেকে বাঁচতেই অন্য একটি রাস্তা ধরেন মিন্টুরা। ওই রাস্তাতেও পিছু ধাওয়া করে ধাক্কা দিয়ে তাঁদের গাড়িটি উল্টে দেওয়া হয় বলে দাবি করেছেন মিন্টু।
গোটা ঘটনায় এখনও কেউ গ্রেফতার হননি। পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে মৃতার সহকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন তাঁরা। পাশাপাশি, সাদা গাড়িতে কত জন ছিলেন, তাঁদের পরিচয় কী, সে সব খোঁজ করে দেখা হচ্ছে বলেই খবর পুলিশ সূত্রে।
সাদা গাড়িতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের গ্রেফতার না করে কেন মেয়ের সহকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মৃতার মা। ময়নাতদন্তের পর মেয়ের দেহ চন্দননগরে নিয়ে যাওয়ার আগে কাঁকসা থানায় গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। মেয়ের সঙ্গে গাড়িতে যারা ছিল, তারা আহত হল। তাদেরই সকাল থেকে আটকে রাখা হয়েছে! ও দিকে অপরাধীরা এখনও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে!’’ থানার সামনে মেয়ের দেহ রেখে ক্ষোভ উগরে দেন তনুশ্রী। পুলিশ আশ্বাস দেওয়ার পরে সেখান থেকে বেরিয়ে চন্দননগরের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি।
তরুণীর মৃত্য়ুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক চাপানউতরও শুরু হয়েছে। রাজ্যে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। এক্স হ্যান্ডলে তিনি লিখেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে এ রাজ্যে মহিলারা কোথাও নিরাপদ নন। তা সে হাসপাতালই হোক বা রাস্তাঘাট। এক মহিলার পিছু ধাওয়া করে তাঁকে হেনস্থা করা হয়েছে। যার জেরে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। প্রতি দিন মহিলাদের জন্য এ রাজ্য নরক হয়ে উঠছে। অথচ রাজ্য সরকার চুপ। দোষীদের সাজা দেওয়ার পরিবর্তে তাদের আড়াল করা হচ্ছে।’’
পাল্টা তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ সোমবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘‘বিষয়টি গুরুতর। প্রথমে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, রাস্তায় মহিলাকে হেনস্থা করা হয়েছে, তা থেকে বাঁচতে গিয়েই দুর্ঘটনায় মহিলার প্রাণ গিয়েছে। পুলিশ পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে জানিয়েছে, ইভটিজ়িংয়ের কোনও ঘটনাই ঘটেনি। ওভারটেক করতে গিয়ে রেষারেষিতে ঘটনাটি ঘটেছে। এর সঙ্গে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা, নারী নির্যাতনের যে ভাষ্য তৈরি করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। একটা জাতীয় সড়কে প্রতি ইঞ্চিতে তো পুলিশ মোতায়েন থাকতে পারে না। আমাদেরও দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় দিতে হবে।’’