বিশ্বকবির দেখা পারস্য আর বর্তমান ইরানের তুলনা ভারতের রাষ্ট্রীয় সমস্যা বুঝতে সাহায্য করে

১৮৭৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ৫৬ বছরের সময়কালে বিশ্বকবির বিশ্ব ভ্রমণে ৩২টিরও বেশি দেশে তার চরণ স্পর্শ করেছিল। বিভিন্ন বয়সে উদ্দেশ্য বিভিন্ন থাকলেও তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে সমসাময়িক কালের রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি যেমন জানা যায় বর্তমান কালের প্রেক্ষিতে তার তুলনাও করা যায়। যিনি নিজেকে বিশ্বমানবের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতেন বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতার রূপান্তরের মাধ্যমে মানব মুক্তির পথকে বুঝতে , সত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে তিনি যে বারবার বেরিয়ে পড়বেন তা স্বাভাবিক।

১৯১৩ সালে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর বিভিন্ন দেশ থেকে ডাক আসে সম্বর্ধনা গ্ৰহণের। আর শান্তিনিকেতনে কবি ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ‘বিশ্বভারতী’ নামে শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্ব ও ভারতের যে মিলনক্ষেত্র তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগাড় ও বিশ্বের গণ্যমান্য শিক্ষাবিদদের শান্তিনিকেতনে আনার সুযোগ হয়েছিল এই ক্লান্তিহীন ভ্রমণগুলির মাধ্যমে।

১৯৩২ সালে সত্তরোর্ধ্ব কবি ইরানের রাজা রেজা শাহ পহেল্ভীর নিমন্ত্রণে শুশ্রুষার প্রয়োজনে বৌমা প্রতিমাদেবী এবং কর্মসহায়করূপে কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় ও অমিয় চক্রবর্তী কে সঙ্গে নিয়ে ১১ এপ্রিল দমদম বিমানবন্দর থেকে ‘ব্যোমতরী’তে যাত্রা শুরু করেন। ১৩ এপ্রিলে সকাল সাড়ে-আটটার সময় বুশেয়ারে নামেন।১৬ তারিখে বুশেয়ার থেকে শিরাজ তারপর ২২ তারিখে ইস্পাহান , ২৯ শে এপ্রিল পৌঁছান ইরানের রাজধানী তেহরানে। ২রা মে সাক্ষাৎ করেন ইরানের রাজা রেজা শাহ পহেল্ভীর সঙ্গে।

বিশ্বকবির পারস্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বর্তমান ইরানের সামাজিক পরিস্থিতি ও বিশ্বমঞ্চে ইরানের ভূমিকার তুলনা বর্তমান বিশ্বের সংকটজনক পরিস্থিতিতে খুবই প্রাসঙ্গিক ।এই প্রবন্ধ লেখার আগেই ইজরায়েলে ইরানের মিসাইল হামলার জবাবে ইজরায়েল ইরানের ইস্পাহান শহরে হামলা করেছে। ১৯৪৮ সালে বিশ্বের মানচিত্রে ইজরায়েলের আত্মপ্রকাশের পর ইরানের সঙ্গে ইজরায়েলের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক মধুর ছিল। ইজরায়েলের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা পূরণ করতো ইরান আর ইজরায়েলের নতুন প্রযুক্তি পেতো ইরান। এখন সেই ইরানের পারমাণবিক বোমার গবেষণা যে দেশটির কাছে সব থেকে বেশি বিপদজনক তার নাম– ইজরায়েল। ১৯৩২ সালে কবিগুরুর বিশ্ব ভ্রমণের সময়কার ইরান আর এখনকার ইরানের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর আর এই পার্থক্যই বিশ্ব শান্তির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৩২ সালে পারস্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে কবি জানাচ্ছেন ‘নিষ্ঠুর ইতিহাসের হাত থেকে পারস্য যেমন বরাবর আঘাত পেয়েছে পৃথিবীতে আর-কোনো দেশ এমন পায় নি, তবু তার জীবনীশক্তি বারবার নিজের পুনঃসংস্কার করেছে। বর্তমান যুগে আবার সেই কাজে সে লেগেছে, জেগে উঠেছে আপন মূর্ছিত দশা থেকে।’
পারস্যের এই ‘মূর্ছিত দশা’ কাজার বংশীয় রাজা আগা খাঁর দুর্বল শাসনব্যবস্থা আর অত্যাচারের জন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে রাশিয়া আর ইংরেজদের মধ্যে পারস্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কয়েকবছর আগেই ইরানে খনিজ তেলের অস্তিত্ব জানা গেছে। ব্রিটিশ তেল কোম্পানিগুলি তখন ইরানের তৈলভান্ডারের নিয়ন্ত্রণে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ইরানে প্রথম সাংবিধানিক সভা তৈরি হয় আর সংখ্যালঘু জরাথুষ্ট্রীয় উপাসনা পদ্ধতিকে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া হয়।বলশেভিক বিপ্লবের সময় কিছুকাল রাশিয়া সরে দাঁড়ালেও দ্বিতীয় দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব কাটিয়ে রেজা শাহ পহেল্ভী শক্তহাতে ইরানের হাল ধরেন।রেজা খান থেকে নিজের নামকে রেজা শাহ পহেল্ভী করে প্রাচীন পার্সি ভাষা তথা পারসিক ইতিহাসের সঙ্গে নিজের পরিচয়কে যুক্ত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পারস্যে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন “পারস্যে যে মানুষ সত্যিই পারসিক তাকেই দেখতে এসেছি।’ তাকে দেখবার কোনো আশা থাকে না দেশে যদি আলো না থাকে। জ্বলছে আলো জানি।” এই আলো রেজা শাহের উদারনীতির আলো , উপাসনা পদ্ধতির পরিবর্তন হলেও কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন পারস্যের ইতিহাসকে আলিঙ্গন করার আলো। কবি সে সম্পর্কে জেনেছেন ‘এখানে পরধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি কিরকম ব্যবহার, এই প্রশ্নের উত্তরে শুনলুম, পূর্বকালে জরথুস্ত্রীয় ও বাহাইদের প্রতি অত্যাচার ও অবমাননা ছিল। বর্তমান রাজার শাসনে পরধর্মমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা দূর হয়ে গেছে; সকলেই ভোগ করছে সমান অধিকার, ধর্মহিংস্রতার নররক্তপঙ্কিল বিভীষিকা কোথাও নেই।’ রেজা শাহ বেশিরভাগ পুরুষদের মোল্লাবেশ নিষিদ্ধ করেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদের বোরখা নিষিদ্ধ করেন, যে সমস্ত প্রেক্ষাগৃহে পুরুষ-মহিলার একসাথে যাওয়া নিষিদ্ধ তাদের উপর করের বোঝা বাড়িয়ে দেন। পারস্যের নাম পরিবর্তন করে ‘আর্য’ পরিচয়কে সামনে এনে সরকারিভাবে দেশের নাম ‘ইরান’ করেন যা ‘আর্যান’ শব্দের অপভ্রংশ।রেজা শাহের প্রতি কবিগুরুর বিশ্বাস অমূলক ছিল না।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ড আর সোভিয়েত রাশিয়া মিলে ইরান থেকে জার্মানদের নিষ্কাশিত করার আদেশ করলে রেজা শাহ মানতে অস্বীকার করেন। ফলে রেজা শাহ কে সরতে হয়।হিটলারের হাত থেকে ইরানের তৈলভান্ডার রক্ষা করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত রাশিয়া, ইংল্যান্ড একসাথে ইরানকে নিজেদের দখলে নেয়।
কবিগুরু ইউরোপের বিজ্ঞানসাধনাকে সত্যের সাধনা বলেছিলেন কিন্তু সেই বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতাকে তামসিকতা বলেছিলেন। রেজা শাহ চেয়েছিলেন ইউরোপের মুক্তচিন্তাকে কিন্তু মূল্য দিয়েছিলেন ইউরোপ ও সোভিয়েত রাশিয়ার লোভের।
কবিগুরু পারস্যের যে সংস্কার দেখে আশাবাদী হয়েছিলেন তার সমাপ্তি ঘটে যখন ১৯৭৯ সালে পহেল্ভী বংশ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ইরানের সর্বাধিনায়ক আল খোমেইনীর নেতৃত্বে ‘Islamic Republic of Iran’ গঠিত হয়। সুন্নী আরব ও তুরস্ককে পিছনে ফেলে শিয়া ইরান মুসলিম দুনিয়ার নেতৃত্বে পেতে একসময়ের বন্ধু ইজরায়েলকে ধ্বংসের প্রতিজ্ঞা করে। এই কট্টরতা ইরানের জন্মজাত নয় , এই ইসলামিক কট্টরপন্থী ইরানের সঙ্গে ২৫০০ বছরের প্রাচীন পারস্যের কোনো মিল নেই। আজ ইরান, ইজরায়েলকে ধ্বংস করতে হামাস, হিজবুল্লা,হুতি জঙ্গীগোষ্ঠীকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। কবিগুরু পারস্য ভ্রমণের সময় যে আলো দেখেছিলেন তা নিভে গেছে। কবির ভ্রমণকালের রেজা শাহ পহেল্ভীর কাজ দেখে অভিজ্ঞতা ‘কেবল যে বিদেশীর কবল থেকে তিনি পারস্যকে বাঁচিয়েছেন তা নয়, মোল্লাদের-অধিপত্যজালে-দৃঢ়বদ্ধ পারস্যকে মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রতন্ত্রকে প্রবল ও অচল বাধা থেকে উদ্ধার করেছেন।’ বর্তমানের ইরানে মোল্লাতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত।
বিশ্বকবি পারস্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় নৃশংসতার বিরুদ্ধে পারস্যের লড়াইয়ের প্রশংসা করেছেন আর স্মৃতিচারণ করেছেন আকিমেনীয়, সাসিরীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাস।আর সেই ইতিহাসের সঙ্গে যেনো প্রাচীন ভারতের যোগ খোঁজার চেষ্টা করেছেন- “সমগ্র পারস্যের সেই প্রথম অদ্বিতীয় সম্রাট ছিলেন বিখ্যাত সাইরস, তাঁর প্রকৃত নাম খোরাস। তিনি শুধু যে সমস্ত পারস্যকে এক করলেন তা নয়, সেই পারস্যকে এমন এক বৃহৎ সাম্রাজ্যের চূড়ায় অধিষ্ঠিত করলেন সে যুগে যার তুলনা ছিল না। এই বীরবংশের এক পরম দেবতা ছিলেন অহুরমজ্‌দা। ভারতীয় আর্যদের বরুণদেবের সঙ্গেই তাঁর সাজাত্য। বাহ্যিক প্রতিমার কাছে বাহ্যিক পূজা আহরণের দ্বারা তাঁকে প্রসন্ন করার চেষ্টাই তাঁর আরাধনা ছিল না। তিনি তাঁর উপাসকদের কাছ থেকে চেয়েছিলেন সাধু চিন্তা, সাধু বাক্য ও সাধু কর্ম। ভারতবর্ষের বৈদিক আর্যদেবতার মতোই তাঁর মন্দির ছিল না, এবং এখানকার মতোই ছিল অগ্নিবেদী।”
শিরাজ থেকে ইস্ফাহানের পথে কবি দেখেন আকেমেনীয় শহর পার্সিপোলিসের ধ্বংসাবশেষ। আলেকজান্ডারের আক্রমণে আকেমেনীয় সাম্ভ্রাজ্য ধ্বংস হয়। কবি লিখেছেন ‘এই পর্সিপোলিসে ছিল দরিয়ুসের গ্রন্থাগার। বহু সহস্র চর্মপত্রে রুপালি সোনালি অক্ষরে তাঁদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা লিপীকৃত হয়ে এইখানে রক্ষিত ছিল। যিনি এটাকে ভস্মসাৎ করেছিলেন তাঁর ধর্ম এর কাছে বর্বরতা। আলেকজান্দার আজ জগতে এমন কিছুই রেখে যান নি যা এই পর্সিপোলিসের ক্ষতিপূরণ-স্বরূপে তুলনীয় হতে পারে।’ প্রসঙ্গত আলেকজান্দ্রিয়ার যে লাইব্রেরীকে গ্ৰীকদের বলে দাবি করা হয় তা আসলে লুট করা দারিয়ুসের গ্ৰন্থাগার। কবি জানতে পারেন “পারস্যে আর-এক জায়গা খনন করে প্রাচীনতর বিস্মৃত যুগের জিনিস পাওয়া গেছে। অধ্যাপক তারই একটি নকশা-কাটা ডিমের খোলার পাত্র আমাকে দেখালেন। বললেন মহেঞ্জোদরোর যেরকম কারুচিত্র এও সেই জাতের। সার্‌ অরেল্‌স্টাইন মধ্যএশিয়া থেকেও এমন কিছু কিছু জিনিস পেয়েছেন মহেঞ্জোদরোয় যার সাদৃশ্য মেলে। এইরকম বহুদূরবিক্ষিপ্ত প্রমাণগুলি দেখে মনে হয় আধুনিক সকল সভ্যতার পূর্বে একটা বড়ো সভ্যতা পৃথিবীতে তার লীলা বিস্তার করে অন্তর্ধান করেছে।” আর্য আক্রমণ তত্ত্বের ষড়যন্ত্র সেই সময়ে ভারতীয়দের বিভ্রান্ত না করলে কবি নিশ্চিত হতে পারতেন ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে পারস্যের সম্বন্ধ নিয়ে।আজ যে ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তা ব্যবসায়িক। ইরান, ইসলামিক দেশ হওয়ার পর তার পতাকা থেকে আকেমেনীয় সাম্রাজ্যের স্মৃতি বহনকারী সিংহ ও সূর্যের প্রতীক সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ইসলামিক রিপাবলিক হওয়ার আগে ১৯৭১ সালে ইরানে পারস্য সাম্রাজ্যের ২৫০০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান হয়েছে। আলেকজান্ডারের আক্রমণের পরেও পারস্যের সাসিনীয় সাম্রাজ্য পারস্যকে আবার পুনর্গঠন করে , পুরাতন জরাথ্রুষ্টীয় উপাসনা পদ্ধতিকে অগ্ৰাধিকার দেওয়া হলেও ইহুদী, খ্রীষ্টানদের অধিকার সুরক্ষিত থাকে। একদিকে খ্রীষ্টিয় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের চাপ আর অন্যদিকে মুসলিম আরবদের আক্রমণে সাসিনীয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায়। মুসলিম আরবের আক্রমণে জরাথ্রুষ্টীয়দের হয় পালাতে হয় নয়তো ইসলাম গ্ৰহণ করতে হয়। পারস্য নিজের পরিচয় হারাতে শুরু করে। কিছু পার্সী ভারতের গুজরাট ও মুম্বাইতে শরণার্থী হয়ে আসে।
কবি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পারস্যকে নিয়ে ‘আশ্চর্যের কথা এই যে, আরবের হাতে, তুর্কির হাতে, মোগলের হাতে, আফগানের হাতে পারস্য বারবার দলিত হয়েছে, তবু তার প্রাণশক্তি পুনঃপুন নিজেকে প্রকাশ করতে পারলে।’
তেহরানে ৬ ই মে কবির জন্মদিন পালিত হয়েছিল। সেখানে এক পার্সি ভদ্রলোকের বিশ্লেষণ— ‘তিনি বললেন, সমস্ত জাতিকে আশ্রয় করে পারস্যে যে ভাষা ও সাহিত্য বহমান তারই ধারাবাহিকতা পারস্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অনাবৃষ্টির রুদ্রতা যখন তাকে বাইরে থেকে পুড়িয়েছে তখন তার অন্তরের সম্বল ছিল তার আপন নদী। এতে শুধু যে পারস্যের আত্মস্বরূপকে রক্ষা করেছে তা নয়, যারা পারস্যকে মারতে এসেছিল তারাই পারস্যের কাছ থেকে নূতন প্রাণ পেলে– আরব থেকে আরম্ভ করে মোগল পর্যন্ত।’
পারস্যের উপাসনা পদ্ধতি জোর করে পরিবর্তন করা হলেও তাঁর প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর যোগ অবিচ্ছেদ্য ছিল পারসী ভাষার মাধ্যমে।
আব্বাসীয় খিলাফতের সময়ে , খলিফার পার্সীয়-বৌদ্ধ বংশোদ্ভূত ওয়াজির(মন্ত্রী)দের উদ্যোগে পার্সিয়া ও ভারতবর্ষ থেকে আনা বইগুলোর অনুবাদ শুরু হয়।এই পার্সীয়-বৌদ্ধ বংশোদ্ভূতদের ‘বার্মাকিড’ বলা হতো অর্থাৎ বার্মাক(প্রমুখ)দের উত্তরসূরী।বৌদ্ধ মঠ ‘নববিহার’ এর প্রধান কে ‘বার্মাক’ বলা হতো।রাশিদুন খিলাফতের সময়ে(৬৩৩-৬৫৪খ্রীঃ)খলিফা উমরের(৬৫১ খ্রীঃ) নেতৃত্বে পার্সিয়ার সাসিনীয়( প্রধানতঃ জোরাস্ট্রিয়ান ধর্মাবলম্বী) সাম্রাজ্যের পতন হলে এই বৌদ্ধ বার্মাকরা ইসলাম গ্ৰহণ করে।
বিভিন্ন উৎস থেকে বই অনুবাদ করার অভ্যাস বার্মাকিডদের আগে থেকেই ছিল। পার্থক্য এইটুকুই যে সাসিনীয় সাম্রাজ্যের সময় তারা পার্সি (পাহ্লভি) ভাষায় অনুবাদ করতো আর এখন খলিফার জন্য আরবী তে অনুবাদ করছে।একদিকে বাইজান্টাইন আর অন্যদিকে খিলাফতের আক্রমণে চার শতাব্দীর (২২৪-৬৫১ খ্রীঃ) সাসিনীয় সাম্রাজ্যের পতন হলেও নতুন পার্সিয় মুসলমানদের কদর খিলাফত সাম্রাজ্যে বাড়তে থাকে।
ছোটোবেলায় আমরা সবাই নীতি শিক্ষামূলক গল্প পড়েছি বা শুনেছি যেখানে বিভিন্ন পশু-পাখি কে চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো।এই গল্পগুলোর উৎস প্রায় ৫০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে সংস্কৃতে লেখা ‘পঞ্চতন্ত্র’।পঞ্চতন্ত্রের কাহিনী গুলি পার্সি ভাষা থেকে আরবী তে অনূদিত হয় প্রায় ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে।এর আগে সংস্কৃত থেকে পার্সি ভাষায় অনুবাদ করা হয় ৫০০ খ্রীষ্টাব্দে। পঞ্চতন্ত্রের অনুবাদ ; আমাদের , জ্ঞানের প্রবাহের দিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয়। গ্ৰিক ভাষায় পঞ্চন্ত্রের অনুবাদ হয় ১০৮০ খ্রীষ্টাব্দে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উৎস সম্পর্কে বিভ্রান্ত করা গেলেও পঞ্চতন্ত্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কে অস্বীকার করার উপায় নেই। এখনো ভারতবর্ষের বিভিন্ন মন্দিরের দেওয়ালে পঞ্চতন্ত্রের কাহিনী খোদাই করা আছে।পঞ্চতন্ত্র প্রমাণ করে যে জ্ঞানের প্রবাহ ভারত থেকে পার্সিয়া , পার্সিয়া থেকে আরব এবং আরব থেকে খ্রীষ্টিয় ইউরোপ— এই পথেই হয়েছিল। কবিগুরু যথার্থই বলেছেন– ‘আরবরা তুর্কিরা মোগলরা এসেছিল দানশূন্য হস্তে, কেবলমাত্র অস্ত্র নিয়ে। আরব পারস্যকে ধর্ম দিয়েছে, কিন্তু পারস্য আরবকে দিয়েছে আপন নানা বিদ্যা ও শিল্পসম্পন্ন সভ্যতা। ইসলামকে পারস্য ঐশ্বর্যশালী করে তুলেছে।’
পরবর্তীকালে মোঙ্গল আক্রমণের পর পারস্যে যে সাফাভিদ রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় , তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের শিয়া মতকে প্রাধান্য দেয়। আজ যে সুন্নী আরব আর শিয়া ইরাকের মধ্যে মুসলিম দুনিয়ার নেতৃত্ব পাওয়ার লড়াই তার সূত্রপাত বলা যায়। সুন্নি অটোমান আর সুন্নি মোঘলদের মাঝে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেলো শিয়া পারস্য। মোঘলদের সরকারি ভাষা আরবী না হয়ে পার্সী হলো।অনেক ঐতিহাসিক ইন্দো-পার্সিয়ান সংস্কৃতির কথা বলেন কিন্তু মোঘলদের মাধ্যমে পার্সিয়ার যে প্রভাবের কথা বলা হয় তা আসলে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার পারস্যের আয়নায় প্রতিফলন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য উদার মোঘল সম্রাট দারা শিকোর উদ্যোগে উপনিষদের পার্সী অনুবাদ ইউরোপে পৌঁছায় যা পরবর্তীকালে ইউরোপীয় দর্শনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
বর্তমানে সুন্নী আরবে মেয়েদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছে, আরবের মরুভূমিতে স্বামী নারায়ণ মন্দিরের উদ্বোধন হয়েছে কিন্তু শিয়া ইরানের তালা বিশ্বসংস্কৃতির জন্য বন্ধ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩২ এর আগে খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থনের মাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের ভাগীদার করার ব্যর্থ প্রয়াস দেখেছেন। কবিকে দেশবিভাজন দেখে যেতে হয় নি কিন্তু তার কারণ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
প্রত্যেক দেশে গিয়ে শৈশব থেকেই উপনিষদীয় দর্শনে সম্পৃক্ত কবি মানব মিলনের ঐক্য বিন্দু খুঁজেছেন। আবার তৎকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজতেন।
পারস্যের আরব-সীমানার কানিকিন রেলওয়ে স্টেশনের ভোজনশালায় চা খাওয়ার সময় একজন কবিকে বলেছিলেন– “আমরা সকলেই এক। ভারতীয় মুসলমানেরা ধর্মের নামে কেন যে এমন বিরোধ সৃষ্টি করছে আমরা একেবারেই বুঝতে পারি নে।’ ভারতীয়েরাও বলেন, “এখানকার মুসলমানদের সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতার লেশমাত্র অভাব নেই।’দেখা যাচ্ছে ঈজিপ্টে তুরুস্কে ইরাকে পারস্যে সর্বত্র ধর্ম মনুষ্যত্বকে পথ ছেড়ে দিচ্ছে। কেবল ভরতবর্ষেই চলবার পথের মাঝখানে ঘন হয়ে কাঁটাগাছ উঠে পড়ে, হিন্দুর সীমানায় মুসলমানের সীমানায়।” এই সীমানা যে এখনো মুছে যায় নি তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাবর-ঔরঙ্গজেবের কুকীর্তি কে আগলে রাখার চেষ্টায়। রাষ্ট্রীয় ঐক্যের মূলগত সমস্যাকে মাথায় রেখেই বাগদাদের সাহিত্য সভায় সাহিত্যিকদের কাছে কবির আবেদন — “দুঃসহ আমাদের দুঃখ, আমাদের মুক্তির অধ্যবসায় পদে পদে ব্যর্থ; আপনাদের নবজাগ্রত প্রাণের উদার আহ্বান সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা থেকে, অমানুষিক অসহিষ্ণুতা থেকে, উদার ধর্মের অবমাননা থেকে, মানুষে মানুষে মিলনের পথে, মুক্তির পথে নিয়ে যাক হতভাগ্য ভারতবর্ষকে। এক দেশের কোলে যাদের জন্ম অন্তরে বাহিরে তারা এক হোক।”
কিন্তু ভারতবর্ষে জন্ম নিয়েও ‘অন্তরে-বাহিরে এক হতে’ আর কত দেরি তার উত্তর ভবিষ্যৎ দিবে কিন্তু কবিগুরু পারস্যের যে নবোত্থান দেখেছিলেন তার সমাধি ১৯৭৯ সালে রহুল্লাহ খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামিক বিপ্লবের মাধ্যমে হয়ে গেছে। রেজা শাহ পহেল্ভীর আচরণে ক্ষুব্ধ ত্রিশক্তি অর্থাৎ আমেরিকা, ইংল্যান্ড আর সোভিয়েত রাশিয়া রেজা শাহের পুত্র মহম্মদ রেজা শাহ কে রাজা করে , যিনি ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন আর আমেরিকার হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন।১৯৭৯ সালের পর থেকে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার নৈকট্য বেশি। ইউরোপের মুক্ত চিন্তা গ্ৰহণ করে রেজা শাহের আমলে মোল্লাতন্ত্র মুক্ত ও ইউরোপীয় প্রভাবমুক্ত যে ইরানের সূচনা কবিগুরু দেখেছিলেন সেখানে আজ হিজাব বিরোধী আন্দোলনের গলা টিপতে নারী হত্যা করতেও দ্বিধা করে না ইরানের ইসলামিক রিপাবলিক।২২ বছরের মাহসা আমিনি, ১৬ বছরের নিকা শাকারামির মৃত্যু ইরানের পাপের বোঝা বাড়িয়েছে। ভারত গণতান্ত্রিক দেশ হলেও কর্ণাটকে হিজাবের সমর্থনে আন্দোলন ভাবতে বাধ্য করে ভারতে কবিগুরুর ইপ্সিত ‘অন্তরে-বাহিরে’ ঐক্যলাভের উপায় কি ? প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, পালিয়ে আসা পার্সিদের বংশধর হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা, রতন টাটা যারা সংখ্যালঘুদের মধ্যে লঘুতম ভারতের সমৃদ্ধি ও রাষ্ট্রীয় ঐক্যকে বলিষ্ঠ করতে তাদের যোগদান প্রশংসনীয় । কখনো ইউরোপীয় প্রভাবে ইরানে অর্থনৈতিক লুট আবার কখনো কট্টরপন্থী ইসলামিক শক্তির প্রভাবে মধ্যযুগীয় সামাজিক ব্যবস্থার নৃশংসতার চাপে প্রাচীন পারস্য জাতির মানুষেরা নিজেদের ঐতিহাসিক পরিচয় থেকে , মানবাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন। ইরানের পার্লামেন্টের যে কোনো আইন শরিয়া কানুনের অনুসারী হলে তবেই তা বিশেষজ্ঞ মোল্লা কমিটির অনুমোদন পেতে পারে। যে কোনো সংস্কারপন্থী প্রতিনিধির নির্বাচনে অংশগ্রহণ আটকে দেওয়া ইরানে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। রাশিয়ার ইশারায় ইরান আমেরিকা-ইজরায়েলকে চোখ রাঙাতে ভয় পায় না।ইরান এখন শুধু পারমাণবিক বোমা বানানোর অপেক্ষায়।
কবিগুরু ১৯৩২ সালে যেখানে সংস্কারের আলো দেখেছিলেন সেখানেই এখন মানবতার বিপদসংকুল ঘন অন্ধকার। কবিগুরু জাপানের সাম্রাজ্যবাদী রূপ দেখে জাপানের আসন্ন ধ্বংসের যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা মিলে গিয়েছিল। ইরানের ক্ষেত্রেও সে দিন হয়তো আর দূরে নেই — ‘বোঝা তোর ভারী হলে ডুববে তরীখান’ ।
তরী ডুববার আগেই প্রাচীন পারস্য জাতি আবার জেগে উঠে নিজের ইতিহাসের সঙ্গে একাত্ম হলে ইরানের মঙ্গল, বিশ্বের মঙ্গল।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.