ঘাটালের তৃণমূল সাংসদ দেবকে ডেকে পাঠাল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে দিল্লিতে ইডির সদর দফতরে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে। ইডি সূত্রে খবর, আর্থিক তছরুপ মামলায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় তারা। এ বিষয়ে দেবের সঙ্গে বৃহস্পতিবার আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। মোবাইলে পাঠানো প্রশ্নেরও জবাব মেলেনি।
তবে দেবের ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, ২১ তারিখ দেব ইডির দফতরে যাবেন। এর আগেও তিনি যেমন জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তেমনই এ বারেও হবেন। দেবের এক ঘনিষ্ঠের বক্তব্য, ‘‘ওকে যত বার ডেকে পাঠানো হবে, তত বারই যাবে। তদন্তে সবসময় সহযোগিতা করবে।’’
এর আগে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দেবকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল সিবিআই। কলকাতায় সিবিআই দফতর নিজাম প্যালেসে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছিল, গরু পাচারকাণ্ডে বিভিন্ন সাক্ষীকে জেরা করার সময় দেবের নাম উঠে এসেছিল। সেই কারণে তাঁকে ডাকা হয়েছিল বলে মনে করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়ে দেব জানিয়েছিলেন, ‘‘একজন ব্যক্তিকে চিনি কি না, সেই বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। আমার বক্তব্য জানিয়েছি। মনে হয় আর ডাকবে না।’’
২০২৩ সালে দেবের বিরুদ্ধে নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ করেছিলেন বিজেপি বিধায়ক তথা অভিনেতা হিরণ। তাঁর অভিযোগ, গরু পাচারকাণ্ডে ধৃত এনামুল হকের কাছ থেকে ৫ কোটি টাকা নিয়েছেন ঘাটালের সাংসদ। দেব পাল্টা জানিয়েছিলেন, তথ্যপ্রমাণ থাকলে ইডি বা সিবিআইয়ের কাছে যান হিরণ।
সম্প্রতি দেবের রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার জল্পনা তৈরি হয়। দিন কয়েক আগে ঘাটালের তিনটি প্রশাসনিক পদ— ঘাটাল কলেজ, ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতি ও বীরসিংহ উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেন সাংসদ দেব। তার পরেই দেবের রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার জল্পনা আরও জোরালো হয়। তবে কি ঘাটালে আর প্রার্থী হচ্ছেন না দেব? তবে কি এ বার রাজনীতি থেকেও ইস্তফা? জানুয়ারির শুরুতে মমতা যদিও স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, দেবই হতে চলেছেন ঘাটালের প্রার্থী। কালীঘাটে মমতার নেতৃত্বে বৈঠক বসেছিল। তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা কমিটির বৈঠকে সাংসদ হিসেবে হাজির হয়েছিলেন দেব। সেখানেই তাঁকে ফের ঘাটালে প্রার্থী করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মমতা। আর দলনেত্রীর নির্দেশ থাকলে তিনিও যে ফের লোকসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রস্তুত, পাল্টা সেই ইঙ্গিত দেন দেবও। তাঁকে দলের ‘সম্পদ’ বলেন দলনেত্রী। তার পরেও ঘাটালের তিনটি প্রশাসনিক পদ থেকে ইস্তফা দেন দেব।
এর পর লোকসভার বাজেট অধিবেশনের শেষ দিন দেবের পোস্ট তাঁর প্রার্থী না হওয়ার জল্পনা আরও উস্কে দেয়। তিনি সমাজমাধ্যমে একটি পোস্টে লিখেছিলেন, ‘‘সংসদে আমার শেষ দিন।” এতেই অনেকের মনে হয়েছিল, ঘাটাল থেকে আসন্ন লোকসভায় দেব যে আর দাঁড়াতে চাইছেন না। যদিও সরাসরি এ ব্যাপারে কখনওই কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানাননি দেব। এর মধ্যেই তৃণমূলনেত্রী মমতা এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেকের সঙ্গে বৈঠক করেন দেব। তবে মমতা বা অভিষেকের সঙ্গে দেবের কী আলোচনা হয়েছে, তা কারও তরফেই প্রকাশ করা হয়নি। মমতা, অভিষেক বা দেব— কেউই সে ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি। তবে জোড়া বৈঠক সেরে দেব ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি ছাড়তে চাইলেও রাজনীতি আমাকে ছাড়বে না!” সেই আবহে ঘাটাল সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরানো হয় শঙ্কর দলুইকে। দলের একটি অংশ মনে করছিল, এই শঙ্করের সঙ্গে দেবের ‘শীতল সম্পর্ক’-এর কারণেই টানাপড়েন শুরু হয়েছিল। শঙ্করকে সরিয়ে দেবকেই ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হয় বলে মনে করছিল তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ।
এর পরেই গত ১২ ফেব্রুয়ারি, সোমবার আরামবাগে সরকারি কর্মসূচিতে মমতার সঙ্গে একই মঞ্চে দেখা গিয়েছিল দেবকে। সেখানেই তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘দিদির হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলাম। দিদির হাত ধরেই থেকে গেলাম। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী দিদি।’’ এর পর রাজ্য সরকারের কাছে বানভাসি ঘাটালের জন্য ‘মাস্টারপ্ল্যান’ তৈরির অনুরোধও জানান দেব। জবাবে মমতা বলেন, ‘‘দিদির কাছে ভাই আবদার করলে তো দিদি ফেরাতে পারে না। আমি ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছি ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে। দিল্লির ভরসায় থাকব না। আমরা আমাদেরটা করে নেব।’’ শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে যখন প্রায় স্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তৃতীয় বারের জন্য প্রার্থী হচ্ছেন দেব, তখনই তাঁকে সমন পাঠাল ইডি।