প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে উদ্ধার হওয়া কিছু নথিতে কয়েক জন ‘প্রভাবশালী’র নাম উঠে আসায় শোরগোল পড়েছে রাজ্য-রাজনীতিতে। তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ভাই প্রাক্তন সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী, বিজেপি নেত্রী তথা প্রাক্তন আইপিএস অফিসার ভারতী ঘোষ, তেমনই রয়েছেন তৃণমূলের সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর এবং তৃণমূল বিধায়ক শওকত মোল্লাও। বিকাশ ভবনে তল্লাশি অভিযানে সিবিআই যে নথি উদ্ধার করেছিল, সেই নথিতে তাঁদের নাম-পরিচয়ের উল্লেখ রয়েছে (সেই নথি আনন্দবাজার অনলাইনের হেফাজতে রয়েছে)।
সিবিআই সূত্রের খবর, নথি খতিয়ে দেখেই তদন্তকারীদের একাংশের অনুমান, দিব্যেন্দু, ভারতী, মমতাবালা এবং শওকতেরা অনেক চাকরিপ্রার্থীর নামই সুপারিশ করেছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। সেই সব চাকরিপ্রার্থীরও নাম রয়েছে সিবিআইয়ের নথিতে। তাঁদের মধ্যেই বেশ কয়েক জন চাকরি পেয়েছেন বলে ওই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে জানিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ।
সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, সুপারিশ তালিকার মধ্যে যাঁদের চাকরি হয়েছে, তাঁদের চাকরি সুপারিশের কারণেই হয়েছে কি না, আপাতত তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে ‘প্রভাবশালী’দের কাউকে এখনও তলব করা হয়নি। যদিও ওই চাকরিপ্রাপকদের একাংশকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিবিআই।
গত বছর জুন মাসে বিকাশ ভবনে তল্লাশি চালিয়েছিলেন সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা। সেখান থেকে বেশ কিছু নথি তাঁরা উদ্ধার করেন। সিবিআই সূত্রের খবর, তার মধ্যে একটি নথিতে ৩২৪ জন চাকরিপ্রার্থীর নাম এবং রোল নম্বর মিলেছে। তদন্তকারীদের অনুমান, বিভিন্ন ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তিই তাঁদের নাম সুপারিশ করেছিলেন। অনুমানের কারণ, নথিতে সেই সব ‘প্রভাবশালী’র নাম-পরিচয়ের উল্লেখ রয়েছে। নথিতে দেখা যাচ্ছে, দিব্যেন্দু এবং মমতাবালার নামের পাশে ‘এমপি’ (সাংসদ) লেখা। অনেকের নামের পাশে লেখা ‘এমএলএ’ (বিধায়ক)। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বীণা মণ্ডল, নির্মল ঘোষ, শওকত মোল্লা, শ্যামল সাঁতরা, রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস এবং গুলশন মল্লিক। সকলেই তৃণমূলের নেতানেত্রী। নির্মল, বীণা, শওকত এবং গুলশন এখন বিধায়ক।
তবে বিজেপির দিব্যেন্দু এবং ভারতী দু’জনেই চাকরিপ্রার্থীদের নাম সুপারিশ করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। একই ভাবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তৃণমূলের মমতাবালা, শওকত এবং রমেন্দ্রনাথও।
সিবিআইয়ের নথিতে দেখা যাচ্ছে, দিব্যেন্দুর নামের নীচে ১১ জন চাকরিপ্রার্থীর নাম রয়েছে। তদন্তকারীদের একাংশের অনুমান, দিব্যেন্দু ওই ১১ জনের নাম সুপারিশ করেছিলেন পার্থের (নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ধৃত এবং বর্তমানে জেলবন্দি) কাছে। একই ভাবে মমতাবালা, ভারতী, শওকত যথাক্রমে ২০, চার এবং দু’জনের নাম সুপারিশ করেছিলেন। শ্যামল জমা দিয়েছিলেন ২২ জনের নাম। বীণা ১৩ জনের নাম সুপারিশ করেছিলেন। নির্মল ১৬ জন, গুলশন ১০ জন এবং রমেন্দ্রনাথ পাঁচ জনের। সব মিলিয়ে ৩২৪ জনের ওই তালিকার মধ্যে ১৩৪ জন চাকরি পেয়েছিলেন বলেও চার্জশিটে জানিয়েছে সিবিআই।

তদন্তকারী সংস্থা সূত্রের দাবি, চাকরিপ্রাপ্ত ১৩৪ জনের নামের তালিকা তারা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ থেকেই পেয়েছে। গত বছর ২৩ অগস্ট এ ব্যাপারে পর্ষদের কাছে তথ্য জানতে চেয়েছিলেন গোয়েন্দারা। পর্ষদ সিবিআইকে ১৩৪ জনের নামের তালিকা দেয় ওই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর। পর্ষদের নথিতে ওই ১৩৪ জনের নাম, রোল নম্বর, বাবার নাম, ঠিকানা, কোন স্কুলে চাকরি এবং তারিখ-সহ সুপারিশপত্রের মেমো নম্বর রয়েছে । সিবিআইকে দেওয়া পর্ষদের সেই নথির একটি প্রতিলিপিও আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে রয়েছে।
অতঃপর পর্ষদের দেওয়া ১৩৪ জন চাকরিপ্রাপকের তালিকার সঙ্গে বিকাশ ভবনে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া ৩২৪ জন চাকরিপ্রার্থীর নাম-রোল নম্বর মিলিয়ে দেখেছে সিবিআই। আনন্দবাজার অনলাইনের হেফাজতে থাকা ওই দু’টি তলিকা মিলিয়েও দেখা যাচ্ছে, দিব্যেন্দুর তালিকায় যে ১১ জনের নাম রয়েছে, তাঁদের মধ্যে পাঁচ জনের চাকরি হয়েছে। একই ভাবে বীণার তালিকায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে চাকরি পেয়েছেন ছ’জন। নির্মলের ক্ষেত্রেও সংখ্যাটা একই। এ ছাড়া মমতাবালার তালিকার দু’জন, শ্যামল এবং ভারতীর তিন জন করে, গুলশনের চার জনের চাকরি হয়েছে। নথি অনুযায়ী প্রাক্তন মন্ত্রী রমেন্দ্রনাথ এক জনেরই নাম সুপারিশ করেছিলেন বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। চাকরিপ্রাপ্তদের তালিকায় দেখা যাচ্ছে, সেই ব্যক্তির চাকরি হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের প্রাথমিকের পরীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২২ সাল থেকে তদন্ত করছে সিবিআই। যে বছরের পরীক্ষা নিয়ে এত বিতর্ক, সেই সময় দিব্যেন্দু এবং ভারতী দু’জনের কেউই বিজেপিতে ছিলেন না। দিব্যেন্দু সেই সময় তমলুকের তৃণমূল সাংসদ। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে দিব্যেন্দুর সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব বাড়ে। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে তিনি দিল্লি গিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপিতে যোগ দেন। অন্যদিকে, ভারতী পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার থাকার সময় রাজনৈতিক-প্রশাসনিক মহলে ‘তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত ছিলেন। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। ওই ভোটে বিজেপির টিকিটে প্রার্থীও হন। ভারতী প্রার্থী হয়েছিলেন ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটেও। তবে কোনও বারই জিততে পারেননি।
৩২৪ জন চাকরিপ্রার্থীর নাম সম্বলিত নথিতে মিহির গোস্বামীর নাম রয়েছে। তাঁর নামের পাশে পরিচয় হিসাবে ‘মেম্বার’ (সদস্য) লেখা। বর্তমানে নাটাবাড়ির বিজেপি বিধায়ক মিহির ২০২১ সালের আগে পর্যন্ত তৃণমূলেই ছিলেন। নথিতে তাঁর কথাই বলা হয়েছে কি না, তা দেখা হচ্ছে।