সাধারণত বর্ষার মরসুমে চাহিদা বেশি থাকে। কিন্তু, প্রচণ্ড তাপমাত্রা এবং শুখা মরসুমে যখন ভৌম জলস্তর তলানিতে তখনই মুর্শিদাবাদের ডোমকলে কলের পাইপ বিক্রি হচ্ছে হুড়মুড়িয়ে। বাজারে ঢুঁ দিয়ে জানা গেল, দুই থেকে তিন ইঞ্চি মাপের পাইপের চাহিদাই এখন সর্বাধিক। কিন্তু খটকা অন্য জায়গায়— কলের পাইপ বিক্রি হলেও বেকার বসে আছেন কলমিস্ত্রিরা। ব্যাপারটা কী? বিক্রেতারা এই প্রশ্নে মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
খোঁজ-খোঁজ। শেষে সূত্র মারফত খুলল ‘রহস্য’। ভোটের আগে ডোমকলে ‘সেল বোমা’ বাঁধতে জানা ‘দক্ষ কারিগরের’ চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। সেই চাহিদা মেটাতে ভিন্রাজ্য বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের পাশাপাশি প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকেও ডোমকলে আনা হচ্ছে সেল বোমার ‘কারিগরদের’। নির্বাচনের আগে এত বরাত পেয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে ‘কাজে’ নেমে পড়েছেন ওই কর্মীরা। সেই খবর পৌঁছেছে পুলিশের কাছেও। গোয়েন্দা সূত্র মারফত তথ্য জানার পর নড়েচড়ে বসেছেন প্রশাসনিক কর্তারা।
ভোটের আগে, ভোটের সময় এবং ভোটের পর— ডোমকল বরাবরই রাজনৈতিক হিংসার জন্য শিরোনামে উঠে এসেছে। এক এক ভোটে ভিন্ন ভিন্ন অস্ত্রের ‘চাহিদা’ বৃদ্ধি পায়। এ বারে দুষ্কৃতীদের ‘প্রথম পছন্দ’ নাকি সেল বোমা। সেই বিস্ফোরক বানাতে প্রধান কাঁচামাল পাইপের চাহিদাও তাই ঊর্ধ্বমুখী।
রাজ্যের গণ্ডি পেরিয়ে বিহারের মুঙ্গের থেকে মুর্শিদাবাদের ডোমকলে আসা সেল বোমা তৈরির দক্ষ কারিগর ইরফান শেখ (নাম পরিবর্তিত) বলেন, ‘‘মূলত আড়াই-তিন ইঞ্চি ব্যাসের জল তোলার কাজে ব্যবহৃত লোহার পাইপ, ১০-১২ ইঞ্চি লম্বায় কেটে বিশেষ কায়দায় তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়। বিস্ফোরক, বোমার মশলা, স্প্লিন্টার সাজিয়ে জলের লাইনের কাজে ব্যবহৃত ‘স্টপ কক’ কিংবা ‘লোহার সকেট’ ব্যবহার করে দুটো মুখ বন্ধ করে তৈরি হয় এই বিস্ফোরক।’’ সুতলি বা সকেট বোমার থেকে এই বোমার বিস্ফোরণমাত্রা অনেক বেশি। তা ছাড়া, অন্য বিস্ফোরকের মতো ‘পরিবহণজনিত’ দুর্ঘটনার আশঙ্কাও সেল বোমার ক্ষেত্রে কম। ঠোঁটের কোণে হাসি এনে স্থানীয় এক ‘কারিগর’ বলেন, ‘‘শুধু তাই নয়, বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ নির্ভরযোগ্য বোমা। তাই এ বার এর এত কদর।’’ কথায় কথায় তিনি জানালেন, উত্তরপ্রদেশ থেকে এই বোমা তৈরির ‘প্রশিক্ষণ’ নিয়ে এসেছেন।
চলতি বছরের ১৭ মার্চ মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরপাড়ায় প্রথম বার এই ‘নয়া’ বিস্ফোরক উদ্ধার করে পুলিশ। বোমাগুলি নিষ্ক্রিয় করতে ঘটনাস্থলে আসে বম্ব ডিসপোজ়াল স্কোয়াডের কর্মী এবং বিশেষজ্ঞেরা। তাঁরাই প্রথম ‘সেল বোমা’ চিহ্নিত করেন। জেলা বম্ব স্কোয়াডের এক সদস্যের কথায়, ‘‘ট্রেনিংয়ের সময় এই বোমার নাম শুনেছিলাম। আর সিনিয়রদের কাছেও উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে এই রকমের বোমার ব্যবহারের কথা শুনেছি। জেলায় পাঁচ বছরের দীর্ঘ কর্মজীবনে এই প্রথম চাক্ষুষ করলাম এই বোমা।’’ ইতিমধ্যেই বিস্ফোরক তৈরির উৎস খুঁজতে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে জেলা গোয়েন্দা দফতর।
তদন্তে নেমে জেলার গোয়েন্দারা জানতে পারেন, সাগরপাড়ায় উদ্ধার হাওয়া বোমাগুলি এসেছিল মুর্শিদাবাদের ডোমকল থেকে। বেশ কয়েক জন সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং পুলিশ সূত্রের পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, মুর্শিদাবাদের দুষ্কৃতীজগতে ‘আবির্ভাব’ হয়েছে এই নতুন ‘অতিথি’র। বিস্ফোরণের তীব্রতা এবং নিরাপদ পরিবহণের জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই প্রশ্নাতীত হারে বেড়েছে সেল বোমার কদর। সদ্য পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জেলা গোয়েন্দা দফতর এ-ও জানতে পেরেছে, ডোমকলের কুচিমোড়, গড়াইমারি, বর্তনাবাদের বিস্তীর্ণ এলাকার বাইরে থেকে কারিগর এনে তৈরি করা হচ্ছে সেল বোমা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বোমা কারবারি বলেন, ‘‘সুতলি বোমা অত্যন্ত বিপজ্জনক। যে কোনও সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আবার গন্ডগোলের সময় শত্রুপক্ষের দিকে ছুড়ে মারলে না-ও ফাটতে পারে। সকেট বোমা বিশ্বাসযোগ্য হলেও, নির্ভরযোগ্য নয়। দাম একটু বেশি হলেও এই দুই বোমার চাইতে কয়েক গুণ বেশি কাজের সেল বোমা।’’
ডোমকলে নাকি এই বিশেষ বোমা তৈরি করতে জানেন জনা তিনেক স্থানীয় বাসিন্দা। বেশ কয়েক জনকে ঝাড়খণ্ড এবং উত্তরপ্রদেশ থেকে আনা হয়েছে। ওই কারবারির কথায়, ‘‘এলাকার ছেলেরা কাজ শিখে গেলে আগামী বছর এই সমস্যা হবে না।’’ সুতলি বোমা এক একটি ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয় ডোমকলে। সকেট বোমার দাম ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। তবে সেল বোমার দাম শুরুই হয়েছে ১২০০ টাকা থেকে।
ডোমকল বিডিও অফিস মোড়ে এক হার্ডঅয়্যার দোকানদার জানালেন, কলের পাইপ বিক্রির জন্য এটা ‘অফ সিজ়ন’। কিন্তু ছাঁট পাইপ বা ছোট পাইপের বিক্রিবাটা এখন বেশি। আরও একটা ব্যাপার হল, পাইপের সঙ্গে কল সারানোর আনুষাঙ্গিক কিছুই নিচ্ছেন না ক্রেতারা। শুধু স্টপ কক আর পাইপ কিনেই চলে যাচ্ছেন। অন্য দিকে, আড়াই ইঞ্চির পাইপের বিক্রি এমন হয়েছে যে বরাত দিয়ে আনাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। পাইপের বিক্রি বাড়লেও কর্মহীন ভাবে বেকার দিন কাটছে কলমিস্ত্রিদের। ডোমকলের কলমিস্ত্রি আজ়গর মণ্ডলের কথায়, ‘‘হার্ডঅয়্যারের দোকানে কাজের বরাতের জন্য বসে থাকি। চোখের সামনেই দেখি কত পাইপ বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু কেউ কাজের কথা বলছেন না। জিজ্ঞাসা করলেই বলছে, ‘মিস্ত্রি আছে’। কিন্তু কোনও মিস্ত্রিরই কাজ নেই!’’
ডোমকল মহকুমা পুলিশ আধিকারিক শুভম বাজাজ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ এখনও পাইনি। তবে পুলিশি নজরদারি চলছে। এই রকমের রেকর্ড আছে। অতি স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতে এই রকমের কর্মকাণ্ড নিয়ে বাড়তি নজরদারি চালানো হবে।’’