রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে জারি তেল-যন্ত্রণা! দাম কমেনি, আশঙ্কা বৃদ্ধির

সম্প্রতি বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেল ব্যারেল পিছু ৯০ ডলারের নীচে নেমে গিয়েছিল। দেশের মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে হা-পিত্যেশ করে বসেছিলেন দাম কমার আশায়। অশোধিত তেল অতটা নীচে নামার পরে অনেকের মনে আশা জেগেছিল, এ বার যদি দাম কমে। বিশেষত বছর শেষে যেখানে গুজরাত, হিমাচল প্রদেশে ভোট। কিন্তু জ্বালানির দর এখনও পর্যন্ত মাথা নামায়নি। উল্টে এরই মধ্যে অশোধিত তেল ফের ১০০ ছুঁইছুঁই। ফলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, অদূর ভবিষ্যতে কি তবে তেল-গ্যাসের দাম কমার কোনও সম্ভাবনাই নেই। জ্বালানির চড়া দাম যে ভারতীয় অর্থনীতির কোমর ভেঙে দিচ্ছে, সে কথা অস্বীকার করছে না কেন্দ্রও। খোদ বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মেনে নিয়েছেন সে কথা।

কলকাতায় আইওসি-র পাম্পে বহু দিন ধরে পেট্রল লিটার পিছু ১০৬.০৩ টাকা, ডিজ়েল ৯২.৭৬ টাকাতেই থমকে। রান্নার গ্যাসের একটি সিলিন্ডার ১০৭৯ টাকা।

একই সঙ্গে তেলের দাম কমানোর পথে বাধা তলানিতে ঠেকা টাকা। সোমবারও রেকর্ড নীচে ছিল ভারতীয় মুদ্রার দাম। এক ডলার ১০ পয়সা উঠে এই প্রথম হয় ৮২.৪০ টাকা। ফলে তেল-গ্যাস আমদানির খরচ বাড়ছে লাফিয়ে। জ্বালানি, খাদ্যপণ্য এবং অন্যান্য অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর চড়া দামে নাভিশ্বাস আমজনতার। সকলেরই আশঙ্কা, পেট্রল, ডিজ়েল, রান্নার গ্যাস কি তবে এত টাকাই থাকবে? নাকি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘোরালো হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়বে দাম? তা মূল্যবৃদ্ধিকে আরও ঠেলে তুলবে কি না, রয়েছে সেই প্রশ্নও।

দুশ্চিন্তার জ্বালানি

• ইউক্রেনে রুশ হামলার জেরে ঘোর অনিশ্চয়তায় বিশ্ব অর্থনীতি। সঙ্গে টান তেল-গ্যাসের জোগানে।

• পশ্চিমী দুনিয়াকে জ্বালানি জোগানো কমিয়েছে রাশিয়া। তা সত্ত্বেও বিশ্ব বাজারে চাহিদা কমায় মাঝে অশোধিত তেলের দর নেমে গিয়েছিল ব্যারেলে ৮৮ ডলারে।

• কিন্তু ওই দাম কমে যাওয়া রুখতে সরবরাহ ছাঁটাইকে অস্ত্র করছে ওপেক। ফলে অশোধিত তেল ফের ১০০ ডলারের পথে।

• তার উপরে টাকার দর তলানিতে। এক ডলার পৌঁছেছে রেকর্ড ৮২.৪০ টাকায়। অশোধিত তেল আমদানির খরচ তাই কমছে না।

• আগামী দিনে তাই তেল-গ্যাসের মতো জ্বালানির দর চড়াই থাকবে কি না, সেই আশঙ্কা থাকছেই।

• দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার এমনিতেই বেশি। তার উপরে জ্বালানির দর আরও বাড়লে, লাগামছাড়া হতে পারে খাদ্যপণ্য-সহ বিভিন্ন জিনিসের দাম।

বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, রাশিয়া যেমন জোগানে কাটছাঁট করছে, তেমনই বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার দরুন অনেক জায়গায় কমছে তেলের চাহিদা। ফলে বিশ্ব বাজারে কমেছে তার দাম। সম্প্রতি এক সময় তা ৮৮ ডলারে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু তাতেও দাম কমার সুবিধা পাননি এ দেশের মানুষ। কারণ তড়িঘড়ি সেই দামকে ফের বাড়ানোর জন্য রফতানিকারী দেশগুলির সংগঠন ওপেক দৈনিক ২০ লক্ষ ব্যারেল জোগান কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে ৯০ ডলারের নীচে নেমে যাওয়া ব্রেন্ট ক্রুড এর মধ্যেই আবার ৯৮ ডলার পেরিয়ে গিয়েছে। যা ভারতের জন্য খারাপ খবর। এ বার ইউক্রেনে রাশিয়ার ক্ষেপনাস্ত্র হামলা সেই দরকে আরও উঁচুতে ঠেলে দেবে কি না, সেই জল্পনা বিশ্ব জুড়ে। কারণ, গত ফেব্রুয়ারিতে যখন রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল, তখন জোগান কমার আশঙ্কায় এক ধাক্কায় ১৪০ ডলারের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল ব্রেন্ট।

অশোধিত তেলের দাম কমলে ভারতের মতো আমদানিকারীদের খরচ কমে, বাড়লে চড়তে থাকে বিল। বিশ্ব বাজারে আর্থিক মন্দার আশঙ্কায় সম্প্রতি চাহিদা কমতে থাকে জ্বালানির। ফলে কমে যায় দাম। বিরোধীদের দাবি ছিল, দেশেও পেট্রল, ডিজ়েল, রান্নার গ্যাসে আমজনতাকে সুরাহা দেওয়া হোক। কিন্তু কেন্দ্র এবং তেল সংস্থা সূত্র জানায়, একে তো ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম তলিয়ে যাওয়ায় আমদানির খরচ সেই অনুপাতে কমেনি। তার উপর দীর্ঘ দিন ধরে চড়া দরে তেল আমদানি করলেও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানতে দেশে জ্বালানিকে বাড়তে দেওয়া হয়নি। তা কয়েক মাস যাবৎ এক জায়গায় স্থির। ফলে সেই লোকসানও পুষিয়ে নেওয়া জরুরি।

তবু ক্রেতাদের একাংশের মনে তেলের দাম কমার আশা তৈরি হয় দেশের কিছু রাজ্যে আসন্ন ভোটে চোখ রেখে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, ইউক্রেনে নতুন করে রুশ হামলা বিশ্ব অর্থনীতিকে ফের অনিশ্চিত করে তুলবে। টান পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে জ্বালানির সরবরাহে। ফলে অশোধিত তেল ফের ১০০ ডলার ছাড়িয়ে গেলে দেশে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, সেই অনিশ্চয়তা থাকছেই। বিশেষত চড়া জ্বালানির কারণেই যেহেতু পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার মাথা তুলেছে। মূল্যবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ইতিমধ্যেই বিপুল হারে সুদের হার বাড়িয়েছে ভারত-সহ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো দেশে সুদ বৃদ্ধির জেরে বিশ্ব বাজারে মন্দার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তেলের দাম আরও বাড়লে আমজনতার দুর্ভোগ বাড়বে বলেই আশঙ্কা করছেন সকলে।

দেশবাসীর একাংশের অভিযোগ, বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দর মাথা তুললে দেশে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে জ্বালানি। উল্টোটা হলে তত দ্রুত সুবিধা পান না তাঁরা। এ বারও সম্ভবত সেই সুবিধা হাতছাড়া হল বলেই আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট সব মহলের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.