বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার স্বপ্নে ধাক্কা! ভারতের হয়ে খেলতে পারবেন না ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা, কেন?

বাংলাদেশের হয়ে হামজা চৌধুরির কাঙ্ক্ষিত অভিষেক হয়ে গিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে সবুজ জার্সিতে খেলে ফেলেছেন গত মাসেই। হামজার অভিষেক নিয়ে বাংলাদেশে তো বটেই, ভারতেও হয়েছিল বিস্তর চর্চা। তখন থেকেই প্রশ্ন উঠছে, ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-২১ দলে খেলা হামজা যদি সিনিয়র পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন, তা হলে যে সব ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা বিদেশের লিগগুলিতে খেলছেন, তাঁরা কেন ভারতের হয়ে খেলতে পারবেন না? বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলার যে স্বপ্ন বহু বছর, বহু যুগ আগে থেকে দেখা হচ্ছে, তা সফল হবে কবে?

এক দেশে জন্ম হলেও অন্য দেশের হয়ে ফুটবল খেলার উদাহরণ রয়েছে বহু। দিয়েগো কোস্তা (ব্রাজিল জন্ম, স্পেনের হয়ে খেলেছেন), লুকাস পোদোলোস্কি (পোল্যান্ডে জন্ম, খেলেছেন জার্মানির হয়ে), রাহিম স্টার্লিং (জামাইকায় জন্ম, খেলেন ইংল্যান্ডের হয়ে), গঞ্জালো হিগুয়াইন (ফ্রান্সে জন্ম, খেলেছেন আর্জেন্টিনার হয়ে), পেপে (ব্রাজিলে জন্ম, খেলেছেন পর্তুগালের হয়ে)— তালিকা শেষ হওয়ার নয়। ক্রিকেটেও উদাহরণ রয়েছে। জফ্রা আর্চারের জন্ম বার্বাডোজ়ে হলেও খেলেন ইংল্যান্ডের হয়ে। কেভিন পিটারসেন, অইন মর্গ্যান, বেন স্টোকস, ঈশ সোধি, রাচিন রবীন্দ্র, কেশব মহারাজ, তেজা নিদামানুরু— এঁদের সকলেরই অন্য দেশে জন্ম। খেলেছেন অন্য দেশের হয়ে।

নিয়ম নিয়ে সমস্যা

ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা (পারসন্স অফ ইন্ডিয়ান অরিজিন বা পিআইও) চাইলেও ভারতের হয়ে খেলতে পারবেন না। নেপথ্যে ভারতের নিয়ম। পিআইও-রা হলেন এমন ব্যক্তি, যাঁদের কোনও সময় ভারতের পাসপোর্ট ছিল, বা যাঁদের বাবা-মা, ঠাকুরমা-ঠাকুরদা বা তাঁদেরও আগে কেউ ভারতে জন্মেছিলেন এবং স্থায়ী ভাবে বসবাস করেছিলেন, অথবা যাঁরা কোনও ভারতীয় নাগরিককে বিয়ে করেছেন। তার মানে এই নয় যে পিআইও-রা দ্বৈত নাগরিকত্ব পাবেন। এ দেশে আইনে কোনও ভারতীয় একই সঙ্গে নিজের দেশ ও অন্য কোনও দেশের নাগরিক হতে পারবেন না। যে সব ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা ভারতের হয়ে খেলতে চান, তাঁদের আগে অন্য দেশটির নাগরিকত্ব ছেড়ে দিতে হবে। তারা ওসিআই (ওভারসিজ়‌ সিটিজেন্স অফ ইন্ডিয়া) কার্ড পেতে পারেন, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট ভিসা এবং নির্দিষ্ট কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। তবে তাতে জাতীয় দলে খেলা সম্ভব নয়।

football

ফিফার নিয়ম কী বলছে?

ফিফা স্পষ্ট জানিয়েছে, ফুটবলারেরা কোনও দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন তখনই, যদি তাঁর কাছে সেই দেশের বৈধ পাসপোর্ট থাকে। এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি, যেটি দিয়ে ওই ব্যক্তি নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবেন। সেই পাসপোর্টে লাতিন হরফে ওই ফুটবলারের নাম, জন্মসাল, জন্মের জায়গা এবং নাগরিকত্বের উল্লেখ থাকবে।

ভারতের নিম্নগামী র‌্যাঙ্কিং

ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা এ দেশের হয়ে খেলতে চেয়েছেন, এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু ভারতের ফিফা র‌্যাঙ্কিং এতটাই নীচে যে তারা অন্য দেশটির নাগরিকত্ব ছাড়তে চাইছেন না। ইউরোপের লিগে যে সব ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা খেলেন, তাঁদের ইউরোপীয় দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে ভারতের নাগরিকত্ব নিলে, ইউরোপে ফুটবল খেলার দরজা কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ ইউরোপীয় দেশগুলিতে ‘ওয়ার্ক ভিসা’ সংক্রান্ত নিয়মের বেশ কড়াকড়ি রয়েছে। তাই জন্যই র‌্যাঙ্কিংয়ে নীচের দিকে থাকা দেশগুলির ফুটবলারেরা উঁচুর দিকে থাকা দেশগুলির ক্লাবে খেলতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে ‘ওয়ার্ক ভিসা’ পাবেনই না। এই কারণেই সুনীল ছেত্রী ইংরেজ ক্লাব কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও সই করতে পারেননি। স্কটিশ লিগে খেলা ভারতীয় বংশোদ্ভূত খেলোয়াড় ইয়ান ধান্ডা এক বার সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, “পাসপোর্ট ছেড়ে দিলে আমি কোনও দিন ব্রিটেনের পেশাদার লিগে খেলতে পারব না। কারণ ভারতের ফিফা র‌্যাঙ্কিং অনেক নীচে।” ভারতের হয়ে খেলার জন্য সম্প্রতি কোচ মানোলো মার্কেজ়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন ধান্ডা। তবে এ দেশের নিয়মের বেড়াজালে আটকে গিয়ে খেলতে পারছেন না।

football

সরকারের কঠোর নীতি

ভারতীয় বংশোদ্ভূত অনেক খেলোয়াড় ইউরোপের লিগে খেলছেন। তাঁরা ভারতের হয়ে খেলতে পারলে দ্রুত এ দেশের ফুটবলের উন্নতি হবে। কে বলতে পারে, হয়তো এক দিন বিশ্বকাপে খেলার দরজাও খুলে যাবে! তবে অনেকে এটাও বিশ্বাস করেন, পিআইও ফুটবলারদের সুযোগ দিলে ভারত থেকে ফুটবলার উঠে আসার প্রক্রিয়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। ২০০৮ সালে কেন্দ্রীয় ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রক একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, আন্তর্জাতিক মঞ্চে কেবলমাত্র ভারতীয় নাগরিকেরাই ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন ওসিআই কার্ড থাকা ক্রীড়াবিদ কর্ম কুমার। তবে আদালত স্পষ্ট জানিয়েছিল, ভারত সরকারের নিয়ম অনুযায়ী কোনও ব্যক্তির দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকতে পারে না। তাই অন্য দেশের পাসপোর্ট থাকা কেউই ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না।

football

ফেডারেশনের অবস্থান কী?

সম্প্রতি সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্থার (এআইএফএফ) সভাপতি কল্যাণ চৌবে জানিয়েছিলেন, পিআইও-রা যাতে ভারতের হয়ে খেলতে পারেন তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন। তার আগে যথেষ্ট তথ্য দরকার তাঁদের। কেন পিআইও-দের ভারতের হয়ে খেলতে দেওয়া উচিত, সেটা বোঝাতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। তবে বিষয়টা এত সহজ নয় বলে মনে করেন এআইএফএফ-এর প্রাক্তন সহ-সভাপতি সুব্রত দত্ত। একটি ওয়েবসাইটে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “২০১১ সালে আমরা মাইকেল চোপড়াকে (তৎকালীন ইংল্যান্ডের ফুটবলার) আনার চেষ্টা করেছিলাম। সম্ভব হয়নি। কারণ ও ব্রিটেনের পাসপোর্ট ছাড়তে রাজি হয়নি। প্রাক্তন সভাপতি প্রফুল্ল পটেল কথাও বলেছিলেন বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে। তবু সেই আবেদন খারিজ হয়ে যায়। পিআইও-দের এ দেশের হয়ে খেলতে দিলে শুধু ফুটবল নয়, বাকি খেলাগুলোও উপকৃত হত।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.