মোহনবাগান ১ (কামিংস)
মুম্বই সিটি ৩ (দিয়াস, বিপিন, ইয়াকুব)
ত্রিমুকুট জয়ের স্বপ্ন অধরাই থাকল মোহনবাগানের। ২৩ বছর পর যে সুযোগ এসেছিল সবুজ-মেরুনের কাছে, তা তারা কাজে লাগাতে পারল না। ডুরান্ড কাপ, আইএসএল লিগ-শিল্ডেই সন্তুষ্ট থাকতে হল তাদের। আইএসএলের ফাইনালে বদলা নিল মুম্বই সিটি এফসি। মোহনবাগান হারল ১-৩ ব্যবধানে। প্রথমার্ধে জেসন কামিংসের গোলে এগিয়ে গিয়েছিল মোহনবাগান। দ্বিতীয়ার্ধে মুম্বইয়ের হয়ে সমতা ফেরান হর্হে পেরেরা দিয়াস। দ্বিতীয় গোল করেন বিপিন সিংহ। সংযুক্তি সময়ে তৃতীয় গোল ইয়াকুব ভোজটাসের। এই নিয়ে দু’বার মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ফাইনালে গোল করলেন বিপিন। ২০২১ সালেও গোল করেছিলেন তিনি।
হারলেও এই ম্যাচে মোহনবাগানের অভিযোগ করার কিছুই নেই। অতি বড় মোহনবাগান সমর্থকও এটা বিশ্বাস করবেন, এ দিন যোগ্য দল হিসাবে জিতেছে মুম্বই। দুই অর্ধেই তাদের দাপট ছিল। ম্যাচের বেশির ভাগ সময়ে বল নিয়ন্ত্রণ করেছে তারাই। নিখুঁত পরিকল্পনামাফিক ফুটবল খেলেছে। এক দিকে যেমন একের পর এক আক্রমণ শাণিয়েছে শুভাশিস বসুর দিক থেকে, তেমনই অকেজো করে দেওয়া হয়েছে জনি কাউকোকে। খেলতে পারেননি দিমিত্রি পেত্রাতোস বা লিস্টন কোলাসোরাও। লিগ-শিল্ডের ম্যাচে যে খেলা মোহনবাগান খেলেছিল, তার ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না এ দিন। মুম্বইয়ের কোচ পিটার ক্রাতকি আগের দিনই জানিয়েছিলেন, ফাইনালে অন্য মুম্বইকে দেখতে পাওয়া যাবে। সেটাই হল।
শনিবার খেলা শুরু হয় বেশ ধীরগতিতে। প্রথম দশ মিনিট শুধু পাস এবং মিস পাসের খেলা। দুই দলই চাইছিল মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ নিতে। কিন্তু সফল হচ্ছিল না কেউই। মুম্বইয়ের আক্রমণ তার মধ্যে কিছুটা বেশিই ছিল। মোহনবাগানের খেলোয়াড়েরা বেশি ক্ষণ পায়ে বল রাখতে পারছিলেন না। ধরে রাখতে গেলেই মুম্বইয়ের কোনও না কোনও খেলোয়াড় এসে তা ছিনিয়ে নিচ্ছিলেন।
শুরু থেকেই মুম্বইয়ের খেলোয়াড়দের প্রচুর দৌড়তে দেখা গেল। কেউ বল হারালে দাঁড়িয়ে পড়েননি। ছুটে গিয়ে বল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। মোহনবাগানের ফুটবলারদের পায়ে বল থাকলেও কেড়ে নেওয়ার জন্য একই রকম প্রচেষ্টা দেখা যায়। ১৩ মিনিটের মাথায় একটা ভাল আক্রমণ করেছিলেন অনিরুদ্ধ থাপা। তিরির সৌজন্যে বেঁচে যায় মুম্বই। দু’মিনিট পরেই লালিয়ানজুয়ালা ছাংতের কর্নার থেকে মেহতাব সিংহের হেড বাইরে যায়।
প্রথমার্ধে খেলা এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে মুম্বইয়ের আক্রমণও বাড়ছিল। মোহনবাগানের অর্ধে মুহুর্মুহু আক্রমণ তুলে আনছিল তারা। শুভাশিসের দিক থেকে খেলছিলেন ছাংতে। মুম্বইয়ের খেলোয়াড়কে আটকাতে গিয়ে উপরে উঠতে পারছিলেন না শুভাশিস। ফলে লিস্টন কোলাসোর উদ্দেশে বল বাড়ানোরও কেউ ছিল না। বলের খোঁজে লিস্টনকে নীচে নেমে আসতে হচ্ছিল।
মোহনবাগান রক্ষণকে বার বার বিপদে ফেলছিলেন ছাংতে। প্রথম দিকে তাঁর সেট-পিস মোটেই ভাল হচ্ছিল না। দু’টি কর্নার এবং একটি ফ্রিকিক নষ্ট করেন তিনি। তবে ৩০ মিনিটের মাথায় তাঁর ফ্রিকিক বারে লাগে। বাঁ দিক থেকে নেওয়া শট বিশাল কাইথকে পরাস্ত করে ফেলেছিল। তবে বারে লেগে ফিরে আসায় সে যাত্রায় বেঁচে যায় মোহনবাগান। পরের মুহূর্তেই একটি কর্নার থেকে আক্রমণ বাঁচিয়ে দেন বিশাল। মাঝে এক বার হেক্টর ইয়ুস্তের হাতে বল লাগলেও রেফারি পেনাল্টি দেননি। রিপ্লে দেখে ধারাভাষ্যকারেরাও বললেন, সেটি নিশ্চিত পেনাল্টি ছিল।
৩৯ মিনিটে আবার বেঁচে যায় সবুজ-মেরুন। এ বার বাঁ দিকে বল পেয়ে উঠে গিয়েছিলেন বিক্রম প্রতাপ সিংহ। মোহনবাগানের বক্সে তখন শুধু ছাংতে এবং শুভাশিস। মোহন-অধিনায়ককে এড়িয়ে শট নিয়েছিলেন ছাংতে। দুর্বল শট হলেও তা বিশালের হাত এড়িয়ে পোস্টে লাগে।
এর পর যে খেলা ঘুরে যাবে তা অনেকেই বোঝেননি। ৪২ মিনিটে মোহনবাগানের প্রথম ভাল আক্রমণ দেখতে পাওয়া যায়। অনিরুদ্ধের থেকে পাস পেয়ে বাঁ দিক উঠে গিয়েছিলেন লিস্টন। তবে শট বাঁচিয়ে দেন ফুর্বা লাচেনপা। পরের মিনিটেই এগিয়ে যায় মোহনবাগান।
ওড়িশার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় পর্বে যে গোল দেখা গিয়েছিল, শনিবার ঠিক তারই ‘রিপিট টেলিকাস্ট’। লিস্টনের থেকে বল পেয়ে বক্সের বাইরে থেকে শট নিয়েছিলেন দিমিত্রি পেত্রাতোস। লাচেনপা সেই শট ফিস্ট করতে চেয়েও পারেননি। বল গিয়ে পড়ে সামনে থাকা কামিংসের পায়ে। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপার গোল করতে ভুল করেননি। একটা গোল পেয়েই জেগে ওঠে মোহনবাগানের আত্মবিশ্বাস। প্রথমার্ধের বাকি সময়ে দাপট দেখায় তারাই।
দ্বিতীয়ার্ধেও খেলায় দাপট দেখিয়ে শুরু করে মোহনবাগান। দু’বার লিস্টন আক্রমণে গিয়েও সাফল্য পাননি। ৫২ মিনিটে সমতা ফেরায় মুম্বই। মাঝমাঠ থেকে বক্সে থাকা দিয়াসের উদ্দেশে লম্বা পাস বাড়িয়েছিলেন অ্যালবার্তো নগুয়েরা। ঘাড়ে মনবীর সিংহকে নিয়েই গোল করেন দিয়াস। তার পরেই মোহনবাগানের গ্যালারির দিকে গিয়ে চলে স্টেনগান উচ্ছ্বাস। বোঝাই গিয়েছে, আগের দিন মোহনবাগানের বিদ্রুপের জবাব দিয়েছেন তিনি।
গোলের পরেও বজায় ছিল মুম্বইয়ের আক্রমণ। ৬১ মিনিটে পর পর দু’টি সুযোগ নষ্ট করে তারা। বক্সের মাঝে জয়েশ রানেকে পাস দিয়েছিলেন ছাংতে। তবে জয়েশের শট বাইরে যায়। তার পরেই মোহনবাগানের বক্সের ডান দিকে ছাংতে পাস দেন। সেখান থেকে রাহুল ভেকের শট অল্পের জন্য বাইরে যায়।
প্রথমার্ধের মতোই মুম্বইয়ের দাপট চলতে থাকে দ্বিতীয়ার্ধেও। দিয়াস চোট পেয়ে উঠে যাওয়ার পর নামেন বিপিন সিংহ। তিনিই মুম্বইয়ের দ্বিতীয় গোলটি করেন। ডান দিক থেকে বিক্রমের পাস পেয়ে ছাংতে শট নিলেও বাঁচিয়ে দেন ইয়ুস্তে। সেই বল যায় ইয়াকুব ভোজটাসের পাসে। তিনি বক্সে ফাঁকায় থাকা বিপিনকে পাস দেন। প্রথম প্রচেষ্টায় বিপিন মিস্ করলেও দ্বিতীয় বার আর ভুলে করেননি। বল বিশালের পায়ে লেগে জালে জড়িয়ে যায়।
ম্যাচের বাকি সময়ে মোহনবাগানের খেলা অবাক করার মতোই। সংযুক্তি সময় ধরে প্রায় ১৫ মিনিট পেয়েও মনে রাখার মতো কোনও আক্রমণই দেখা গেল না। সংযুক্তি সময়ে আরও একটি গোল করে মুম্বই। এর পিছনে মোহনবাগানের ডিফেন্ডারদেরই দোষ রয়েছে। ইয়াকুব পাস দিয়েছিলেন বিক্রমকে। তিনি পাস দেন বিপিনকে। বিপিনের শট কোনও মতে শুভাশিস বাঁচিয়ে দিলেও সামনে থাকা ভোজটাস গোল করে যান। ঠিক তার আগেই একটি সহজ সুযোগ নষ্ট করে মুম্বই। বিপিন এবং ছাংতে যুগলবন্দির সামনে একা ছিলেন বিশাল। কিন্তু মুম্বই ফুটবলারদের ভুল পাসের কারণে গোল হয়নি। সব ঠিকঠাক থাকলে তিন নয়, মোহনবাগানের হারার কথা অন্তত পাঁচ গোলে।