দীপাবলি বিশ্বমানবকে তাঁর সাংস্কৃতিক নিরন্তরতা অন্বেষণের আহ্বান জানায়

দীপজ্যোতিঃ পরব্রক্ষ্ম দীপজ্যোতির্জনার্দনঃ।
দীপো হরতু মে পাপং দীপজ্যোতির্নমোস্তুতে।।

যে কোনো শুভ অনুষ্ঠান শুরুর আগে দীপ প্রজ্জ্বলনের এই মন্ত্রের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। আলো তথা আগুনকে পরব্রক্ষ্ম, জগতের পালনকর্তা, পাপনাশক হিসেবে প্রণাম করে প্রার্থনা করা হয়। আলো যে শক্তির এক প্রকার, বিজ্ঞানের সামান্যতম জ্ঞান থাকলেই সে সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়ে যায়। হাজার হাজার বছরের ভারতের সনাতন সংস্কৃতিতে আলো তথা আলোর উৎস অগ্নির উপাসনা ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে।যে কোনো মঙ্গল অনুষ্ঠানে অগ্নি প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে উদযাপন করার রীতি সনাতন ধর্মের বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে। হিন্দুদের ষোড়শ সংস্কারের প্রতিটির সঙ্গেই যজ্ঞাগ্নির গুরুত্ব বলাই বাহুল্য।
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম রাবণ বধের মাধ্যমে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে অযোধ্যায় ফিরে এলে অযোধ্যাবাসী সেই শুভক্ষণকে স্মরণীয় করেছিলেন অসংখ্য দীপের আলো দিয়ে। শ্রীরামের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনকে স্মরণ করে সনাতনী সমাজ ‘দীপাবলি’ পালন করে।
ভারতের জ্ঞানপরম্পরার কেন্দ্র বেদ আর বেদের প্রথম সূক্তই অগ্নির উদ্দেশ্যে।ইন্দ্রের পরেই ঋকবেদের বেশিরভাগ সূক্তের দেবতা অগ্নি।মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণ বুঝেছিলেন প্রাণের সৃষ্টি, ব্রক্ষ্মান্ডের উৎপত্তি ও সঞ্চালনের পেছনে আছে অগ্নির তাপ, আলো।
‘অগ্নি’র বিভিন্নরূপকে ভারত চিহ্নিত করেছে।কোথাও সূর্য অগ্নির সমার্থক আর সূর্য পৃথিবীর ভরণ পোষণ করছে , সেই কারণেই ভারত সূর্যের উপাসক।জ্ঞানকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া ভারত জ্ঞানের আলোকে পূজা করেছে , সমস্ত ভেদসৃষ্টির মূলে যে অজ্ঞানতা তা দূর করে মুক্তির প্রার্থনা করেছে উপনিষদের ঋষিগণ — ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’ । জ্ঞানের জ্যোতিকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়াই ভারতের সাধনা।
অগ্নি যেমন প্রাণশক্তির উৎস, তেমনি শক্তি কে মুক্ত করতেও অগ্নির প্রয়োজন।খাদ্যে আবদ্ধ সৌরশক্তিকে মুক্ত করতে প্রয়োজন জঠরাগ্নি, কোষে কোষে প্রাণবায়ুর উপস্থিতিতে শক্তিকে ব্যবহারযোগ্য করার প্রক্রিয়ার নাম শ্বসন।অগ্নির জন্যই চেতনার প্রকাশ সম্ভব হয় বা বলা ভালো আলো, চেতনার এক রূপ। দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সমস্ত কিছুকে সেই একই চেতনার অংশ হিসেবে জেনেছে ভারত আর এই জানাকেই পরাবিদ্যা বলা হয়েছে।অগ্নি তথা আলোর উপাসনা আর জ্ঞানচর্চা আধ্যাত্মিকতা ও শিক্ষার দুই প্রান্ত এবং সম্পর্কযুক্ত।যেখানে অগ্নির উপাসনা আছে সেখানে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব আছে।
প্রাচীন রোম, পারস্যে আগুনের উপাসনার অস্তিত্ব ছিল। এমনকি খ্রীষ্টিয় মতেও আগুনের পবিত্রতা স্বীকার করা হয়েছে।পাশবিকতার এক গভীর দুর্যোগে পারস্য সভ্যতা যখন লন্ডভন্ড, সেই সভ্যতার প্রতীকস্বরূপ পবিত্র আগুন নিয়ে তারা ভারতেই আশ্রয় নিয়েছিল– সেও একরকম ঘরে ফেরা, সভ্যতার জননীর কোলে নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া।সেকথা গর্ব করে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে ।বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অলিম্পিকেও আগুনের শিখা প্রতিযোগিতা চলাকালীন প্রজ্জ্বলিত থাকে।বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম আলো তথা অগ্নি উপাসনার উদাহরণ ভারতেই পাওয়া যায়। হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো, কালিবাঙ্গান, লোথালের ৯০০০ বছরের পুরোনো আগুনের বেদী বৈদিক সভ্যতার প্রাচীনতা প্রমাণ করে।
বৈদিককালের যজ্ঞবেদী থেকে শুরু করে সূর্যোপাসনা, দীপাবলির মাধ্যমে ভারতবর্ষ বিভিন্নরূপে সর্বত্র বিরাজমান চেতনাকেই, পরমব্রক্ষ্মকেই পূজা করেছে।মূলতান অর্থাৎ মূলস্থান থেকে শুরু করে কাশ্মীরের মার্তন্ড মন্দিরকে বিধর্মীরা ভেঙ্গেছে আর মন্দির ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে অখন্ড ভারতের ভাঙ্গনের কাজ।
শ্রীরাম ভারতের ধর্মের বাস্তব রূপ, ব্যবহারিক প্রকাশ। শ্রীরামের মন্দিরের পুনর্নির্মাণ তাই ভারতের পুনর্গঠনের প্রতীক। ভবিষ্যতের ভারতের সাংস্কৃতিক অখন্ডতায় প্রত্যাবর্তনের সূচনা শ্রী রাম মন্দিরের ভূমিপূজন থেকেই শুরু হয়েছে।অযোধ্যায় রামলালার প্রত্যাবর্তনে দীপোৎসবকে আরো বেশি উদ‌মে পূর্ণ করেছে।
ভারত গত ১৪০০ বছরে যত সাংস্কৃতিক জমি খুইয়েছে, ততই ‘বিশ্বমানব’ খুইয়েছে তাঁর সাংস্কৃতিক নিরন্তরতা।সুদূর আজারবাইজানের বাকুতে অবস্থিত ‘অগ্নি মন্দির’ এখনো ভারতীয় সংস্কৃতির ব্যাপ্তির প্রমাণ দেয়।’দীপাবলি’ , সারা বিশ্বকে তাঁর নাড়ির সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায় যে যোগ একেশ্বরবাদের ভ্রমজালে ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এখন আলোর উৎসবকে আপন করে নেওয়ার ছবি দেখা যাচ্ছে।
ভারতে দীপাবলি জৈন ও শিখ সম্প্রদায়ের জন্য এক পবিত্র উৎসব। জৈন বিশ্বাস অনুযায়ী এই দিনেই মহাবীর নির্বাণ লাভ করেছিলেন। শিখ মতে আলো তথা আগুন পবিত্র। তাই এই দীপাবলির দিনে তারা মোঘল কারাগার থেকে ষষ্ঠ শিখ গুরু হরগোবিন্দের মুক্তিকে স্মরণ করে ‘বন্দী ছোড় দিবস’ পালন করে ঘরে ঘরে আলো জ্বালিয়ে।শ্রী রামের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন হোক বা বিধর্মীদের কারাগার থেকে শিখ গুরুর মুক্তি সবক্ষেত্রেই ভারতীয় ধর্মের বিজয়কে স্মরণ করতে সারা ভারত আলোকিত হয় দীপাবলিতে।
বিশ্বকবির কথাতেই দীপাবলিতে আমাদের প্রার্থনা হোক —
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে ॥

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.