খড়দহে গঙ্গার তীরবর্তী শিরোমণি রোডের ধারে লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির যাকে স্থানীয় মানুষ ‘সোনার মন্দির’ বলে জানেন, তার মহন্ত স্বামী নৃসিংহ রামানুজাচার্য সম্প্রতি বার্ধক্য জনিত রোগভোগের পর প্রয়াত হয়েছেন (গত ২৮ শে মে)। রামানুজ সম্প্রদায়ের এই সন্ন্যাসী মন্দির প্রতিষ্ঠাতা (১৯৪৬ সালের মে মাসে, বাংলা ২১ শে বৈশাখ প্রতিষ্ঠা) স্বামী যতীন্দ্র রামানুজাচার্যের উত্তরাধিকারী, ভ্রাতুষ্পুত্র এবং অযোধ্যার রামানুজ আখড়া থেকে দীক্ষিত। তিনি পুরীধামের আদি শঙ্করাচার্য পীঠ রোডে অবস্থিত দুই বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত ‘যতিরাজ মঠ’-এরও প্রধান ছিলেন। এই মঠ খড়দহের সোনার মন্দির ট্রাস্টেরই একটি শাখা।
খড়দহের বলরাম সেবা সদন একসময় এই মন্দির কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। এটিই খড়দহের প্রথম আধুনিক হাসপাতাল। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সময় খড়দহে আসেন। তিনি সভায় বলেন, “ইন্দু (ডাক্তার ইন্দুভূষণ বসু, স্বামী যতীন্দ্র রামানুজাচার্যের পূর্বাশ্রমের নাম) আমার চেয়েও বড় ডাক্তার।” হাসপাতালে যতী মহারাজের প্রচুর অবদান ছিল। তিনি তাঁর গুরুদেব বলরাম স্বামীর নামে এই হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন (১৯৫৭ সালের ২ রা মে)।
পরে বাহ্যিক রাজনৈতিক সমস্যার কারণে হাসপাতালের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। খড়দহের মানুষ বঞ্চিত থাকেন। দীর্ঘদিন পর এলাকার সাধারণ মানুষের দাবিতে তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে ও বর্তমানেও চালু রয়েছে। অথচ খড়হের মানুষ এই প্রসিদ্ধ মন্দির সম্পর্কে বিশেষ কোনো খোঁজ খবর রাখেন না। আধ্যাত্মিকতায় ও সম্পদে এই মন্দির খড়দহের কোনো মন্দিরের চাইতে কম নয়। বিপুল আধ্যাত্মিক গ্রন্থে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার আছে এখানে। গ্রন্থাগার ও লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির চত্বর সব মিলিয়ে প্রায় ১৪ বিঘে জমি নিয়ে অবস্থিত। কুলীনপাড়ায় বি. ডি. সোপান রোড এবং শিরোমণি রোডের মধ্যে অবস্থিত স্কুল যা ‘বলরাম শিক্ষামন্দির’ নামে পরিচিত, সেখানেও আনুমানিক ৭ বিঘা পরিমাণ জমি। শিরোমণি রোডের উপর টোলবাড়ি যেখানে একসময় সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হত, সেখানেও আনুমানিক তিন বিঘে পরিমাণ জমি। সরকারের কাছে হস্তান্তরিত বলরাম সেবাসদন-এর জমির পরিমাণও ছিল প্রায় কুড়ি বিঘা। একসময় এই মন্দিরে ২০/২৫টির মতো গাই গরু ছিল, এর দুধ নিয়মিত হাসপাতালের রোগীদের কাছে পৌঁছাতো এবং কিছুটা মন্দির সেবায় কাজে লাগতো। এক সময় এখানে একটি নিজস্ব প্রেস ছিল, তার নাম বলরাম ধর্ম সোপান প্রেস। এই প্রেস থেকেই আশ্রমের মাসিক পত্রিকা ‘উজ্জীবন’ প্রকাশিত হত।
এই আশ্রম কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব জমির উপর একটি ডাকঘর নির্মাণ করে দেয়, আজও তা রয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ যথাযথভাবে মন্দির কর্তৃপক্ষের দ্বারা যাতে বর্তমানে রক্ষিত ও পরিচালিত হয়, খড়দহ ও সারা ভারতের আধ্যাত্মিক জগতের পরিশীলিত মানুষের তা একান্ত বাসনা ও প্রার্থনা। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা নৃসিংহ মহারাজের প্রয়াণের পর এখন তার প্রকৃত রক্ষণাবেক্ষণের দিকে তাকিয়ে আছেন।
১৯৩২ সালের ২৫ শে নভেম্বর নৃসিংহ মহারাজের জন্ম হয়। অবিবাহিত এই গুণী মানুষ নানান ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন, সংস্কৃত ও তামিল ভাষাও জানতেন। এম. কম পাশ করার পর চার্টাড একাউন্টট্যান্সি নিয়ে তিনি পড়েন। একসময় কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের কন্ট্রোলার অফ ফিনান্স হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি কমার্স বিভাগের অতিথি অধ্যাপক ছিলেন। জানা যায়, স্বামী যতীন্দ্র রামানুজাচার্যের প্রয়াণের পর নৃসিংহ মহারাজ কেবলমাত্র মন্দিরের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করে গেছেন, নতুন কোনো সৃজনাত্মক কাজের দিকে যেতে পারেন নি। তবুও রামানুজ সম্প্রদায়ের কাছে তিনি অত্যন্ত সম্মানীয় সন্ন্যাসী ছিলেন। ওনার সময় পুরীর যতিরাজ মঠ এক সময় হাতের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হলে, তিনি তাঁর সহায়কদের নিয়ে তা পুনর্দখল করতে সমর্থ্য হয়েছিলেন, এটি তার এক বড় সাফল্য। সেটা আনুমানিক ১৯৯৬ সালের ঘটনা। এখানে শ্রীদেবী ভূদেবীসহ শ্রীভগবান রঙ্গনাথজী বিগ্রহের অবস্থান। বহু মানুষ এই মন্দির দর্শন করতে যান।
নৃসিংহ মহারাজের প্রয়াণের খবর পৌঁছাতেই ভক্ত মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। করোনার কারণে দূর থেকে ভক্তরা আসতে না পারলেও তারা আপন গৃহে বসেই তাঁর শুভাত্মার স্মরণ মননে ব্রতী হয়। আনুমানিক ভোর ছটায় তার মহাপ্রয়াণ ঘটে। পানিহাটি শ্মশানে তাঁর নশ্বর দেহ দাহ করা হয়। তারপর দেহ ভস্ম সোনার মন্দির চত্বরে আনা হয়। খড়দহের এই প্রবীণ পণ্ডিত সন্ন্যাসীর প্রয়াণে আধ্যাত্মিক জগতের এক অমূল্য স্বর্ণখণ্ডকে হারালো খড়দহ। সোনার মন্দির স্বভাবতই ম্লান হল আজ।