আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় শনিবার দিনভর উত্তপ্ত রইল হাসপাতাল চত্বর। অপরাধের বিচার এবং অভিযুক্তের কঠোর শাস্তি চেয়ে সকাল থেকেই বিক্ষোভ, অবস্থান শুরু করে নানা সংগঠন। বিকেলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের একাংশকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে। যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করে কলকাতা পুলিশের ডিসি (উত্তর) অভিষেক গুপ্ত দাবি করেন, বাইরের লোকেরাই ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করেছিলেন। পুলিশ সংযত হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে।
শনিবার সন্ধ্যায় ডিসি বলেন, “বিকেলে আরজি কর হাসপাতালের ছাত্র সংগঠন শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ করছিল। সেই সময় বাইরের কিছু লোক গেটের সামনে চলে আসেন। তখন এখানকার পড়ুয়ারাই প্রতিবাদ করেন। দু’পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হলে পুলিশ হস্তক্ষেপ করে। পুলিশকে লক্ষ্য করে চটি, চপ্পল ছোড়া হয়। ধাক্কা দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ সংযত ভাবে তাঁদের চলে যেতে বলে। জানায় যে, এখানকার পড়ুয়ারা আপনাদের চাইছেন না।” ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিয়োয় দেখা যায় এক মহিলা বিক্ষোভকারীকে চুলের মুঠি ধরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এক মহিলা পুলিশকর্মী (যদিও এই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)।ডিসি যদিও মারধর সংক্রান্ত প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর না দিয়ে বলেন, “পুলিশ খুব সংযত ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে। পুলিশ দমনমূলক কোনও পদক্ষেপ করেনি।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “জানি না ওঁরা কোথা থেকে এসেছিলেন। তবে পড়ুয়া বলে মনে হয় না।”
আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে অবস্থানরত জুনিয়র চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়াতে শনিবার বিকেলে হাসপাতালের কাছে পৌঁছন একাধিক বাম ছাত্র-যুব সংগঠনের সদস্যেরা। স্টুডেন্টস হেল্থ হোমের চিকিৎসকেরাও ওই একই সময়ে পৌঁছে যান আরজি করের সামনে। তাঁদের মধ্যে আরজি করের প্রাক্তনীরাও ছিলেন। তাঁরা ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করতেই শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে একপ্রস্ত ‘খণ্ডযুদ্ধ’। পুলিশ তাঁদের বাধা দিতেই শুরু হয় ধস্তাধস্তি। চলে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা। ‘বহিরাগত’ আন্দোলনকারীদের আরজি করের ভিতরে প্রবেশ আটকাতে দীর্ঘ ক্ষণ সমর্থ হন পুলিশকর্মীরা। পরে ফের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা শুরু হয়। বেশ কয়েক জন ‘বহিরাগত’ আন্দোলনকারীকে আটক করে আরজি করের ভিতরে নিয়ে যান পুলিশকর্মীরা।
পুলিশ যখন ব্যারিকেড করে ‘বহিরাগত’দের আটকানোর চেষ্টা করে, তখন আরজি করের ভিতর থেকেও অবস্থানরত চিকিৎসক-পড়ুয়াদের একাংশ এগিয়ে আসেন। ‘বহিরাগত’দের প্রবেশে আপত্তি জানান তাঁরা। আরজি করের জুনিয়র চিকিৎসকদের বক্তব্য, তাঁরা এই আন্দোলনে কোনও রাজনীতির রং লাগতে দেবেন না। যদি কেউ আন্দোলনে শামিল হতে চান, সে ক্ষেত্রে রাজনীতির রং নিয়ে নয়, সাধারণ নাগরিক হিসাবে যেন শামিল হন আন্দোলনে। বাম ছাত্র-যুব সংগঠনের বিরুদ্ধে স্লোগানও ভেসে আসে আরজি করের ভিতর থেকে।
‘বহিরাগত’ বিক্ষোভকারীদের অবশ্য দাবি, এই আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে রাজ্যের শাসক শিবির। পুলিশ ‘বহিরাগত’ বিক্ষোভকারীদের আরজি করের বাইরে থামিয়ে রাখতে সমর্থ হলেও প্রথমে জমি ছাড়তে নারাজ ছিলেন বিক্ষোভকারীরাও। হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশ করতে না দেওয়া পর্যন্ত পিছু হটবেন না বলে একটা সময় পর্যন্ত তাঁরা অনড় ছিলেন। পরে অবশ্য আরজি করের সামনে থেকে বিক্ষোভকারীদের ভিড় পাতলা হতে থাকে। সাদা পোশাকের পুলিশের দখলে চলে যায় গোটা এলাকা।
আরজি করের বাইরে যখন ধুন্ধুমার পরিস্থিতি, তখনই সেখানে পৌঁছে যান সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগে বিচারের দাবিতে আরজি করের বাইরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন সিপিএম কর্মী-সমর্থকেরা। সেলিমের অভিযোগ, বিষয়টিকে প্রথমে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আরজি করের অধ্যক্ষকে কাঠগড়ায় তুলে তাঁর অপসারণের দাবি তোলেন তিনি। আন্দোলনকে দমানোর চেষ্টার জন্য নাম না করে শাসকদলের কিছু ‘দালাল’কে নিশানা করেন সেলিম। বলেন, “এই অপরাধে তৃণমূল যুক্ত, পুলিশ যুক্ত। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না।”
আরজি করের ঘটনায় ইতিমধ্যেই এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, অভিযুক্তের ফাঁসির সাজা চাওয়া হবে। মৃতার পরিবার চাইলে সিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করালেও তাঁর কোনও আপত্তি নেই বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েল জানিয়েছেন, আরজি করের ঘটনা এক ‘ঘৃণ্য অপরাধ’। অভিযুক্তকে ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের অপরাধী’ বলেও মন্তব্য করেন পুলিশ কমিশনার।