অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস (On the Origin of Species) ১৮৫৯ সালের ২৪ শে নভেম্বর লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। লেখক চার্লস ডারউইন। বইটির পুরো নাম ছিল ” On the Origin of Species by Means of Natural Selection, or the Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life “। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় “প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির উৎপত্তি, অথবা জীবন সংগ্রামে আনুকূল্য প্রাপ্ত গোত্রের সংরক্ষণ “।
মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রথম সংস্করণের ১ হাজার ২৫০টি বই বিক্রি হয়ে যায়। প্রচণ্ড বিতর্কের ঝড় ওঠে এ বইটিক ঘিরে। কোনো বইকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা এর আগে দেখা যায়নি। কিছুদিনের মধ্যে বইটি সমগ্র ইউরোপ তথা পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত হয়ে মানুষের চিন্তা জগতে তুমুল এক আলোড়ন তৈরি করে।পৃথিবীর বিজ্ঞানীমহলে সাড়া পড়ে গেল । সবার মনে এ ধারণা জন্মাল যে, পৃথিবীতে একটি নতুন বৈপ্লবিক চিন্তার অভ্যুদয় হয়েছে। কি গভীর অনুভূতির সঙ্গে লেখক তার আলোচ্য বিষয়কে বোঝাতে চেয়েছেন । পড়তে গেলে বিস্ময় জাগে এটি বিজ্ঞানের বই, না গীতিময় কোন কাব্যগ্রন্থ! সত্যি বলতে লেখকের জীবনব্যাপী গবেষণা গবেষণামাত্র ছিল না ছিল না- তা ছিল এক অনাবিষ্কৃত বিশ্বজগৎ আবিষ্কার!
১৮৭২ সালের ষষ্ঠ সংস্করণে বড় শিরোনামটি পরিবর্তন করে কেবল “দি অরিজিন অফ স্পিসিস” রাখা হয়েছিল। বইটির মাধ্যমে ডারউইন বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের সাথে “প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন” তত্ত্বের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এতে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সকল প্রজাতির উদ্ভবের পক্ষে প্রচুর প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়। ডারউইন ১৮৩০ সালে এইচ এম এস বিগ্ল জাহাজে করে বিশ্ব ভ্রমণের মাধ্যমে অর্জিত সকল অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন জীব প্রজাতির নমুনা এবং পরবর্তী গবেষণা, অন্যদের সাথে যোগাযোগ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সকল ফলাফল এই বইয়ে একত্র করেন ।
বইটি বিজ্ঞান, দর্শন ও সাধারণভাবে জীবজগতের উৎপত্তির ইতিহাস বিষয়ে পূর্বতন সকল চিন্তাধারাকে পিছনে ফেলে নতুন যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক ধারণার গোড়াপত্তন করে।কিন্তু এটা লক্ষ্যণীয় যে বইটির লেখক তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করার সময় অসম্ভব বিনয় ও পর্যবেক্ষণ লব্ধ অসাধারণ জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। কারণ ডারউইন নিজে ছিলেন অমায়িক ব্যক্তি এবং তিনি মানুষের উপর কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভার চাপিয়ে না দিয়ে তাদেরকে খুব সাধারণ ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। বইটির শুরুর বাক্য দুটি এই বিনয়ের পরিচয় দেয়-
“প্রকৃতিবিদ হিসেবে এইচ.এম.এস ‘বিগ্ল’-এ কাজ করার সময় দক্ষিণ আমেরিকায় বসবাসকারী জীবকূলের বণ্টন এবং সেখানকার বর্তমান অধিবাসীদের সাথে অতীতের অধিবাসীদের সম্পর্ক বিষয়ক কিছু তথ্য আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। আমার মনে হয়েছে, এই তথ্যগুলো প্রজাতির উৎপত্তি বিষয়ের উপর কিছু আলো ফেলতে পারে, আমাদের সেরা দার্শনিকদের একজন যে বিষয়টিকে বলেছিলেন সকল রহস্যের বড় রহস্য।”
এখানে ডারউইন যে দার্শনিকের দিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি হলেন বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ জন হার্শেল; কেমব্রিজের ছাত্র থাকার সময় তিনি হার্শেলের প্রাকৃতিক দর্শনের ভক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু হার্শেল প্রজাতির উৎপত্তিতে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব আছে মনে করতেন। বলা যায়, ডারউইন হার্শেলের রহস্যানুভূতি নিজেও অনুভব করেছেন, কিন্তু রহস্যটির যে সমাধানে উপনীত হয়েছেন তা হার্শেলের তুলনায় অনেকটাই আলাদা।
শুরুর বাক্যে দুটিতে তিনি দক্ষিণ আমেরিকার যে জীবদের উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে, আর্মাডিলো, রিয়া নামক বিশালকায় উড়তে অক্ষম পাখি, ঘোড়ার বিলুপ্ত কিছু প্রজাতি, এবং মেগাথেরিয়াম গণের অন্তর্ভুক্ত দানবীয় আকারের একটি অধুনাবিলুপ্ত স্লথের জীবাশ্ম। এর পাশাপাশি গালাপাগোস দ্বীপের প্রাণী ও উদ্ভিদ দেখে তিনি প্রথম বিবর্তনীয় তত্ত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন।
বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মতাত্ত্বিক দর্শন অনুসারে অনাদি অনন্তকাল থেকে বিরাজমান পরমেশ্বর এক আদেশবলে সৃষ্টি করেন এ জগৎ ও জীবকুল। যেমন, উপনিষদে আছে পরমেশ্বর চিন্তা করলেন ‘একেলা ন রমেত’ (আমি আর একা থাকব না), এক থেকে বহু সৃষ্টি করবো। ফলে তৎক্ষণাৎ সৃষ্টি হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। ইহুদি ও খিস্টীয় ধর্ম মতেও এ ধারণার সমর্থন রয়েছে। যেমন, স্রষ্টার ইচ্ছা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সমস্ত জগৎ সংসার। এ কাহিনী বিবৃত বাইবেলের আদি পর্বে। ওখানে বলা হয়েছে ঈশ্বরের ইচ্ছায় শূন্য থেকে প্রথমে আলোর এবং তার পর ছ’দিন ধরে ক্রমান্বয়ে গ্রহ নক্ষত্র উদ্ভিদ প্রাণী এবং সর্বশেষে আদিমানব আদমের সৃষ্টি। আদমের অস্থিপঞ্জর থেকে সৃষ্টি করা হয় ইভ । ছ’দিনে সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করে সপ্তম দিনে ঈশ্বর বিশ্রাম নেন। সেদিনের স্মরণেই খ্রিস্টানরা রবিবারে সাপ্তাহিক বিশ্রাম নেয়।
বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির অনুপস্থিতিতে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রাধান্যের ফলে মধ্যযুগে অবশ্য জগৎকে ব্যাখ্যা করা হয় স্থির নিশ্চল বলে। কিন্তু আধুনিক যুগে বিবর্তনের ধারণা আবার নতুন করে বিস্তার লাভ করে। যেমন, ডেকার্ট (১৫৯৬-১৬৫০), লাইবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬) ও কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) প্রমুখ আধুনিক দার্শনিকদের চিন্তায় বিবর্তনের ধারণা কোন না কোনোভাবে উপস্থিত ছিল। পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের মাধ্যমে প্রাণীকুল কীভাবে নিম্নতর পর্যায় থেকে ক্রমশ উচ্চতর পর্যায়ে বিবর্তিত হয়ে থাকে, এ ব্যাপারে ফরাসী প্রকৃতিবাদী দার্শনিক ল্যামার্ক (১৭৪৪-১৮২৯) বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এসব মতের সূত্র ধরেই জীব ও জগতের বিবর্তন ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন বিশিষ্ট ব্রিটিশ বিবর্তনবাদী চিন্তাবিদ চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২)।
কিন্তু আধুনিক জীববিজ্ঞান এই আকস্মিক সৃষ্টিবাদের ধারণা প্রত্যাখ্যান করে এবং এর স্থলে প্রবর্তন করে বিবর্তন বা ক্রমবিকাশের ধারণা। বিবর্তন মতে, জগৎ ও জীবনে প্রতিনিয়ত যে সব ঘটনা ঘটে সেগুলোর কোনোটিই সম্পূর্ণ নতুন নয়; প্রতিটি ঘটনাই তার পূর্ববর্তী ঘটনার ক্রমবিকাশের ফল। জগতের অগনিত জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ তথা সব জৈব ও অজৈব সত্তা এক সহজ সরল আদিম অবস্থা থেকে ক্রমবিকশিত হয়ে চলেছে বিরামহীনভাবে। এ জগৎ এক অবিরাম পরিবর্তন প্রবাহ বা স্রোতধারাস্বরূপ, আর এ গতিময় ধারায় নিয়ত বদল হচ্ছে জগৎ জীবন সমাজসহ বিশ্বের সবকিছু।
আমরা আজ যে পৃথিবীতে বসবাস করছি লক্ষ কোটি বছর আগে তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নতর। যেমন, তখন সূর্যের তাপ ছিল আজকের চেয়ে বহুগুণ বেশি প্রখর এবং পৃথিবীও ছিল অনেক বেশি উত্তপ্ত-এতই উত্তপ্ত যে তখন প্রাণীকুলের বেঁচে থাকা ছিল অসম্ভব। নক্ষত্রের তাপমাত্রা ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ায় কালক্রমে পরিবেশ ক্রমশ অনুকূল হয়ে ওঠে এবং আর্বিভাব ঘটে রকমারি রাসায়নিক পদার্থের। এ প্রক্রিয়ায়ই উপযুক্ত আবহাওয়া, বায়ু ও জলের আবির্ভাবের ফলে ক্রমশ উদ্ভব ঘটে উদ্ভিদ ও বিভিন্ন প্রাণীর।
শুরুতে মূল পদার্থিক ও রাসায়নিক উপাদানগুলো ছিল সরল কিন্তু এলোমেলো অবস্থায়। বিবর্তন প্রক্রিয়ায় আস্তে আস্তে এগুলো সুশৃঙ্খল জটিল রূপ ধারণ করতে থাকে। বিবর্তন মানে সরল থেকে যৌগিক, বিশৃঙ্খল থেকে সুশৃঙ্খল এবং অনুন্নত থেকে উন্নত অবস্থায় ক্রমিক বিকাশ বা উত্তরণ। এ বিবর্তন ধারার বিভিন্ন স্তর পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, বরং ধারাবাহিক নিরবিচ্ছিন্ন । জগতের সবকিছুই প্রবহমান ও পরিবর্তনশীল। এখানকার কোনোকিছুই সম্পূর্ণ নতুন নয়, সবই পূর্ববর্তী বস্তু ও ঘটনার ক্রমবিকাশের ফল। বিবর্তনবাদের এ বক্তব্য ব্যাপক সমর্থন ও জনপ্রিয়তা লাভ করে উনিশ শতকে।আর তখন থেকে ভাববাদের শক্তি হ্রাস পেতে থাকে।
ডারউইনের মতে, পৃথিবীর জীবজন্তু বর্তমানে যে যে অবস্থায় আছে, শুরুতে সে অবস্থায় ছিল না। এক আদিম অপরিপক্ক অবস্থা তেকে ক্রমিক ধারাবাহিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা বর্তমানের অপেক্ষাকৃত জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে। প্রকৃতি এক বিরামহীন সংগ্রামে নিয়োজিত। যারা সর্বাধিক যোগ্য তারাই এ জীবন সংগ্রামে টিকে থাকে। যারা দুর্বল এবং যারা পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অক্ষম, তাদের বিলুুপ্তি অনিবার্য। জীবনসংগ্রামে প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং সর্বাধিক যোগ্যদের টিকে থাকার মাধ্যমে জীবকোষের অভ্যন্তরে আকস্মিক পরিবর্তন বা প্রকরণের মাধ্যমে এক প্রজাতি থেকে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। তাঁর মতে, প্রথম থেকেই প্রতিটি প্রজাতিকে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। এ সংগ্রামের সময় প্রাণীদেহে অনেক পরিবর্তন সংঘঠিত হয়। প্রজাতির পক্ষে এসব পরিবর্তনের কিছু কিছু উপযোগী, আর কিছু-কিছু অনুপযোগী। উপযোগী পরিবর্তন প্রজাতিকে পরিবেশের সঙ্গে খাপখাইয়ে চলতে সাহায্য করে এবং অনুপযোগী পরিবর্তন প্রজাতিকে পরিবেশের সঙ্গে চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে। অনুপযোগী পরিবর্তনসমূহ যখন বৃদ্ধি পায়, তখন সংশ্লিষ্ট প্রজাতি বেঁচে থাকার সংগ্রাম জয়ী হয়।
বিভিন্ন প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু পৃথিবীর খাদ্যের পরিমাণ সীমিত। ফলে খাদ্যের জন্য বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে শুরু হয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এ সংগ্রামে জয়ী হয় তারাই যারা সর্বাধিক উপযুক্ত মানে যোগ্যতম। সর্বাধিক উপযুক্ত তারাই যারা পরিবেশের সঙ্গে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ।যারা অনুকূল প্রকরণ সমন্বিত। বর্তমানে যেসব প্রজাতি বেঁচে আছে, তারা এক দীর্ঘ পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। আজ যে তারা বেঁচে আছে, তার অর্থ এই যে, বেঁচে থাকার সংগ্রামে তারা নিজেদের সবার্ধিক উপযুক্ত বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এ মতবাদের মূল অর্থ এখন আমাদের কাছে পরিষ্কার। যে বিবর্তন-প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতি বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে, মানবজাতিও তার অন্তর্ভুক্ত। মানুষের মধ্যেও বেঁচে থাকার সংগ্রাম অব্যাহত এবং মানুষের বেলায়ও যোগ্যতম বা শক্তিশালীরাই সংগ্রাম জয়ী হয়। এবং এ বিবর্তন-প্রক্রিয়ায় মানুষের দৈহিক ও মানসিক প্রকৃতিতেও বিরাট পরিবর্তন ঘটে থাকে। ডারউইন এই নিশ্চিন্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বানর ও মানুষের মধ্যে যে পার্থক্য লক্ষণীয়, তার মূলেও রয়েছে সর্বজনীন বিবর্তননীতির প্রভাব। বেঁচে থাকার সংগ্রামের অভিজ্ঞতার ফলে মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধিতে এমন অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যার ফলে সে পরিবেশের প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে জয়ী হতে পেরেছে।
একটু বড়ো হয়ে গেলো। পড়লে ভালো লাগবে, এই আশায় কপি করে ভাগ্ করে নিলাম।