যে কোনও প্রতিষ্ঠান চলে তার নিজস্ব অনুশাসনে। শৃঙ্খলায়। এই অনুশাসন এবং শৃঙ্খলা যদি ভেঙে পড়ে, তবে গোটা প্রতিষ্ঠানটাই ঝুরঝুরে হয়ে যায়। ঠিক যেমনটা হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। সম্প্রতি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য পড়তে আসা এক মেধাবী কিশোর ছাত্রের মৃত্যু হয়। অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা। তবে এ কথাও লিখতে বাধ্য হচ্ছি যে, এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমনিতে যাদবপুর পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু কেন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তার কারণ খুঁজতে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে।
১৯৭০ সালের বর্ষশেষে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, স্বনামধন্য গবেষক এবং উপাচার্য গোপাল সেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নিহত হন। সেই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় তৎকালীন সময়ে উদীয়মান এক বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক ও নৈতিক অধঃপতনের কাহিনি। গোপালবাবু ছিলেন অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং ছাত্রদরদি এক অধ্যাপক। অতিবাম রাজনীতিকেই ওই শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকের ‘অপমৃত্যু’র জন্য দায়ী করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি টালমাটাল হওয়ার সুযোগে অতিবাম রাজনীতি ছাত্রমননে যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছিল, তার প্রভাব অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কেও কালিমালিপ্ত করেছিল। বাংলার ছাত্রসমাজ বহু জ্ঞানীগুণী মানুষকে হারায়। বহু মেধাবী ছাত্রের প্রাণ অকালে ঝরে গিয়েছিল। সেই শুরু।
রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রের সক্রিয়তা ও জনগণের তীব্র বাধায় অতিবাম আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার পরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে শূন্যতা তৈরি হয়, তাতে বাম রাজনীতি প্রবল ভাবে আত্মপ্রকাশ করে। বামেরা পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় আসে সত্তরের দশকের শেষের দিকে। শুরু হয় কৌশলে সাংগঠনিক দিক-সহ সর্বক্ষেত্রে দখলের রাজনীতি। এই নীতি অচিরেই বাংলার শিক্ষাজগৎকে সুকৌশলে দখল করে ফেলে। পরে আমরা দেখেছি, বাম নেতাদের মনোনীত ব্যক্তিরা কী ভাবে রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষে বসে ওই নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে ওঠাবসা করতেন! কী ভাবে সমগ্র শিক্ষাজগৎকে বাম রাজনীতির গ্রাসে নিয়ে যেতে সাহায্য করতেন!
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম রাজনীতির সরাসরি সূচনা সেই সময় থেকেই। রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ যাদবপুরের শিক্ষক, কর্মচারী ও ছাত্রসমাজের একটা বড় অংশ বাম, অতিবাম ও বাম-বিরোধী রাজনীতির প্রভাবে সরাসরি প্রভাবিত হয়ে পড়েন। অনেকে সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দেন। একই সঙ্গে অবশ্যই অনস্বীকার্য যে পঠনপাঠন, গবেষণা ও অন্যান্য শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমেই উৎকর্ষ অর্জন করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় মানের একটি উৎকর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে পরিগণিতও হয়। ২০১১ সালে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাজ্যে পরিবর্তন আসে। বাম জমানার অবসান হয়। অচিরেই বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে বামবিরোধী শক্তি আত্মপ্রকাশ করলেও যাদবপুরে বামদুর্গ অক্ষত থাকে। আড়ালে-আবডালে অতিবাম রাজনীতিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাসমাজের কিংয়দংশকে প্রভাবিত করে।
আমি প্রথম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নিই ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে। অল্প কয়েক মাসের জন্য। দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের শৃঙ্খলাব্যবস্থা একেবারেই বেহাল। গবেষণা ও পঠনপাঠনে বিশ্ববিদ্যালয় যেমন উৎকর্ষের শিখরে ছিল, তেমনই এখানকার ক্যাম্পাসে ঘটে চলা অনৈতিক, অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজকর্মে কোনও লাগাম ছিল না। আশ্চর্যের বিষয়, এই সব অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজকর্মের বিরুদ্ধে কোনও সংগঠিত ছাত্র প্রতিরোধও ছিল না। আধিকারিকেরা দেখেও দেখতেন না। নিরাপত্তারক্ষীরা উদাসীন। সর্বোপরি, প্রতিবাদ করলেও মাঠে নেমে এই সব অনৈতিক, অসামাজিক, অছাত্রসুলভ কাজকর্ম বন্ধ করার কোনও বাস্তব প্রচেষ্টা শিক্ষক সংগঠনগুলির মধ্যেও দেখিনি।
ওই সময়েই দেখেছি, সন্ধ্যা নামলে কী ভাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দুষ্কর্মের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠত। মদ, গাঁজা ও অন্যান্য নেশার সামগ্রী যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহৃত হত। পুরুষ-নারী মেলামেশার ‘অশ্লীল দৃশ্য’ও দেখা যেত। বুঝতে পারতাম, ক্যাম্পাস ঘন অন্ধকারে ডুবে গেলে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী, কর্মচারী ও শিক্ষক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন! হস্টেলে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের আনাগোনা। হস্টেলগুলিতে ছিল প্রাক্তনী ও বহিরাগতদের অবারিত দ্বার। একই সঙ্গে ছিল হস্টেলে তাঁদের থাকার ‘অনৈতিক’ অধিকার। সাড়ে তিন মাস পর আমার হাত থেকে উপাচার্যের দায়িত্ব নিলেন অন্য এক জন অধ্যাপক। তিনি ‘আইআইটি’ থেকে এসেছিলেন। দেখলাম, বছর ঘুরতেই তিনি ছাত্রদের অনৈতিক ‘ঘেরাও’য়ের শিকার। তার কয়েক দিনের মধ্যেই ইস্তফা দিয়ে সেই অধ্যাপক ফিরে গেলেন পুরনো কর্মক্ষেত্রে। তৎকালীন উপাচার্য কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলির বিরাগভাজন হয়েছিলেন ‘র্যাগিং’য়ের বিরুদ্ধে অনেক কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
আমার মনে হয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় খাপ পঞ্চায়েতের আদলে চলে। সেখানে ‘জিবি মিটিং’ এবং নিজ নিজ শক্তি প্রদর্শনের খাতিরে আধিকারিক ও উপাচার্যকে ‘ঘেরাও’ করা দু’টি প্রচলিত ‘রীতি’। ঠিক খাপ পঞ্চায়েতের আদলে ওই ‘জিবি মিটিং’গুলিতে প্রায়ই অনৈতিক এবং দেশের আইনবিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ফলস্বরূপ, একটি নকল আন্দোলন তৈরি করে বিশেষ কিছু প্রশাসনিক পদক্ষেপকে আটকে দেওয়ার চেষ্টা হয় অধিকাংশ সময়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, ‘র্যাগিং’য়ের অপরাধে অভিযুক্ত ছাত্র অনেক লঘু সাজা পেয়েছে। অনেক সময় অভিযুক্তকে আদৌ ধরা যায়নি। খাপ পঞ্চায়েতের মতোই এদের হাতিয়ার হল আধিকারিক বা উপাচার্যকে ঘেরাও এবং হেনস্থা করা। যত দূর জানি, ভারতীয় গণতন্ত্রে অমানবিক ভাবে ‘ঘেরাও’য়ের নামে ‘পণবন্দি’ করে রাখা আসলে বেআইনি কাজ। কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বেআইনি ‘ঘেরাও’ স্বীকৃত। একই সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলে তা বহুলপ্রচলিতও বটে।
দ্বিতীয় বার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিই ২০১৩ সালে। সেই সময় তৎকালীন উপাচার্য ইস্তফা দিয়েছিলেন। তার ইস্তফাদানের অব্যবহিত পরেই আমি দায়িত্ব নিই। উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পরে এক দিকে যেমন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর উন্নতির দিকে নজর দিয়েছিলাম, তেমনই ছাত্রছাত্রী, কর্মচারী ও শিক্ষকদের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে একগুচ্ছ পদক্ষেপও করেছিলাম।
উপাচার্য পদে থাকাকালীন আমি কী কী করেছি বা করার চেষ্টা করেছি, নীচে তার উল্লেখ করছি শুধুমাত্র এটা বোঝানোর জন্য যে, পরিকাঠামো, অনুশাসন এবং শৃঙ্খলাবোধ কী ভাবে একটা প্রতিষ্ঠানের উপর প্রভাব ফেলে।
২০১৩-’১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ভবন মেরামতি করে রং করা হয়। সংস্কার করা হয় ভাঙা রাস্তা। ক্যাম্পাসের রাস্তায় গাড়ির গতিবেগ রোখার জন্য লাগানো হয় ‘স্পিড ব্রেকার’। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ও সাবস্টেশনগুলির কয়েকটির আমূল সংস্কার করা হয়। নির্ভরযোগ্য পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থা না-থাকায় ক্যাম্পাসে প্রচুর জল পরিশোধক, ওয়াটার কুলার বসানো হয়। ক্যাম্পাস সব সময় জঞ্জালমুক্ত করা হত। জিম ও খেলাধুলোর ব্যাপারে উদ্যোগ ছিল। ছাত্র-কর্মচারী-শিক্ষকদের স্বার্থে অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করা হয়। বিশেষ ভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে দু’টি ব্যাটারিচালিত গাড়িও কেনা হয়। সেই সময় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ‘ন্যাক’-এর মূল্যায়নে সব চেয়ে উঁচু গ্রেড পেয়েছিল।
এ তো গেল পরিকাঠামোগত বিষয়। অনুশাসনের ক্ষেত্রে আমি একগুচ্ছ নজরদারির ব্যবস্থা করেছিলাম। তার মধ্যে অন্যতম— ক্যাম্পাসে নেশা ও মদ্যপান বন্ধ করা। আমি দিনে-রাতে নিরাপত্তারক্ষী বা আধিকারিকদের নিয়ে নিয়মিত ক্যাম্পাসে টহল দিতাম। ফলে ওই ধরনের অসামাজিক কাজকর্ম প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে ফ্লাড লাইট লাগিয়েছিলাম। মাদকসেবনের জায়গাগুলি লোহার তারের বেড়া দিয়ে অনেকটাই ঘিরে ফেলি। বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। হস্টেলগুলি প্রায়ই পরিদর্শন করতাম বলে সেখানে বহিরাগত বা প্রাক্তনীদের অনধিকার বসবাস অনেকাংশে কমে গিয়েছিল। নিজ উদ্যোগে হস্টেলে ফ্রি ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম, আমার ঘন ঘন হস্টেল পরিদর্শনের জেরে ‘র্যাগিং’ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বহু শিক্ষক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যরক্ষায় প্রত্যক্ষ আগ্রহও দেখাচ্ছিলেন।
তবে সবচেয়ে বড় যে কাজটা করতে পেরেছিলাম, সেটা সিসি ক্যামেরা সংক্রান্ত। ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ক্যাম্পাসের কয়েকটি জায়গায় সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। আরও কিছু জায়গা চিহ্নিত করেছিলাম। যেখানে সিসি ক্যামেরা জরুরি ছিল। কলকাতা হাই কোর্ট সেই সময় একটি জনস্বার্থ মামলায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বেশ কিছু অন্তর্বর্তী আদেশ জারি করে। উপাচার্য হিসাবে সেগুলির পূর্ণ রূপায়ণে আমি সচেষ্ট হয়েছিলাম।
এই অনুশাসন ও শৃঙ্খলার ব্যবস্থা কারও কারও পছন্দ হল না। ফলে ২০১৫-র প্রথম দিকে অনৈতিক, রাজনৈতিক, চক্রান্তমূলক এক আন্দোলন এবং তৎকালীন সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে আমি উপাচার্য পদ থেকে ইস্তফা দিই। আমার মনে হয়, সেই দিন থেকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অরাজকতার কালো দিনের সূচনা। জানতে পেরেছিলাম, পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর উন্নতির কাজ শ্লথ হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, বহুলাংশে থেমেও গিয়েছিল। সর্বোপরি ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের স্বার্থে এবং আদালতের রায়কে মান্যতা দিয়ে যে সব নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেগুলি তুলে নেওয়া হয়। হয়তো সস্তা ছাত্র ‘পপুলারিটি’ পাওয়ার লোভে।
বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারছিলাম, আমি চলে আসার পর থেকেই ক্রমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের দ্বার বহিরাগতদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। অনুশাসন ও শৃঙ্খলা-সহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা শিকেয় ওঠে। ‘মুক্তমন’ ও ‘মুক্ত সংস্কৃতি’র বুলি ও প্রচারের আড়ালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আবার অনৈতিক, অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজকর্মের মুক্তাঞ্চল হয়ে ওঠে। শুনতে পাচ্ছিলাম ক্যাম্পাসে যথেচ্ছ মদ ও নেশার বস্তুর ব্যবহার, ব্যবহৃত জন্মনিরোধক পিল ও কন্ডোমের আধিক্য, ল্যাবরেটরির যন্ত্র চুরি, খোলা জায়গায় অশ্লীলতা ও অন্যান্য অনৈতিক কাজকর্মের কথা। হস্টেলগুলি থেকেও নাকি নজরদারি উঠে যায়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মাত্রাছাড়া হয়ে ওঠে। বহু শিক্ষক-ছাত্র যাঁরা যাদবপুরকে ভালবাসতেন, তাঁরা অসহায়তার শিকার হয়ে পড়েন। যত দূর জানি, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব ছাড়ার পর কর্তৃপক্ষের তরফে সমস্ত সিসি ক্যামেরা খুলে নেওয়া হয়। বাকিগুলো অকেজো করে দেওয়া হয়।
এ সব লিখছি একটা কথা স্পষ্ট করতে। একটি সদ্যপ্রস্ফুটিত, সম্ভাবনাময় মেধাবী ছাত্রকে যে কারণে প্রাণ দিতে হল, কর্তৃপক্ষ তার দায় এড়াতে পারেন না। যে সব মানুষ, অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্রনেতা, কর্মচারী তথাকথিত অনৈতিক ও বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়া ‘হোক কলরব’ আন্দোলনে মদত দিয়ে আমাকে হেনস্থা করে সরাতে চেয়েছিলেন, তাঁরা আজকের এই অরাজকতা, নিরাপত্তাহীনতা ও এক কিশোরের অকালমৃত্যুর জন্য পরোক্ষ ভাবে দায়ী। কারণ, আমি চলে আসার পরেই হাই কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে নজরদারির সব ব্যবস্থা তুলে দেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস র্যাগিং ও অন্যান্য অনৈতিক ও অপরাধমূলক কাজকর্মের মুক্তাঞ্চল হয়ে দাঁড়ায়।
সম্ভাবনাময় এক মেধাবী কিশোরের অপমৃত্যু শুধু যে এই পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখে কালিমালেপন করেছে তা-ই নয়, এই অপমৃত্যু সমস্ত জাতির মননে এক গভীর ক্ষত ও ঘৃণার সৃষ্টি করেছে। অপরাধীদের আশু শাস্তিবিধান প্রয়োজন। একই সঙ্গে সরকার, মাননীয় আচার্য এবং কর্তৃপক্ষের এখনই কলকাতা হাই কোর্টের অন্তর্বর্তী আদেশ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর গাইডলাইন মেনে ক্যাম্পাসে নজরদারি ও অন্যান্য পদক্ষেপ করা প্রয়োজন। যাতে এই ‘দুর্ঘটনা’র পুনরাবৃত্তি না হয়। অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন যাতে শ্রী অরবিন্দের হাতে গড়া এই বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর মানবিক ও দার্শনিক চিন্তাকে অন্তত ন্যূনতম সম্মান জানাতে পারে। ভারতের জাতীয় চিত্রে উৎকর্ষের শিরোপা মাথায় নিয়ে চলা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় যেন জনমানসে তার ভাবমূর্তির অবনমন আটকাতে পারে। কঠোর অনুশাসন ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে প্রশাসনের সাহায্যে তার মুখে লেগে যাওয়া কলঙ্কদাগ তুলতে সক্ষম হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাক্তন উপাচার্য হিসাবে এটুকুই আমার প্রার্থনা।