বিমল সেনগুপ্ত
খুব শৈশবের কথা স্মৃতির ধারাপাতে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবু মনে পড়ে পদ্মায় লঞ্চঘাটের সেই ঘটনা আর বদলে যাওয়া জীবন।
আমার জন্ম ঢাকার বেজগাঁওয়ে, ১৯৪৩তে। ঠাকুর্দা কালীমোহন সেন ছিলেন সম্ভ্রান্ত কবিরাজ। বিশাল জমির ওপর চারচালা বাড়ি, গাছগাছালি। অদূরে বুড়িগঙ্গা। ঢাকার মধ্যপাড়ায় ছিল মামারবাড়ি। দাদু ছিলেন দন্তচিকিৎসক। কর্মসূত্রে সপরিবারে থাকতেন ময়মনসিংহে। বাবা আগেই কলকাতায় চলে এসেছিলেন। থাকতেন লেক মার্কেটের পিছনে পরাশর রোডে। আমি যখন চলে এলাম, খুবই ছোট। ওপার বাংলার স্মৃতিটা তাই খুব অস্পষ্ট।
আমাদের আত্মীয়দের অনেকে ছিলেন পূর্ববঙ্গে। ১৯৪৬ সালে এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে বাবা-কাকাদের সঙ্গে ওপারে গেলাম এক ঘনিষ্ঠের বিয়ের অনুষ্ঠানে। পদ্মায় নদিঘাটে লঞ্চ থেকে নামার জন্য একটু ব্যবধানে দুটো কাঠের পাটাতন লাগানো ছিল। লোক যাচ্ছিল একটা পাটাতন দিয়েই। অপরটা ছিল ফাঁকা। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম নদীর জল অদ্ভুতভাবে লাল। আসলে কাছেই কিছু লোক ধারালো অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিল। লঞ্চ থেকে কোনও যাত্রী তিরে নামামাত্র কেটে ভাসিয়ে দিচ্ছিল নদীতে। অস্পষ্টভাবে চেঁচিয়ে উঠলাম, “বাবা দ্যাখ, কত রক্ত!“
বাবা খুব ঠান্ডা, ধীরস্থির মানুষ ছিলেন। আস্তে করে সরিয়ে অপর পাটাতন দিয়ে আমাদের নিরাপদে বার করে দিলেন। সামনেই দর্শনা স্টেশন। প্লাটফর্মে এসে দেখি বাবা নেই! মুসলমানরা পিছন থেকে এসে বাবাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ট্রেনের টিকিট ছিল বাবার কাছে। আমরা তো উদভ্রান্ত। কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করলাম। প্লাটফর্মে ছিল কিছু ভাল মুসলমান। তারা আমাদের টিকিট কেটে খাবার কেনার কিছু টাকা দিয়ে দিল। আমরাও কৃতজ্ঞচিত্তে ওদের নাম-ঠিকানা নিয়ে কলকাতায় আমাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালাম।
ছবি: পদ্মার ফেরিঘাট।
দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। কিন্তু চারদিকে চরম একটা অনিশ্চয়তা। সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে দলে দলে পূর্ব বাংলার হিন্দুরা চলে আসছেন। দাঙ্গা শুরু হয়েছে। ‘দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বাংলা তথা গোটা উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ধারণায় একটা বাঁক এনেছিল। সে বছর ১৬ অগস্ট কলকাতায় হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে হিংসার বিস্ফোরণে যত মানুষ খুন হল, যত সম্পত্তি ধ্বংস হল, অতীতে তার নজির মেলে না। দেশ জুড়ে দাঙ্গার জমি যেন তৈরি হয়ে গেল কলকাতায়, ছড়িয়ে পড়ে পূর্ববঙ্গে একাধিক স্থানে। দেশভাগ অবধি এবং তার পরেও যা ক্রমাগত চলেছে। কলকাতার দাঙ্গার পরেই মুসলিম লিগ এবং জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা ব্রিটিশের পরিকল্পনায় তড়িঘড়ি সায় দিয়ে দিলেন। মেনে নিলেন যে দেশভাগই ‘একমাত্র’ উত্তর। সেই নিরিখে কলকাতার দাঙ্গা যেমন দেশভাগের হিংসার গোড়াপত্তন, তেমনই দেশভাগের সপক্ষে রাজনৈতিক যুক্তিরও সূচনা।
ছবি: দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ে হতাহত হয় বেশ কয়েক হাজার মানুষ।
কানাডার রায়ার্সন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক জনম মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “কলকাতার মানুষের সামগ্রিক স্মৃতিতে গভীর ভাবে গেঁথে গিয়েছে কলকাতার দাঙ্গা। সে সব দিনের স্মৃতি, অনুভব, মনে ছাপ-পড়া ছবি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ধারণাকে যা অনেকটাই প্রভাবিত করছে। কিন্তু সামগ্রিক স্মৃতি যে ভাবে দানা বাঁধে, তা ত্রুটিমুক্ত নয়। তাই প্রায়ই দেখা যায় অনেক জটিল, বহুমাত্রিক ঘটনার একটা সহজ, একমাত্রিক কারণ খাড়া হয়ে গিয়েছে। কলকাতার দাঙ্গার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। চল্লিশের দশকের কলকাতা নিয়ে গবেষণার সময়ে আমি এমন অনেক লোকের সঙ্গে কথা বলেছি যাঁরা দাঙ্গা দেখেছেন, কিংবা তাঁদের উত্তরপুরুষ। তাঁরা দাঙ্গার যে ব্যাখ্যা দেন, তা সাধারণত দুটো কারণের চার পাশে ঘোরাফেরা করে। এক, রাজনৈতিক উসকানি; দুই, হিন্দু-মুসলিমদের পরস্পরের প্রতি ঘৃণা।“
এই পটভূমিতেই কোনওক্রমে আমরা দর্শনা থেকে ট্রেনে কলকাতায় এলাম। বাড়িতে সব শুনে কান্নার রোল পড়ে গেল। মা তো ঘন্টায় ঘন্টায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে! কোথায় বাবার খোঁজ করব, কোনও আন্দাজ নেই! মুসলমান অপহরণকারীরা তাদের ডেরায় নিয়ে গিয়েছিল। একদিন বাবা বাথরুমে যেতে চাইলে ওদের একজন বলে, যাও সামনের জঙ্গলে গিয়ে করে আস। বাবাও দেখল, এই তো সুযোগ! লুকিয়ে দর্শনা থেকে ট্রেনে করে সোজা কলকাতায়। এতদিন বাদে বাবাকে ফিরে পেয়ে আমাদের কী আনন্দ!
ছবি: দেশভাগের পর এপার বাংলায় ঢল নামল উদ্বাস্তুদের।
দেশ স্বাধীন হল। শরনার্থীদের স্রোত যেন আছড়ে পড়ল এই বাংলায়। উত্তরে দমদম-বিরাটি, দক্ষিণে যাদবপুর-টালিগঞ্জ সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পতিত জমির জঙ্গল কেটে কলোনি তৈরির ধূম পড়ে গেল। ১৯৫০ সালে আমরাও চলে এলাম টালিগঞ্জে, নেতাজীনগরে। শুরু হল জীবনের আর একটা অধ্যায়।
ছবি: নমো নমো নমো সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি।
মাটির দাওয়া, টালির ছাদ, বেড়ার দেওয়াল, হ্যারিকেনের আলো। সামান্য ব্যবধানে বেড়ায় ঘেরা ছাদবিহীন বাথরুম। বৃষ্টিতে যেতে হত ছাতা মাথায়। এপাশে গোয়ালঘর। প্রথমে আমরা চার ভাইবোন, ওখানেই কাটালাম বেশ ক’বছর। পরে আরও দুই ভাই হল। আম গাছে প্রচুর আম হত। ছিল জাম, সজনে, লেবু— নানা রকম গাছ। ফল-ফুলের সুবাস, পাখীর কাকলী— একেবারেই যেন পূর্ববাংলার রেপলিকা। স্মৃতি ঝেড়ে ফেলতে চাইলেই কি পারা যায়? পূর্ববঙ্গের সেনহাটির লোকেরা বেহালায় এসেও নাম দিল সেনহাটি কলোনি। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তো ছিলই, তৈরি হল উয়ারি ফুটবল ক্লাব। প্রথম ডিভিশনেও খেলত এটি। কেউ বা নিজের বাড়ি তৈরি করে নাম দিল ‘ছিন্নমূল’। ওপার বাংলা থেকে আমাদের মত চলে আসা অনেকের অবচেতনে রয়ে গেল ছেলেবেলার নানা স্মৃতি।
যুগান্তরের সাথে সাথে বদলে গেল অনেক কিছু। সেই পূর্ববাংলা স্বাধীন দেশ হল ’৭১-এ। সেটা যেন ছিল ১৯৪৭-এর পর আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। ওপার বাংলা থেকে হিন্দুদের আসার ঢল কিন্তু বন্ধ হল না। জনস্ফীতি আঘাত হানল রাজ্যের অর্থনীতির ওপর। দেখলাম অনেক রাজনৈতিক পরিবর্তন। আশপাশের ফাঁকা জায়গাগুলো সব ভরে গেল। বড় বড় বাড়ি, চওড়া বাঁধানো রাস্তা, ঝকঝকে আলো, আধুনিক জীবনাচারণ— কী দুস্তর ব্যবধান। ছেলেবেলায় ভাই, বন্ধুরা চাকা চালাত, গুলতি দিয়ে পাখি মারত, গুলি এবং ডাংগুলি খেলত। ঘরে ঘরে বসত তাস-লুডোর আসর। সে সব অতীত। প্রযুক্তি এসে বেমালুম বদলে দিয়েছে আমাদের সেই জীবন।
ছবি: আমূল বদলে গিয়েছে টালিগঞ্জের সেই নেতাজিনগর।
আট দশকের পটভূমিতে ফ্ল্যাশব্যাকে ভেসে ওঠে সে সব টুকরো আলেখ্য। তার মাঝেই স্মৃতির ধৃসর ধারাপাত থেকে উঁকি মারে সেই শিশুর আর্তচিৎকার— “বাবা দ্যাখ, কত রক্ত!“
অনুলিখন— অশোক সেনগুপ্ত।