থমকে থাকা অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতরে খিঁচুনি হচ্ছে রোগীর। ছটফটানিতে নাক থেকে বার বার অক্সিজেনের নল খুলে যাওয়ার জোগাড় হচ্ছে। কোনও মতে চেপে ধরে সামলানোর চেষ্টা করছেন তাঁর সঙ্গীরা। হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে কর্তব্যরত পুলিশের কাছে দৌড়ে গেলেন তাঁদেরই এক জন। পুলিশকে কিছু জিজ্ঞাসা করে ফিরে এসে অপর সঙ্গীকে বললেন, ‘‘মনে হয় না আর হাসপাতালে পৌঁছতে পারব! এত কাছে এসেও সব চেষ্টা মাটি হবে বলে মনে হচ্ছে!’’
বৃহস্পতিবার এ পি সি রোডে রোগী নিয়ে আটকে থাকার এই দৃশ্য একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। এ দিন প্রাক্-পুজোর মিছিলের গেরোয় যানজটে ফেঁসে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। কেউ ঘণ্টা দুয়েক রাস্তায় অপেক্ষা করার পরে রোগী নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছলেন। কেউ আবার শত ঘোরাঘুরির পরেও সরকারি হাসপাতালে পৌঁছতে না পেরে শেষমেশ রোগীকে কাছাকাছি থাকা কোনও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে বাধ্য হলেন। ভোগান্তির এই সমস্ত ঘটনা কাজের দিনে এমন মিছিলের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিল।
এ দিন সকালে হঠাৎই খিঁচুনি শুরু হয়ে যায় সুশোভন ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তির। সেই সঙ্গে বমি ও শ্বাসকষ্ট। চুঁচুড়ার বাসিন্দা, রেলের প্রাক্তন কর্মী সুশোভনকে সকালে হুগলির একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা দ্রুত কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। দেরি করা হলে ‘মারাত্মক’ কিছু ঘটে যেতে পারে বলেও জানিয়েছিলেন তাঁরা। তাই সেখান থেকে রোগীকে নিয়ে বি আর সিংহ হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন পরিবারের সদস্যেরা। চুঁচুড়া থেকে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছে গেলেও এ পি সি রোডের যানজটে রোগীকে নিয়েই আটকে যায় অ্যাম্বুল্যান্সটি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এ দিক-ও দিক ফোন করতে করতে রোগীর এক আত্মীয় বললেন, ‘‘চুঁচুড়া থেকে শ্যামবাজারে আসতে যত না সময় লাগল, তার থেকেও বেশি সময় রাস্তায় দাঁড়িয়েই কেটে গেল! এখন তো গাড়ির চাকা আর নড়ছেই না। রোগীর যা অবস্থা, শিয়ালদহ পৌঁছনোর আগেই অঘটন কিছু ঘটে না যায়।’’ তাঁর কথা শেষ না হতেই অ্যাম্বুল্যান্সের চালক বলতে শুরু করলেন, ‘‘শ্যামবাজার থেকে তো উল্টো দিকের লেন ধরে নিয়েছিলাম। ওই ভাবে কোনও মতে বেশ কিছুটা এগিয়ে আসি। কিন্তু এখন তো সব দিকেই শুধু গাড়ি আর গাড়ি। রোগী নিয়ে যাব কোথা দিয়ে?’’
প্রাক্তন ওই রেলকর্মীর পরিবারই শুধু নয়, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা এন আর এস হাসপাতালে রোগী ভর্তি করাতে এসে ভোগান্তির মুখে পড়তে হয় আরও অনেককে। সব থেকে বেশি দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন হাওড়ার দিক থেকে আসা রোগীরা। যানজটে সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার পথ না পেয়ে অনেকেই সঙ্কটজনক রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে বাধ্য হন। পার্ক স্ট্রিটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে এসেছিলেন ডোমজুড়ের বাসিন্দা অমিয় পাত্র। বললেন, ‘‘বাবাকে নিয়ে কলকাতা মেডিক্যালে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু রাস্তার যা অবস্থা, শত ঘুরেও সে দিকে যাওয়ার পথ পাচ্ছি না। বাবাকে বাঁচাতে তাই বাধ্য হয়েই এই হাসপাতালে এনে ভর্তি করিয়েছি।’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ছুটি পাওয়া এক সদ্যোজাত ও তার মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়েও এ দিন ভোগান্তির মুখে পড়েছিলেন বাড়ির লোকেরা। জগৎ সিনেমার কাছে আটকে থাকা একটি অ্যাম্বুল্যান্সে বসে এক ব্যক্তি। কোলে সেই সদ্যোজাত। তিনি বললেন, ‘‘আমাদের না হয় আজ ছুটি হয়ে গিয়েছে, বাড়ির পথে আটকে রয়েছি। কিন্তু যাঁরা হাসপাতালে ভর্তির জন্য বেরিয়ে রোগী নিয়ে আটকে গিয়েছেন, তাঁদের অবস্থা ভেবেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রাস্তা আটকে মিটিং-মিছিল কবে যে বন্ধ হবে, কে জানে!’’