আদালতের নির্দেশে ‘শিকল ভাঙার গান’ রাসমণিতে, দ্রোহের কার্নিভালে পুলিশই হয়ে উঠল ‘প্রধান প্রতিপক্ষ’

দুপুর ২টো ১৮মিনিট। হাই কোর্টে বসল বিচারপতি রবি কিসান কপূরের এজলাস। ধর্মতলায় তখন জমায়েত জমাট বাঁধছে ধীরে ধীরে। কোর্টে শুরু হয় শুনানি। দ্রোহের কার্নিভালের অনুমতি বাতিলের পক্ষে যুক্তি দিতে শুরু করে রাজ্য সরকার। টেনে আনা হয় সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে দিল্লির শাহিনবাগ-প্রসঙ্গ। পাল্টা যুক্তি দেন আন্দোলনকারীদের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। শুনানি এগোতে থাকে, ভিড় বাড়তে থাকে ধর্মতলা চত্বরে।

কার্নিভালের মিছিল রুখতে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে পুলিশ।

দুপুর ২টো ৫৩ মিনিট। বিচারপতি নির্দেশ দিলেন, দ্রোহের কার্নিভাল করা যাবে। রেড রোডের পুজো কার্নিভালের সঙ্গে তার কোনও সংঘাত নেই। নির্দেশ ঘোষণা মাত্র মোবাইলে বার্তা পৌঁছে যায় ধর্মতলা চত্বরে। তার পর দেখা যায় উদ্বেলিত জনতা পুলিশের দাঁড় করানো ব্যারিকেডের ফাঁক দিয়ে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে ঢুকছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশও কার্যত ‘বাধ্য’ হয় ব্যারিকেডের শিকল খুলে দিয়ে তা সরিয়ে দিতে। তার পর দেখা যায় জলস্রোতের মতো জনস্রোত ধেয়ে যাচ্ছে রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের দিকে। ঢাকের বাদ্যি, স্লোগানে তখন শিকল ভাঙার গান কলকাতার মিটিং সরণিতে। খানিক ক্ষণের মধ্যেই উপচে পড়ে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ।

উপচে পড়া ভিড় রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে।

দ্রোহের কার্নিভালে যে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না, তা সোমবারই জানিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। তার পর সোমবার বেশি রাতে কলকাতা পুলিশের তরফে ১৬৩ ধারা (সাবেক ১৪৪ ধারা) জারি করা হয় রানি রাসমণি, ডোরিনা ক্রসিং-সহ সংলগ্ন এলাকায়। লালবাজারের সেই নির্দেশিকায় বলা হয়, দ্রোহের কার্নিভাল থেকে অশান্তি পাকানো হতে পারে। পুলিশের সেই নির্দেশিকাকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয় হাই কোর্টে। আদালতই খারিজ করে দেয় পুলিশের নির্দেশিকা। শুনানি চলাকালীন বিচারপতি মন্তব্য করেন, ‘‘আর কোথায় ১৬৩ ধারা জারি করা বাকি রয়েছে?’’

জমায়েতের বিভিন্ন অংশ থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছড়ে পড়তে থাকে।

তার পর একের পর এক মিছিল পৌঁছতে থাকে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে। ভরে যায় দুটো লেনই। সেই জমায়েতের বিভিন্ন অংশ থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছড়ে পড়তে থাকে। ব্যারিকেডের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ কর্মীদের সামনে গিয়ে সাধারণ মহিলারা নানা ধরনের কটাক্ষ করতে শুরু করেন। রাস্তার ধারেই পড়ে ছিল দলা পাকানো শিকল। পুলিশ যখন তা সরিয়ে ফুটপাথে সরাতে যায়, দেখা যায় মানুষ গিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। অনেকে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মাতঙ্গিনী হাজরার ছবি সম্বলিত পোস্টার এনেছিলেন। তাতে লেখা ‘প্রীতিলতা-মাতঙ্গিনীদের বাংলায় ধর্ষকদের ঠাঁই নেই’। দেখা যায় সেই পোস্টার সেঁটে দেওয়া হয়েছে কলকাতা পুলিশের গাড়িতে। হাই কোর্ট থেকে রানি রাসমণিতে চলে গিয়েছিলেন আইনজীবী বিকাশও। তাঁকে ঘিরেও উৎসাহ দেখা যায় মানুষের মধ্যে। ঘামে ভেজা জামা গায়ে জাক্তার মানস গুমটা পরিচিতকে জড়িয়ে ধরে বলে ফেললেন, ‘‘এমন আনন্দ অনেক দিন পাইনি।’’

একের পর এক মিছিল রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে।

দ্রোহের কার্নিভাল ডেকেছিল জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স। তবে তাতে জুড়ে গিয়েছিল আরও কিছু মঞ্চ। যে মঞ্চগুলিতে সিপিএম তথা বামেদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের জমায়েতে সংঘটিত ভিড়ের ছবি দেখা গিয়েছে। উদ্যোক্তারাও যে পরিকল্পনা করেই সবটা করেছিলেন, তা-ও স্পষ্ট হয়েছে স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে হাতে ওয়াকিটকি দেখে। তবে আগের দিনের মতো সিপিএমের প্রথম সারির নেতারা কেউ জমায়েতে যাননি। জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকা সমাবেশে আনুষ্ঠানিক সমর্থন জানিয়েছিল বামফ্রন্ট। যা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। অনশন মঞ্চ থেকেই বলেছিলেন, কেউ যেন আন্দোলন হাইজ্যাক করার চেষ্টা না করেন। মনোভাব বুঝে আগের দিন মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তীদের অকুস্থল ছাড়তে হয়েছিল। তবে মঙ্গলবারের ভিড়ে সিপিএমের অনেক ছোট-মাঝারি নেতাদের দেখা গিয়েছে। অতিবাম রাজনীতির অনেককেই দেখা গিয়েছে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের ভিড়ে।

দ্রোহের কার্নিভাল ডেকেছিল জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স। তবে তাতে জুড়ে গিয়েছিল আরও কিছু মঞ্চ।

গুচ্ছ গুচ্ছ কালো বেলুনের বন্দোবস্ত করেছিলেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু ওড়ানোর পর দেখা যায় তা পুজো কার্নিভালের দিকে না গিয়ে উল্টো দিকে ভেসে যাচ্ছে। যা দেখে অনেককেই বলতে শোনা গেল, ‘‘হাওয়াটা ঠিক দিকে বইল না!’’ দ্রোহের কার্নিভাল দেখে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এক কৌতূহলি যুবককে আস্তে করে বলতে শোনা গেল, ‘হাওয়াটা মমতার পক্ষেই কিন্তু রয়ে গেল!’ তার পর সন্তর্পণে চারপাশটা দেখে নিলেন, আন্দোলনকারীদের কেউ শুনে ফেলেননি তো!

দ্রোহের কার্নিভালে উড়ল কালো বেলুন।

রানি রাসমণি অ্যাভিনিউতে কার্নিভাল চলাকালীনই ধর্মতলায় শুরু হয়ে যায় জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকা মানববন্ধন। সন্ধ্যার পর আরও ভিড় বাড়তে থাকে। অবরুদ্ধ হয়ে যায় ডোরিনা ক্রসিং থেকে ধর্মতলা। সেই জমায়েতেও দেখা যায় পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছড়ে পড়ছে। কলকাতা পুলিশের ডিসি (সেন্ট্রাল) ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখান আন্দোলনকারীরা। ‘গো ব্যাক’ স্লোগান ওঠে সমবেত জনতার মধ্যে থেকে। পুজো কার্নিভালে প্রতিমা প্রদর্শন শেষে শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবে ফিরছিল লরি। পিছনেই ছিল রাজ্যের মন্ত্রী তথা ক্লাবকর্তা সুজিত বসুর গাড়ি। ধর্মতলায় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সেই সময়ে চলছিল জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকে মানববন্ধন। সুজিতকে গাড়িতে দেখেই ক্ষোভ উগরে দেয় মানববন্ধনে দাঁড়ানো জনতা। একসঙ্গে কয়েকশো লোককে ধেয়ে যেতে দেখা যায় গাড়ির দিকে। সুজিতের অভিযোগ, তাঁর গাড়িতে বোতলও ছোড়া হয়েছে। ওই ঘটনা নিয়ে ধুন্ধুমার পরিস্থিতি তৈরি হয় ধর্মতলা মোড়ে। তবে সুজিতের গাড়ি থামেনি। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে গাড়ি নিয়ে সোজা এগিয়ে যেতে থাকেন তিনি। চলন্ত গাড়িরই পিছনের অংশে চড়-থাপ্পড় মারেন কেউ কেউ।

রানি রাসমণি থেকে ডোরিনা ক্রসিং, লেনিন মূর্তির সামনে থেকে ভিক্টোরিয়া হাইস— গোটা এলাকা জুড়ে দফায় দফায় বিক্ষোভের মুখে পড়তে হল পুলিশকে। কার্যত পুলিশই হয়ে উঠল প্রধান প্রতিপক্ষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.