ক্যাম্পাসে ক্যামেরা বসানো নিয়ে বিতর্ক, আদালতের নির্দেশ মেনে থানায় সিসি ক্যামেরা সক্রিয় থাকে কি?

আদালতের নির্দেশ এলে তৎপরতা শুরু হয়। কোথায় কোথায় সিসি ক্যামেরা বিকল, সেই হিসাব নেওয়া হয়। প্রয়োজনে তালিকা তৈরি করে দ্রুত সে সব সারিয়েও ফেলা হয়। কিন্তু অভিযোগ, দিনকয়েক কাটতেই যে কে সে-ই! থানার সিসি ক্যামেরা কাজ করে কি না, খেয়াল রাখেন না কেউ! যাদবপুরের ঘটনার সূত্রে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে সিসি ক্যামেরা লাগানো নিয়ে জোর চর্চা চলছে এখন। কিন্তু আদালতের নির্দেশ মেনে থানায় লাগানো সিসি ক্যামেরা সক্রিয় থাকে কি? প্রশ্নটা উঠেছে কলকাতা হাই কোর্টের সাম্প্রতিক একটি নির্দেশের পরে।

গত বছর বারুইপুর পুলিশ জেলার অন্তর্গত একটি থানায় চার জন বিচারাধীন বন্দির মৃত্যু হয়। সেই ঘটনায় একটি মানবাধিকার সংগঠন জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে কলকাতা হাই কোর্টে। হাই কোর্ট তদন্তভার দেয় সিআইডি-কে। সেই তদন্তকারী সংস্থার অফিসার আদালতে জানান, সংশ্লিষ্ট থানার ওই নির্দিষ্ট সময়ের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ক্যামেরা বিকল ছিল। এর পরেই প্রধান বিচারপতি টিএস শিবগণনম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে প্রতিটি থানার সিসি ক্যামেরা ঠিক মতো কাজ করে কি না, তা দেখে রিপোর্ট জমা দিতে বলে। আজ, শনিবার সেই মামলার শুনানি হওয়ার কথা।

পুলিশ সূত্রের খবর, এ নিয়ে গত দু’দিনে ব্যাপক তৎপরতা দেখা গিয়েছে পুলিশ মহলে। রাজ্যের সমস্ত থানার কাছে খুব দ্রুত ক্যামেরা সংক্রান্ত রিপোর্ট চাওয়া হয়। রাজ্যের বেশ কিছু থানার পাশাপাশি কলকাতা পুলিশের অন্তত চারটি থানায় সিসি ক্যামেরার সমস্যার বিষয়ে জানতে পারেন পুলিশকর্তারা। দ্রুত সেগুলি ঠিক করে এক দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয় থানাগুলিকে। সবটা খতিয়ে দেখে রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনে নতুন করে দরপত্র ডেকে কাজ করানোর কথাও জানানো হয়। লালবাজারের কর্তারা যদিও জানাচ্ছেন, সিঁথি থানায় স্নেহময় দে ও রাজকুমার সাউ, বড়তলা থানায় ভূষণ দেশমুখ-সহ একাধিক ক্ষেত্রে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ ওঠায় প্রবল কড়াকড়ি করা হয়েছে। ডি কে বসু বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মামলায় শীর্ষ আদালতের ১১ দফা নির্দেশিকার ভিত্তিতে ‘এসওপি’ (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর) প্রকাশ করে পুলিশকর্তারা থানাগুলিকে জানিয়ে দেন, কাউকে জেরার জন্য নিয়ে আসা এবং ছেড়ে দেওয়ার সময়ে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা করাতে হবে। গ্রেফতার করা হলে মেডিক্যাল করাতে হবে। আদালতে তোলার আগেও ধৃতের শারীরিক পরীক্ষা করাতে হবে। অভিযুক্ত পুলিশি হেফাজতে থাকলে প্রতিদিন তাঁর মেডিক্যাল পরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক। সেই সঙ্গে কাউকে জেরা করার সময়ে, যাঁরা জেরা করবেন, তাঁদের উর্দিতে নিজেদের নাম ও পদের উল্লেখ থাকতে হবে। এবং তা যেন স্পষ্ট দেখা যায়। গ্রেফতারের ক্ষেত্রে ধৃতের পরিবারের সদস্য বা এলাকার কোনও গণ্যমান্য ব্যক্তিকে দিয়ে ‘অ্যারেস্ট মেমো’-তে সই করাতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলেও পর্যাপ্ত কারণ জানাতে হবে। এর পাশাপাশি, থানা ভবনের ১৪টি জায়গায় ক্যামেরা বসাতে হবে। বলা হয়েছে, থানায় ঢোকার ও বেরোনোর পথে, মূল গেটে, চত্বরের সামনে, প্রতিটি লক-আপের ভিতরে ও বাইরে, লবিতে, করিডরে, রিসেপশনে, বারান্দায়, ইনস্পেক্টর বা ওসিদের ঘরে, সাব-ইনস্পেক্টর ও অফিসারদের ঘরে, ডিউটি অফিসারের ঘরে, শৌচাগারের বাইরে, অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের ঘরে ও থানার পিছনের অংশে ক্যামেরা বসাতে হবে।

কিন্তু ক্যামেরা লাগানো হলেও সেগুলি সক্রিয় থাকে কি না, তা জানতে নজরদারি যে হয় না, হাই কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশের পরেই তা স্পষ্ট বলে মনে করছেন অনেকে। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’ (এনসিআরবি)-র তথ্য বলছে, গত দু’দশকে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ১৮৮৮ জনের। ‘রিমান্ডে নেই’ বিভাগে ১১৮৫ জন এবং ‘রিমান্ডে’ বিভাগে নাম রয়েছে ৭০৩ জনের। তবে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন মাত্র ২৬ জন পুলিশকর্মী। মানবাধিকার সংগঠনের নেতা রঞ্জিত শূর বললেন, ‘‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্দিদের পেটানো হয় ক্যামেরার আড়ালে। ফুটেজ নেই, এই অজুহাতে বিচার প্রক্রিয়াকে যাতে বিলম্বিত না করা হয়, সেটাও নিশ্চয়ই আদালত দেখবে।’’ লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তার মন্তব্য, ‘‘অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা অনেক ভাল। এমন কোনও পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, তার জন্যই থানায় কড়াকড়ি করা হয়েছে।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.