নির্বাচনী বন্ড কেনায় শীর্ষে বিতর্কিত লটারি ব্যবসায়ী, প্রথম ৩০ ক্রেতা সংস্থার ১৪টিতেই হয়েছে তল্লাশি!

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই) গত মঙ্গলবার নির্বাচনী বন্ডের তথ্য জমা দিয়েছিল জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে। বৃহস্পতিবারের মধ্যেই সেই তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে নির্বাচন সদন। সেই বন্ডের ক্রেতা এবং প্রাপক দলের লম্বা তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশও করে দেওয়া হয়েছে। তালিকা খতিয়ে দেখা যাচ্ছে, বন্ড কেনায় শীর্ষে রয়েছে বিতর্কিত লটারি ব্যবসায়ী মার্টিন সান্তিয়াগোর সংস্থা ‘ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস’। তারা কিনেছে মোট ১,৩৬৮ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড। বন্ড কেনায় টাকার অঙ্কের নিরিখে তার পরেই রয়েছে বিখ্যাত তেলুগু ব্যবসায়ী কৃষ্ণা রেড্ডির সংস্থা ‘মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড’। তারা ৯৬৬ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড রাজনৈতিক দলকে অনুদান দিয়েছে। মূলত হায়দরাবাদ কেন্দ্রিক এই সংস্থা একাধিক সরকারি প্রকল্পের বরাত পেয়েছে।

মহারাষ্ট্রের ‘কুইক সাপ্লাই চেন প্রাইভেট লিমিটেড’ ৪১০ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। এই সংস্থার তিন অধিকর্তার এক জন রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর একাধিক সংস্থার অধিকর্তা পদে রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। ‘হলদিয়া এনার্জি লিমিটেড’ ৩৯৫ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। মুম্বইয়ের ব্যবসায়ী অনিল আগরওয়ালের ‘বেদান্ত লিমিটেড’ আবার ৩৮৬ কোটি টাকার বন্ড অনুদান হিসাবে দিয়েছে। ‘এসেল মাইনিং অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামের একটি সংস্থা ২২৪.৫ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে বলে দেখা যাচ্ছে কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তালিকায়।

বন্ড কেনা এবং দেওয়ায় শীর্ষস্থান দখল করা লটারি ব্যবসায়ী সান্তিয়াগো নানা কারণে বার বার সংবাদ শিরোনামে থেকেছেন। ব্যবসায়ী মহলে তিনি ‘লটারি কিং’ নামে সমধিক পরিচিত। ব্যবসায় তাঁর উত্থানের কাহিনিও চমকপ্রদ। মায়নমারের ইয়াঙ্গনে শ্রমিক দিনমজুর হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে ভারতে ফিরে এসে তামিলনাড়ুতে শুরু করেন লটারি ব্যবসা। পরে তাঁর এই ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে কেরল এবং কর্নাটকে। আরও পরে উত্তর-পূর্ব ভারত, এমনকি নেপাল এবং ভুটানে লটারি ব্যবসা শুরু করেন তিনি। বর্তমানে সান্তিয়াগোর সংস্থা আবাসন, বস্ত্র শিল্পেও অর্থ বিনিয়োগ করেছে। ২০১৯ সাল থেকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি অর্থ তছরুপ প্রতিরোধ আইন (পিএমএলএ) আইন ভাঙার অভিযোগে সান্তিয়াগোর সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। সংস্থাটির কোয়েম্বাত্তূর এবং চেন্নাই দফতরে তল্লাশিও চালানো হয়।

আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তালিকা থেকে। তা হল, কেবল সান্তিয়াগোর সংস্থাই নয়, বন্ড কেনার নিরিখে প্রথম ৩০টি সংস্থার ১৪টিতেই গত কয়েক বছরে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে সিবিআই, ইডি কিংবা আয়কর দফতর (আইটি)-এর আধিকারিকেরা। ‘দ্য কুইন্ট’-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার সংস্থার একাধিক অফিসে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে হানা দেয় আয়কর দফতর। হলদিয়া এনার্জিতে ২০২০ সালের মার্চ মাসে হানা দেয় সিবিআই। ২০২২ সালের অগস্ট মাসে বেদান্ত লিমিটেডে তল্লাশি চালায় ইডি।

নরেন্দ্র মোদীর জমানায় পরিচয় এবং অর্থের অঙ্ক গোপন রেখে রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দেওয়ার সুবিধা দেওয়া হয়েছিল নির্বাচনী বন্ডে। সেই ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিল এসবিআই। কথা ছিল, কোনও ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দিতে চাইলে, স্টেট ব্যাঙ্কের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অর্থের অঙ্কের বন্ড কিনে সংশ্লিষ্ট দলকে দেবেন। সেই অর্থ ভাঙিয়ে নেবে রাজনৈতিক দলগুলি। মূলত কালো টাকার লেনদেন রুখতেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিল মোদী সরকার।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থাকে ‘অসাংবিধানিক’ এবং ‘ক্ষতিকারক’ আখ্যা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে (এসবিআই) নির্দেশ দেয় অবিলম্বে নির্বাচনী বন্ড বিক্রি বন্ধ করার জন্য। পাশাপাশি, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কতগুলি নির্বাচনী বন্ড বিক্রি হয়েছে, কোন কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনী বন্ড থেকে টাকা পেয়েছে— সেই সংক্রান্ত সব তথ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ৬ মার্চের মধ্যে সেই তথ্য তুলে দেওয়ার কথা এসবিআইকে বলেছিল শীর্ষ আদালত।

তবে এই নির্দেশ কার্যকর করতে এসবিআই সময়সীমা বৃদ্ধির আবেদন জানায়। সোমবার সেই মামলায় এসবিআইয়ের আবেদন খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত জানায়, কোনও ভাবে আর অতিরিক্ত সময় দেওয়া যাবে না। সেই সঙ্গে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ আরও জানিয়েছিল, নির্বাচন কমিশনকে ১৫ মার্চ বিকেল ৫টার মধ্যে তাদের সরকারি ওয়েবসাইটে বন্ড-তথ্য প্রকাশ করতে হবে।

কত তারিখে কোন সংস্থা কোন দল কত টাকার বন্ড কিনেছিল, তার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। যাতে দেশের অগ্রগণ্য বহু শিল্পগোষ্ঠীর নাম রয়েছে। প্রাপকদলের তালিকায় বিজেপি, কংগ্রেস, ডিএমকে, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, তৃণমূল, শিরোমণি আকালি দল, বিআরএসের মতো দলগুলি রয়েছে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (এসবিআই) তথ্য অনুযায়ী ২২ হাজার ২১৭টি বন্ড কেনা হয়েছিল। তার মধ্যে সব দল মিলিয়ে বন্ড ভাঙিয়েছে ২২ হাজার ৩০টি। কমিশন যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দাতা সংস্থার তালিকা ৩৩৭ পাতার। আর প্রাপক দলগুলির নামের তথ্য ৪২৬ পাতার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.