পেগাসাস স্পাইওয়্যার নিয়ে গোটা দেশ উত্তাল। তার মাঝেই হ্যাকিং নিয়ে তদন্ত কমিশন তৈরির কথা ঘোষণা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করে অতীতে তাঁর তৈরি বেশ কয়েকটি কমিশন রিপোর্টই দাখিল করতে পারেনি। রিপোর্ট দাখিল করলেও তার ভিত্তিতে নেওয়া হয়নি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ১৯৭০ সালের ১৭ই মার্চ। সিপিএম সমর্থিত কিছু উন্মত্ত দলবদ্ধ লোক বর্ধমানে সাঁই পরিবারের ঘরে ঢুকে ৩ ভাই ও তাদের গৃহশিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৫১ বছর আগের সেই ঘটনা আজও স্মরণীয়। বর্ধমানের সাঁইবাড়ির হত্যাকান্ডে বিরোধী কংগ্রেস অভিযোগ আনে বিনয় কোঙার, নিরুপম সেন, অমল হালদারের মত শীর্ষ সিপিএম নেতাদের নামে।
এ ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোড়ণ হয়। কংগ্রেসের দৃঢ় সমর্থক হিসেবে সাঁই পরিবারের ৩ ভাইয়েরা সুপরিচিত ছিল। ৭০ এর দশকে কংগ্রেস-বামদলের সম্মিলিত জোট ইউনাইটেড ফ্রন্টের ভাঙনের প্রাক্কালে সাঁইপরিবারের ভাইদের ওপর দল-বদলের জন্য সিপিএম-এর পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হতে থাকে। অভিযোগ, দল-বদলের পরিবর্তে উল্টো রাজনৈতিক বাধা সৃষ্টি করার প্রতিশোধ নেয় সিপিএম।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরেই বাম আমলে এ রকম আলোড়ণ জাগানো ঘটনা ও হরেক দুর্নীতির জন্য এক ডজন তদন্ত কমিশন বসান । প্রতিটি কমিশন গঠনের সময় ফলাও প্রচার করে তিনি নাম কিনেছেন। কিন্তু তারপর ফল অশ্বডিম্ব। এক জনেরও শাস্তি হয়নি।
ধ্বংশ হয়েছে বহু লক্ষ টাকা। ধরা যাক ৫০ বছর আগের কাশীপুর-বেলগাছিয়া হত্যাকাণ্ড। সেই ব্যাপারে তদন্তের কোনও সরকারি নথিই পাওয়া যায়নি। ১৯৭১ সালের ১২ থেকে ১৪ অগস্ট এই গণহত্যা চলে।
সাক্ষী খুঁজে কাজ চালিয়ে যেতে চেয়েছিল দেবপ্রসাদ সেনগুপ্ত কমিশন। তারা রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরকে দেওয়া স্টেটাস রিপোর্টে এ কথা জানায়। কমিশন সূত্রেরই খবর, এই হত্যাচান্ডে কাশীপুর থানায় জমা পড়ে ১১টি অভিযোগ। মামলাও হয়েছিল।
এর মধ্যে একটি মামলা ছিল কংগ্রেস নেতা নির্মল চট্টোপাধ্যায় হত্যা নিয়ে। হত্যাকাণ্ডে ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারদণ্ড দিয়েছিল আদালত। পরে আসামিরা মুক্তি পেয়ে যায়। তাদের আর হদিস নেই।
বাকি দশ মামলারও কোনও নথি পাওয়া যায়নি। প্রাক্তন বিচারপতি অসীম বিশিকে দিয়েও তদন্ত করানো হয়। কোনও লাভ হয়নি। সূত্রের খবর, কাশীপুর ও বরাহনগর থানা ও আলিপুর আদালত, এই সব তদন্তে কোনও সাহায্য করতে পারেনি।
আদালত থেকে যেটুকু নথি মেলে, তার সবটাই অসম্পূর্ণ। কমিশন আলিপুর আদালতের জেলা জজকে চিঠি দিয়ে বিস্তারিত তথ্য চেয়েছিল। কিন্তু আলিপুর আদালত জানিয়ে দেয়, কোনও নথিই পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে ক্ষুব্ধ কমিশন আবার আলিপুরের জেলা জজকে চিঠি দিয়ে জানতে চায়, কেন খোঁজ নেই?
কারা ফাইল লোপাট করল? তাদের শনাক্ত করা হয়েছে কি না? হয়ে থাকলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? কমিশন অবশ্য বসে না থেকে সেই সময়কার সংবাদপত্রে প্রকাশিত কয়েকটি খবরের কাটিং জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে সংগ্রহ করে।
বার বার সাক্ষী সংগ্রহের জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি। নথি না পেয়ে কমিশন বিষয়টি রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবের নজরে আনে। এই ঘটনা সংক্রান্ত নথি দিয়ে সাহায্য করার জন্য ডিসি ডিডি (২)-এর নেতৃত্বে গোয়েন্দা দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে নোডাল কমিটি গড়া হয়। কিন্ত্ত সেই কমিটিও নথি দিয়ে সাহায্য করতে পারেনি কমিশনকে।
তাদের পক্ষে যে এটা করা সম্ভব নয়, তা-ও জানায়নি কমিশনকে। এছাড়া বাম আমলে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে গঠিত চক্রবর্তী কমিশনের রিপোর্টও ছিল অসম্পূর্ণ। সে সময় এই কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দিতে চেয়ে যাঁরা আবেদন করেছিলেন, তাঁদের প্রায় সব আবেদনই কমিশন বাতিল করে দেয়। তাই সেই রিপোর্ট থেকেও কোনও দিশা পায় নি দেবীপ্রসাদ সেনগুন্ত কমিশন।
প্রথম দিকে কমিশনের কাছে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করবেন বলে মানবাধিকার কর্মী অসীম চট্টোপাধ্যায় ও সুজাত ভদ্ররা সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন। পরে কমিশনের বার বার তলব পেয়ে অসীমবাবু শেষে হাজিরা দেন। এই স্মৃতিরক্ষা কমিটির এক কর্মকর্তার নাম দিয়েছিলেন অসীম। তার সূত্র ধরেই কয়েক জনের নাম পাওয়া গিয়েছিল।
সেই সূত্র ধরে কমিশন এ পর্যন্ত ২৫ জনের সাক্ষ্য নেয়। এর মধ্যে কয়েক জন নিহতের বৃদ্ধ মা ও আত্মীয়। তবে তাঁরাও কেউ সে দিনের ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত কোনও তথ্য দিতে পারেননি। সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড, কাশীপুর-বেলগাছিয়া গণহত্যা ছাড়াও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১-র ২০ মে প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর আন্দন্দমার্গী, আমরি কাণ্ড-সহ আলোড়ন তোলা মোট বারোটি ঘটনা নিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন।
চারটি কমিশন রিপোর্ট জমা পড়লেও বাকি আট কমিশনের রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা পড়েনি। দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার এক মাস কাটতে না কাটতেই ওই আট কমিশনের হালহকিকত নিয়ে রিপোর্ট চান মমতা। কিন্তু তার পর সব চুপচাপ। এর পর তৃতীয় বারের জন্য তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন।
১৯৮২-র ৩০ এপ্রিল বালিগঞ্জে বিজন সেতুর ১৭ জন আনন্দমার্গী হত্যার পর প্রবল আলোড়ণ হয়। বিতর্কের জেরে তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সমরেন্দ্র বসুকে দিয়ে তদন্ত করান। তাঁর রিপোর্টে ওই ঘটনাকে জনরোষের প্রকাশ বলে চিহ্ণিত করে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কের কথা রিপোর্টে অস্বীকার করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা এ ব্যাপারে তদন্ত কমিশন তৈরি করেন।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সন্তোষকুমার ফৌজদার এবং অবসরপ্রাপ্ত আর এক বিচারপতি অমিতাভ লালাকেও এর দয়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু কমিশন কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি। কসবার বিজন সেতুতে আনন্দমার্গী হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্যদান নিয়ে আদালতে মামলা করেন সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। আদালত তাঁকে সাক্ষ্য দিতে নির্দেশ দেয়।
১৯৯৩-এর ২১ জুলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যুব কংগ্রেসের রাইটার্স বিল্ডিংস অভিযান ঠেকাতে পুলিশের গুলিতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় ২৫ জন। ওই ঘটনায় খোদ পুলিশ হাসপাতাল থেকে আহত পুলিশ কর্মীদের চিকিত্সা সংক্রান্ত নথিও মেলেনি। মমতা ওডিশা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে তদন্ত করান।
তত্কালীন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার, অতিরিক্ত কমিশনার দীনেশ বাজপেয়ী, যুগ্ম কমিশনার আর কে জহুরি, ডিসি সাউথ এম কে সিং, মহাকরণের নিরাপত্তার ডিসি কানোয়ালজিত্ সিং প্রমুখ পদস্থ অফিসার সহ সাড়ে তিনশর বেশি লোকের সাক্ষ্য নেন। ২০১৪-র এপ্রিলে কমিশনের তরফে রিপোর্ট পেশ করা হয়। গুলিচালনার নির্দেশের ইঙ্গিত ছিল পরোক্ষভাবে তত্কালীন স্বরাষ্ট্রসচিব মণীশ গুপ্তর দিকে। কিন্তু রিপোর্ট ফাইলবন্দি হয়ে থাকে।
কারণ মণীশবাবু তখন নিজেই ছিলেন এক মন্ত্রী। ১৯৯৯ সালের ৬ জুন মহাহুল উত্সব ঘিরে পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনায় লরি চাপা পড়ে ২৩ জনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তদন্ত কমিশন তৈরি করান। তদন্তে নেমে বিচারপতি নিখিলনাথ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন কমিশন নাজেহাল হয়।
প্রথম দিকে সাক্ষী সংগ্রহ করতে নাস্তানাবুদ হতে হয় এই কমিশনকে। পরে ২৫ জনের সাক্ষ্য সংগ্রহ করতে পারলেও থানা থেকে কোনও নথি মেলে নি। সাক্ষীদের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত কোনও তথ্য সাক্ষ্যগ্রহণের সময়ও উঠে আসেনি। ২০০৮-এর পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরে বিডিও কল্লোল শুরের (৩০) অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়।
অভিযোগ ছিল, কিছু প্রভাবশালী সিপিএম নেতার চাপ সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেন। ২০১১ সালে কিড স্ট্রিটে এমএলএ হোস্টেল থেকে পড়ে মারা যান প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক মোস্তাফা বিন কাসেম। এর কয়েক দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মমতা। ঘটনার খবর পেয়ে তিনি অকুস্থলে চলে যান।
উত্তর বসিরহাটের বিধায়ক কাসেম সাহেবের সঙ্গে তাঁর দলের মানে সিপিএম-এর কিছু নেতার মতানৈক্য চলছিল। কল্লোল শুর এবং মোস্তাফা বিন কাসেম- এই দুই মৃত্যুর তদন্তেই বিচারবিভাগীয় কমিশন তৈরির নির্দেশ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কমিশনের রিপোর্টে দু’টিকেই আত্মহত্যা বলে মন্তব্য করে। ২০১১-র ডিসেম্বর মাসে আমরি হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ড মারা যান ৯২ জন।
বছর পাঁচ বাদে, মানে এখন থেকে বছর পাঁচ আগে এনিয়ে চার্জ গঠন করে আলিপুর আদালত। কিন্তু বিচারবিভাগীয় কমিশন তদন্ত শেষ করতে পারেনি। ২০১৪-র ১৮ ডিসেম্বর মমতা অভিযোগ করেন সিবিআই পিএমও-র মত আচরণ করছে। বাম আমলে এ রাজ্যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে বারবার সরব হয়েছেন তিনি।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এ রাজ্যে তিনি যে সব তদন্ত কমিশন করেছেন, সেগুলোর হালও রীতিমত হতাশাজনক। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ অনুগামীরা অবশ্য দাবি করেছেন, প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই নথি লোপাট তদন্তে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। থানা, এমনকি আদালতেও মেলেনি নথিপত্র। অনেক তদন্তে সাক্ষীই মেলেনি।
সে সব কারণেই প্রহসনে পর্যবসিত হয়েছে তদন্ত কমিশনগুলো। বাম আমলেও নানা সময়ে কমিশন হয়েছে। কিন্তু সেগুলোরও নিট ফল ছিল শূন্য। যেমন ওয়াকফ কেলেঙ্কারি।
অভিযোগ, বাম নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই কেলেঙ্কারি হয়েছিল। অন্তত এক হাজার কোটি টাকার জমি নয়ছয়ের অভিযোগের তদন্ত কমিশন হয়। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ১৯৯৭-এর মার্চ মাসে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গীতেশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে এই দায়িত্ব দেন। প্রায় পাঁচ বছর বাদে ২০০১-এর ৩১ ডিসেম্বর পেশ হয় ১৩৫৫ পৃষ্ঠার রিপোর্ট। ব্যাস সেটি চলে যায় হিমঘরে। এরকম নিদর্শন রয়েছে বিস্তর।