ভাষার গৌরব-সম্পাদনী সভা-সমিতি এবং সারস্বত প্রতিষ্ঠান তখনই কার্যকরী, সাফল্যমণ্ডিত হবে, যখন ধ্রুপদী স্বীকৃতি পাওয়া ভারতীয় ভাষাগুলিতে স্নাতকোত্তর পঠনপাঠন এবং গবেষণার প্রয়োজনীয় গ্রন্থ রচিত হবে। বিদ্যার্থীরা সেই ভাষায় গবেষণা অভিসন্দর্ভ লেখার, জমা দেওয়ার এবং তার মূল্যায়নের অনুমতি চাইতে পারবে কর্তৃপক্ষের কাছে। কৃষিবিজ্ঞানের গবেষণা পত্রিকাগুলি যখন ভারতীয় ধ্রুপদী ভাষাগুলিতে বিজ্ঞান-প্রবন্ধ ছাপাবে। কিন্তু তার মানে এই নয়, ইংরেজি বা অন্যান্য চালু ভাষায় গবেষণা অভিসন্দর্ভ লেখা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। নতুন ভাষার সঙ্গে ভাব হয়েছে মানে, মাতৃভাষা ভুলে যাবো না।
ধ্রুপদী বাংলার কার্যকরী বিকাশের জন্য চাই ‘ভারতীয় বঙ্গবিদ্যা সংস্থান’ (Indian Institute of Bengal Studies), দাবী উঠেছে সচেতন রাষ্ট্রহিতৈষীদের মধ্যে। সম্প্রতি বাংলা ভাষা কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। অতএব, বাঙালি এই মর্যাদায় আনন্দিত এবং উৎফুল্ল। তারা চাইছে এবং চাইবে এই ভাষাকে কেন্দ্র করে বোধের বিকাশ এবং ভাষাগত সমৃদ্ধি, মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাক, হতে পারে, বাংলাভাষায় উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত করা। এরজন্য যা প্রয়োজনীয়, তা হল গ্র্যাজুয়েশন এবং পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের বইপত্র বাংলার রচনা করা। এটা তখনই সম্ভব যখন বাংলাভাষায় কৃষিবিজ্ঞানের যথাযথ পরিভাষা রচনার কাজটি সম্পন্ন হবে। এরজন্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদের প্রতিটি বিভাগে পারদর্শীদের নিয়ে কমিটি গঠন করে দিতে হবে, সঙ্গে বাংলার বিশেষজ্ঞ হিসাবে জুড়ে দিতে হবে বাংলাভাষার প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপকবৃন্দকে। আগামী ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে যেন তৈরি হয়ে যায় বিভাগীয় পরিভাষা রচনা ও সংকলনের কাজ। প্রয়োজনে মাসিক কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। যদি এ বিষয়ে কিছু কাজ আগে হয়ে থাকে, তার সংকলনও রেফারেন্স হিসাবে গৃহীত হতে পারে। এখানে কৃষিবিজ্ঞান বলতে সামগ্রিক কৃষির সমস্ত শাখাপ্রশাখাকে ধরা হচ্ছে — ভৌমকৃষি (Agronomy and Horticulture), পশুসম্পদ: পালন ও চিকিৎসা (Veterinary Science), দোহবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (Dairy Technology) মৎস্যচাষ ও শিকার (Inland and Marine Fishery), রেশমচাষ (Sericulture), বনবিজ্ঞান (Forestry), কৃষি কারিগরি (Agricultural Engineering) ইত্যাদি। বিভাগ অনুযায়ী পরিভাষার বর্ণানুক্রমিক তালিকা প্রস্তুত করবার পর সংশ্লিষ্ট অনুষদের ফ্যাকাল্টি কাউন্সিলের বর্ধিত সভায় তার তুল্যমূল্য বিচার করতে হবে। বিভিন্ন বিভাগ থেকে কোনো একটি নির্দিষ্ট ইংরেজি টার্মের আলাদা আলাদা বাংলা পরিভাষা তৈরি করা হয়ে থাকলে, তার সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে।
এই কাজে পথ দেখাতে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার সমস্ত কৃষিবিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কৃষি অনুষদের পারদর্শী শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ও পারদর্শিতায় বাংলাভাষায় আন্তর্জাতিক মানের আন্তর্বিদ্যাশৃঙ্খলার গবেষণা পত্রিকা (Interdisciplinary Agricultural Journals) প্রকাশিত হোক। ইংরেজি ভাষায় যেভাবে, যে পরিবেশনে ও উপস্থাপনায় গবেষণা প্রবন্ধগুলি লেখা হচ্ছে, সেই একই আদলে সম্পূর্ণ বাংলাভাষায় গবেষণা পত্র প্রকাশ করা দরকার। কেবল তার সঙ্গে গবেষণার সারসংক্ষেপ (Abstract) বাংলা ও ইংরেজি যৌথভাষায় থাকতে পারে।
নতুন শিক্ষা নীতি (NEP, 2020)-র প্রেক্ষিতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পঠনপাঠনের জন্য কমিটি যে সুপারিশগুলি করেছেন এবং তাতে যে নতুন পাঠ্যসূচী রয়েছে, তাকে অনুসরণ করেই উচ্চ শিক্ষার বই রচনা করা দরকার। এজন্য এ রাজ্যের অধ্যাপক-শিক্ষকেরা যদি ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে ক্লাসে বাংলা এবং ইংরেজি এই দুইভাষায় (Bilingual) যথাসম্ভব শিক্ষাদানের কাজ শুরু করেন, তবে সামগ্রিকভাবে একটি নতুন উৎসাহের সূচনা ঘটবে এবং পুস্তক প্রকাশক ও পুস্তক বিপণীগুলির উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাভাষায় শারদীয়া পত্রপত্রিকার সম্ভার বাড়িয়ে কেবল বাংলার মর্যাদা বৃদ্ধি সম্ভব নয়, প্রয়োজন এই ভাষায় উচ্চ শিক্ষা এবং প্রয়োজনীয় পুস্তক রচনা। আর দরকার অবাঙালিদের জন্য বাংলা শেখার প্রতিষ্ঠান Directorate of Bengali (বাংলা অধিকরণ)। কৃষিবিজ্ঞান, কৃষিবিপণন, প্রশাসনিক নানান কাজে লিপ্ত অবাঙালিদের জন্য বাংলা ভাষাশিক্ষার সহজপাঠে কৃষি ও গ্রামোন্নয়নে ব্যবহৃত পরিভাষা দিয়ে তৈরি হোক শিক্ষণীয় বাক্য ও অনুচ্ছেদ।
পরিশেষে দূর করতে হবে এই মানসিকতা যে ‘বাংলাভাষায় উচ্চশিক্ষা আদৌ সম্ভব নয়।’ এত বছর আগে থেকে এত সমৃদ্ধ ভাষা, যে ভাষার লেখক নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী হয়েছেন, যে ভাষায় এত কোটি মানুষ সারাবিশ্বে কথা বলেন, লেখেন, পড়েন — সেই ভাষায় উচ্চশিক্ষা সম্ভব নয় কেন? বাংলা ভাষার দীনতা কোথায়? মহাভারতীয় প্রেক্ষাপটে বঙ্গভাষা ও সংস্কৃতি একটি উল্লেখযোগ্য উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য। বাঙালি শিক্ষাবিদের সমবেত প্রচেষ্টায় এই ভাষার প্রাণপ্রবাহে জোয়ার আসুক। এই প্রস্তাব কেবল বাংলাভাষার জন্য প্রযোজ্য নয়; ওড়িয়া, অসমীয়া সহ অন্যান্য ধ্রুপদী ভারতীয় ভাষার জন্যও প্রযোজ্য।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়
ছবি: গোপী ঘোষ