“২২শে এপ্রিল, ১৯৩০ সাল। চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে প্রথম বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ হয়েছিলো! ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখার অসীম সাহসী যুবকরা সেদিন মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে অপরাক্রান্ত (!) ব্রিটিশবাহিনীর সাথে সশস্ত্র সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে শহীদের মৃত্যুবরণ করেছিলো। সেই দিনের অসম যুদ্ধে বারজন বিপ্লবী সাথীকে হারিয়েও তাঁরা আত্মসমর্পণ না করে নিরবচ্ছিন্নভাবে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সিপাই বিদ্রোহের পর ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’, স্বাধীনতার দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ‘যুদ্ধ’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।“
এভাবেই অজয় সেন শুরু করেছেন তাঁর ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ এবং আজীবন বিপ্লবী বিধুভূষণ সেন’ বইয়ে ‘লেখকের কথা’। ১৯৩০ সালের সেই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকা ধিকি ধিকি আগুন নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন চট্টগ্রামের অকুতোভয় একটা প্রজন্ম। প্রায় একশ বছর আগের সেই পটভূমি নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। গবেষণা-সিনেমা হয়েছে। কিন্তু এই বই একটু অন্য স্বাদের।
আলোচনার শুরুতে অজয় সেন সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত। জন্ম ১৭ এপ্রিল, ১৯৫২। তিনি বিপ্লবী বিধুভূষণ সেনের পঞ্চম পুত্র, ছাত্রাবস্থাতেই চলে আসেন এপার বাংলায়। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী, পেশায় ছিলেন গণিতের শিক্ষক। ‘বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থা’র জন্মলগ্ন থেকে এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে এর যুগ্ম সম্পাদক। স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে যাঁরা একনিষ্ঠভাবে চর্চা করেন, তাঁরা অনেকেই বইটি পড়েছেন বা এর কথা শুনেছেন। কিন্তু এ রকম বইয়ের পাঠকসংখ্যা যত বাড়ে ততই ভাল। বইটি সম্পর্কে অজয়বাবু লিখেছেন, “আজ এখানে চট্টগ্রামের জালালাবাদ যুদ্ধের অন্যতম সৈনিক, বিপ্লবী বিধুভূষণ সেনের বর্ণময় জীবন ও তাঁর ঘটনাবহুল যুগের এক অকপট ঘরোয়া উপস্থাপনার চেষ্টা করা হল।“
‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ এবং আজীবন বিপ্লবী বিধুভূষণ সেন’ বইয়ে রয়েছে আটটি অধ্যায়। এগুলো হল—
১। ভূমিকা,
২। চুম্বকে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ : গণেশ ঘোষ, ৩। জালালাবাদ যুদ্ধের সৈনিক এবং ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির শেষ জীবিত বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর স্মৃতিচারণ, ৪। চট্টগ্রাম বিপ্লবীদলের সংবিধানের অংশ বিশেষ,
৫। কথামুখ‘
৬। চট্টগ্রামের বিপ্লবী সংগঠন ও জালালাবাদের যুদ্ধ,
৭। তাঁহাদের কথা,
৮। সহযোদ্ধাদের স্মরণে বিধু সেন।
তৎকালীন চট্টগ্রাম ও তার আন্দোলনের পুংঙখানুপুঙখ চিত্র ফুটে উঠেছে পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর (তখনও তিনি প্রধানমন্ত্রী হননি) Glimpses of world History তে। যেখানে তিনি লিখেছেন, “There were a number of acts of terrorism by these revolutionaries, most of them in Bengal. There events, however, attracted special attention…… The third occurence was in Chittagong in 1930 just about the time when civil Disobedience movement was begining. It was a daring and big-scale raid on the armoury, and it met with some success. The Government adopted every conceivable device to crush this movement. There were spies and informers and large number of arrests and conspiracy cases, and detenus (some times people, acquitted in a court of law, were immediately re-arrested and kept as detenus under the Ordinance), and parts of East Bengal were under military occupation, and people could not move without permits, nor could they go on bicycles, or even wear any dress they chose There were heavy fines on whole towns and villages for the offence of not giving information to the police. ‡Page 728, Ninth impresion, 1994 1st pub.in 1934-35)।
এ রকম একটা জ্বলন্ত তথা সম্মুখ সমরের অধ্যায় ছিল চট্টগ্রাম যুব অভ্যত্থান। সময়ের দলিলে একে ধরে রাখা সত্যিই কঠিন কাজ। নিঃসন্দেহে ভাবনার নির্যাস এবং লেখনি— এই দুইয়েই সাফল্য দেখিয়েছেন অজয় সেন। ’সেন পরিবারের সংকট, পিতার মৃত্যু এবং কারান্তরালে বিধু সেন’— এই পরিচ্ছেদ তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের মর্মন্তুদ ছবি— “কনিষ্ঠ পুত্র কারান্তরালে ভারতবর্ষের এক জেল থেকে অন্য জেলে তাকে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। জ্যেষ্ঠ পুত্র বিভূতিভূষণ ছোট ভাইয়ের রাজদ্রোহের কারণে সরকারী ট্রেজারির চাকরী থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। একমাত্র কন্যা অর্থ উপার্জনের তাগিদে নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে শিক্ষিকার চাকরী গ্রহণে বাধ্য হয়ে চলে গিয়েছেন অসম প্রদেশে। দীর্ঘ রোগভোগ ও পুত্রশোকে পিতা প্যারীমোহনের এই সময় স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়।
কক্সবাজার থেকে বহু দূরে জেলের অভ্যন্তরে হঠাৎ বিধু সেন পেলেন সেই মর্মান্তিক দুঃসংবাদটি। পিতার মৃত্যু সংবাদ! মাত্র ঊনষাট বছর বয়সে সেন পরিবারের প্রবীণতম গৃহকর্তা প্যারীমোহন সেন ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন তার প্রিয় সমুদ্রশহর কক্সবাজারে। গোলদীঘির পাড়ের আশ্রমতুল্য ছোট বাটিতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন তাঁর পাশে ছিলেন জ্যেষ্ঠ পুত্র বিভূতিভূষণ, কন্যা ননীবালা, স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। তাদের উপস্থিতিতে প্যারীমোহন সজ্ঞানে বড়পুত্রকে অবশ্য পালনীয় কয়েকটি কঠোর নির্দেশ দিয়ে যান। জীবনের চরমতম দুঃসংবাদটি বিধু সেনকে জানাতে দেরি করেন জেলের কর্তারা। মাত্র কয়েক ঘন্টার প্যারলে সশস্ত্র প্রহরায় তাকে কক্সবাজার যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে বিধু সেন যখন কক্সবাজার পৌঁছান ততক্ষণে পিতার শবদাহকর্ম সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গিয়েছে। পিতার শেষ নির্দেশটি তিনি বড়দা বিভূতিভূষণের কাছে জানতে পারেন। পিতা তাকে যাবতীয় পারলৌকিক কাজ ও অশৌচ পালন থেকে বিরত থাকতে বলে গিয়েছেন। পিতা মৃত্যুর আগে নির্দেশ দেন,—তাঁর সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন, ফটোগ্রাফ, ছবি, সরকারী স্মারক ও প্রাপ্ত সামগ্রীর যেন কোনও চিহ্ন রাখা না হয়। আর তাঁর নশ্বর শরীর যেন কক্সবাজার সমুদ্রতটে দাহ করা হয়, জলের কাছাকাছি। এমন একটা জায়গায়, যেখানে জোয়ারের জল আসে। শবদাহের পর জোয়ারের হলে চিতাকাঠ ও পার্থিব জীবনের সব অবশেষ যেন জলস্রোতে (কালসাতে!) নিঃশেষে ধুয়েমুছে যায়।“
বিভিন্ন অধ্যায়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিধুভূষণ সেনের জীবনে মাস্টারদা সূর্য সেনের প্রভাবের কথা। বিধুভূষণের ভাবনাকে কতটা আন্দোলিত করেছিল তাঁর প্রীতিদি (ওয়াদ্দেদার), রয়েছে তার সবিশেষ আখ্যানও। বইতে তুলে ধরা রয়েছে প্রীতিলতার মৃতদেহ তল্লাশিতে পাওয়া বিবৃতির অংশ বিশেষ— “আমার বিস্ময় জাগে এই ভেবে, মহৎ উদ্দেশ্যে হত্যা করেছে অনুপ্রাণিত সংগ্রামে নারী-পুরুষের মধ্যে তারতম্য কেন থাকবে? যদি সত্যাগ্রহ আন্দোলনে বোনেরা ভাইদের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়াতে পারে। তবে বিপ্লবী আন্দোলনের অংশভাগী হবার অধিকারী তারা কেন হবে না? এর কারণ কি এই যে, দুটো আন্দোলনের ধারা ভিন্ন, না মেয়েরা বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণের যোগ্য নয়? সশস্ত্র বিপ্লবের পদ্ধতি সম্বন্ধে বলা যায়, এ পদ্ধতি নতুন কিছু নয়। বহু দেশ এই পদ্ধতি অবলম্বন করে সাফল্য লাভ করেছে এবং তাতে নারীরা শ’য়ে শ’য়ে যোগদান করেছে। তবে কেন শুধু ভারতবর্ষেই এই পদ্ধতিকে জঘন্য বলে মনে করবে?”—প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
মাস্টারদার মূলশিক্ষার কথা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার তাঁর সুইসাইড নোটে ‘নারীদের প্রতি আহ্বান’-এ লেখেন; “স্বাধীনতা লাভ করার পথে তাহারাই (ইংরেজ) আমাদের অন্তরায়। যদিও মানুষের জীবন সংহার করা অন্যায়, তবুও বাধ্য হইয়া অত্যাচারী সরকারী কর্ম্মচারী ও ইংরেজদের জীবন সংহার করিতে আমরা অস্ত্রধারণ করিয়াছি।“
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনায় এসে যাওয়া চরিত্রদের কথা রয়েছে ১৬০ পৃষ্ঠার এই শক্ত মলাটের এই বইয়ে। একে পুষ্ট করেছে গবেষক-অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুন্দর ভূমিকা, (বিধুভূষণ) সেন পরিবারের বেশ কয়েক পুরুষের বংশলতিকা, ১৯৭০ সালে তৈরি বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থার কর্মকর্তাদের নাম-তালিকা, একগুচ্ছ চিঠি এবং প্রচুর প্রাসঙ্গিক ছবি। এক কথায়, সমকালকে দুই মলাটের মধ্যে ধরে রাখার দুরূহ কাজে সাফল্য দেখিয়েছেন অজয় সেন।