মলদ্বীপে আসছে চিনের গুপ্তচর জাহাজ! ভারতের উপর চাপ বাড়াতেই কি নতুন কৌশল মুইজ্জুর?

নয়াদিল্লির উদ্বেগ বাড়িয়ে এ বার মলদ্বীপে ঘাঁটি গাড়তে চলেছে চিনা গুপ্তচর জাহাজ। ‘শিয়াং ইয়াং হং-৩’ নামে ওই জাহাজটি ইতিমধ্যেই দক্ষিণ চিন সাগর থেকে মলাক্কা প্রণালী পেরিয়ে ইন্দোনেশিয়ার জাভা এবং সুমাত্রা দ্বীপপুঞ্জের মধ্যবর্তী সুন্দা প্রণালীতে পৌঁছেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই সেটি ভারত মহাসাগরে ঢুকে পড়তে পারে। ৮ ফেব্রুয়ারি চিনা চর জাহাজ মলদ্বীপের রাজধানী মালেতে পৌঁছবে বলে এনডিটিভিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

নয়াদিল্লি-মালে কূটনৈতিক টানাপড়েন এবং মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুর সাম্প্রতিক চিন সফরের পরেই এই ঘটনা ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছেন সামরিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ। ঘটনাচক্রে, চিন সফর থেকে ফিরেই মুইজ্জু মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা সরানোর জন্য ১৫ মার্চের ‘চরম সময়সীমা’ ঘোষণা করেছেন। ২০১০ সাল থেকে একটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অংশ হিসেবে প্রায় ১০০ জন ভারতীয় সেনা মলদ্বীপে রয়েছেন।

গত কয়েক বছরে চিনা নজরদার জাহাজ ‘ইউয়ান ওয়াং ৫’, ‘হাই ইয়াং ২৪ হাও’ এবং ‘শি ইয়ান ৬’ ভারতের প্রতিবেশী আর এক দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরে সাময়িক ঘাঁটি গেড়েছিল। যা নিয়ে নয়াদিল্লি-কলম্বো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ শুরু হয় বলে বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর। ‘শিয়াং ইয়াং হং-৩’-এরও হাম্বানটোটায় নোঙর করার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের আপত্তিকে মর্যাদা দিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের সরকার চিনা চর জাহাজকে সে দেশে ভিড়তে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

এই পরিস্থিতিতে মলদ্বীপের ‘চিনপন্থী’ মুইজ্জুর পদক্ষেপ সরাসরি ভারতের সঙ্গে সংঘাতের বার্তা বলে কূটনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন। বিশেষত, মুইজ্জুর দলের তিন মন্ত্রীর (বর্তমানে সাসপেন্ড) প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী মন্তব্যের জেরে দু’দেশের কূটনৈতিক টানাপড়েনের আবহেই সেখানে চিনা চর জাহাজের আগমন নতুন করে অশান্তির অনুঘটক হতে পারে। প্রসঙ্গত, গত ১১ জানুয়ারি চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সে দেশের রাজধানী বেজিংয়ে বৈঠক করেন মুইজ্জু। সেখানেই ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাতের আবহে মলদ্বীপের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছিলেন জিনপিং। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ওই বৈঠকেই চিনকে তাঁদের ‘পুরনো বন্ধু এবং ঘনিষ্ঠতম সহযোগী’ বলেন মুইজ্জু।

সরকারি ভাবে বেজিং অবশ্য চর জাহাজের অস্তিত্বই স্বীকার করেনি। চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সরকারের দাবি, আগামী ৫ জানুয়ারি থেকে মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ভারত মহাসাগরে ‘গভীর সমুদ্র সংক্রান্ত গবেষণা’র কাজে যুক্ত থাকবে ‘শিয়াং ইয়াং হং-৩’। এর আগে শ্রীলঙ্কায় চর জাহাজের উপস্থিতি নিয়েও তারা ‘সমুদ্র গবেষণা’র কথা বলেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সামরিক পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলির রিপোর্ট বলছে, অতীতে শ্রীলঙ্কার বন্দরকে পোতাশ্রয় হিসাবে ব্যবহার করে ভারতীয় নৌসেনা গতিবিধি এবং ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার উপর নজরদারির কাজ করে ওই জাহাজগুলি। এ বার তার ঠিকানা মলদ্বীপ।

মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে ‘চিনপন্থী’ নেতা মুইজ্জু দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ভারতের বিরুদ্ধে একের পর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যা নিয়ে নয়াদিল্লি-মালে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের একাধিপত্যের মোকাবিলা করতে সক্রিয় মোদী সরকার। আমেরিকার নেতৃত্বে গড়া কোয়াড-এ তারা প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। কিন্তু তার আগে সমুদ্রপথ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগে পড়ছে সাউথ ব্লক। তার অন্যতম কারণ ‘চিন-ঘনিষ্ঠ’ মুইজ্জু। প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি মলদ্বীপে মোতায়েন ভারতীয় সেনাকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। সম্প্রতি, তিনি নয়াদিল্লির সঙ্গে চার বছরের পুরনো জলচুক্তি বাতিলের কথা ঘোষণা করেন। ওই চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় নৌবাহিনীর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সাহায্য করার জন্য মলদ্বীপের জলসীমায় ‘হাইড্রোগ্রাফিক’ সমীক্ষা চালানোর অনুমতি মিলত। চুক্তি বাতিলের ফলে তা বন্ধ হয়েছে।

টানাপড়েনের এই আবহে চলতি মাসের গোড়ায় ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লক্ষদ্বীপে গিয়েছিলেন মোদী। সেই সফরের বেশ কিছু ছবি এবং ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়। অভিযোগ, মলদ্বীপের তিন মন্ত্রী, মরিয়ম শিউনা, মালশা শরিফ এবং মাহজ়ুম মাজিদ কিছু ছবিতে মোদীকে ‘পুতুল’ এবং ‘জোকার’ বলে মন্তব্য করেন। ভারত-ইজ়রায়েল সম্পর্ক নিয়েও আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়। পরে অবশ্য বিতর্কের মুখে পোস্টগুলি মুছে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মলদ্বীপের বিরোধী নেতাদের চাপের মুখে তিন মন্ত্রীকে সাসপেন্ড করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু। কিন্তু সংঘাতের পরিস্থিতি তাতে প্রশমিত হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.