ঠিক পাঁচ বছর আগে এমনই এক ডিসেম্বরে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর কাছে ‘সুখবর’ এসেছিল রায়পুর থেকে। টানা দেড় দশকের বিজেপি শাসনের ইতি টেনে ছত্তীসগঢ়ের বিধানসভা ভোটে দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা পেয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু পাঁচ বছরের মাথাতেই মধ্যপ্রদেশে ভেঙে গঠিত জনজাতি অধ্যুষিত রাজ্যে মুখ থুবড়ে পড়়ল তারা। জেতা এবং এগিয়ে থাকার প্রবণতা বলছে, রাহুল-মল্লিকার্জুন খড়্গের দলের আসনসংখ্যা ২০১৮-র তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসতে চলেছে।
৯০টি আসনের ছত্তীসগঢ় বিধানসভায় সরকার গড়ার ‘জাদুসংখ্যা’ ৪৬। জেতা এবং এগিয়ে থাকার প্রবণতা অনুযায়ী বিজেপি ৫০-এর বেশি আসনে জিততে চলেছে। কংগ্রেস ৩৫টি ছুঁতে পারে। মায়াবতীর বিএসপি এবং জনজাতি দল গন্ডোয়ানা গণতন্ত্র পার্টি (জিজিপি) একটি করে আসনে জিততে চলেছে। বিজেপির উল্লেখযোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ (রাজনন্দগাঁও), দলের রাজ্য সভাপতি তথা বিলাসপুরের সাংসদ অরুণ সাউ (লোরমি), কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রেণুকা সিংহ, রায়গড়ের সাংসদ গোমতী সাই (পাতালগাঁও), প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিষ্ণুদেও সাই (কুনকুরি) রয়েছেন।
কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বঘেল পাটন আসনে এগিয়ে রয়েছেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তথা দুর্গের সাংসদ বিজয় বঘেলের চেয়ে। বিজয় সম্পর্কে ভূপেশের ভাইপো। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা রাজ্য বিধানসভার বিদায়ী স্পিকার চরণদাস মহন্ত (শক্তি)-ও জিততে চলেছেন। তবে উপমুখ্যমন্ত্রী টিএস সিংহদেও (অম্বিকাপুর) এবং ছত্তীসগঢ় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি দীপক বৈজ (চিত্রকোট)-এর মতো ওজনদার নেতারা তাঁদের বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় পিছিয়ে।
২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটে দেড় দশকের বিজেপি শাসনের ইতি ঘটিয়ে প্রথম বার বিধানসভা ভোটে জিতে ছত্তীসগঢ়ে ক্ষমতা দখল করেছিল কংগ্রেস। রাজ্যের ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৬৮টি জিতেছিল তারা। বিজেপি মাত্র ১৫টি। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজিত জোগীর হাতে গড়া দল ‘জনতা কংগ্রেস ছত্তীসগঢ়’ (জেসিসি) পাঁচটি এবং তার সহযোগী বিএসপি দু’টি বিধানসভা আসনে জয়ী হয়েছিল। কংগ্রেস ৪৩ এবং বিজেপি ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এ বার বিজেপি পেয়েছে ৪৬ শতাংশের বেশি ভোট। কংগ্রেসের ঝুলিতে গিয়েছে ৪২ শতাংশের সামান্য বেশি। তৃতীয় স্থানে থাকা বিএসপি পেয়েছে আড়াই শতাংশ ভোট। তবে গত পাঁচ বছর ধরে নিষ্ক্রিয় রাজ্যনেতারা নন, রায়পুরের কুর্সিতে ফিরতে এ বার ‘মোদীত্বেই’ ভর করেছিল বিজেপি। ভোটের ফল বলছে, সেই রণকৌশল সফল হয়েছে পুরোপুরি।
২০১৩-য় দরভা ভ্যালিতে মাওবাদী হামলায় বিদ্যাচরণ শুক্ল, মহেন্দ্র কর্মা, নন্দকুমার পটেলের মৃত্যুতে ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেসের প্রথম সারি কার্যত মুছে গিয়েছিল। জোগী বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রদেশ সভাপতি ওবিসি নেতা ভূপেশ, চরণদাস মহন্ত, তমরধ্বজ সাহুর সঙ্গে রাজপুত টিএস (ত্রিভুবনেশ্বর শরণ) সিংহদেওর মতো নেতারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। সঙ্গে যোগ হয়েছিল ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা রমন সিংহ সরকারের বিরুদ্ধে জমে ওঠা ক্ষোভ। ২০১৮-র বিধানসভা ভোটে তারই সুফল পেয়েছিল কংগ্রেস। ভোটের পরে মুখ্যমন্ত্রিত্ব নিয়ে ভূপেশ বনাম টিএসের লড়াই হয়েছিল। পরবর্তী পাঁচ বছরেও তা বারে বারে সামনে এসেছিল। এমনকি, বঘেল অনুগামী এক বিধায়ক প্রকাশ্যে টিএসের বিরুদ্ধে তাঁকে খুনের চক্রান্ত করার অভিযোগ তুলেছিলেন। চাপের মুখে রাহুল-খড়্গেরা চলতি বছরের জুনে টিএস-কে রাজ্যের উপ মুখ্যমন্ত্রিত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশের সঙ্গে তাঁর সমীকরণ মসৃণ হয়নি।
ভোটপণ্ডিতদের একাংশ মনে করেছিলেন, এ বার প্রচারপর্বের শেষবেলায় মূলত দু’টি বিষয় কংগ্রেসের বিপক্ষে গিয়ে থাকতে পারে। প্রথমত, মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশের বিরুদ্ধে ‘মহাদেব বেটিং অ্যাপ’ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ। দ্বিতীয়, প্রভাবশালী দলিত জনগোষ্ঠী সতনামী সমাজের অবিসংবাদিত নেতা গুরু বালদাসের বিজেপিকে সমর্থন। অন্যদিকে, কংগ্রেসের দাবি ছিল বঘেলের বিরুদ্ধে ভোটের ঠিক আগেই কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি-র ‘অতি সক্রিয়তা’ ব্যুমেরাং হবে বিজেপির কাছে।
ভোটের ফল বলছে, ইডি-র ‘অতিসক্রিয়তা’ নিয়ে কংগ্রেসের প্রচারে সাড়া মেলেনি। বরং এক মাসে বিজেপির ‘মহাদেব’ প্রচার ছাপ ফেলেছে ছত্তীসগঢ়বাসীর মনে। প্রসঙ্গত, গত ৩ নভেম্বর ইডি-র তরফে দাবি করা হয়েছিল, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভিলাই থেকে অসীম দাস নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে তারা। কেন্দ্রীয় সংস্থাটির অভিযোগ ছিল, কংগ্রেসের নির্বাচনের খরচ জোগাতে ওই ব্যক্তিকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে পাঠিয়েছিলেন ‘মহাদেব’ অ্যাপের মালিকেরা। ইডি-র দাবি, ‘বঘেল’ নামে এক রাজনীতিককে দেওয়ার জন্য অসীম ৫.৩৯ কোটি টাকা নিয়ে এসেছিলেন দুবাইয়ে আশ্রয় নেওয়া ‘মহাদেব অ্যাপ’-এর মালিকের কাছ থেকে।
এর পরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং ভোটপ্রচারে ছত্তীসগঢ়ে গিয়ে নিশানা করেন বঘেলকে। পরবর্তী সময়ে ‘মহাদেব বেটিং অ্যাপ’-এর মালিক শুভম সোনি সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে একটি ভিডিয়ো বার্তায় (যার সত্যতা আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করেনি) বঘেলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কথা স্বীকার করেন। অন্য দিকে, ছত্তীসগঢ়ের অন্তত এক ডজন আসনে ‘নির্ণায়ক শক্তি’ (মোট ভোটার সংখ্যার ১৬ শতাংশ) সতনামীদের একাংশ বিজেপিকে ভোট দেওয়ায় ঘটেছে ‘হাত’-এর। প্রসঙ্গত, গত বারের ভোটে বালদাস কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিলেন।
বিএসপি, জিজিপির পাশাপাশি প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জোগী প্রতিষ্ঠিত দল ‘জনতা কংগ্রেস ছত্তীসগঢ়’, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রভাবশালী আদিবাসী নেতা অরবিন্দ নেতমের নতুন দল ‘হামার রাজ পার্টি’ এবং মূলত আদিবাসী খ্রিস্টানদের সংগঠন ‘সর্ব আদি দল’ও কংগ্রেসের ভোটে ভাগ বসিয়ে বিজেপির সুবিধা করে দিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী বঘেল এ বার ভোটের প্রচারে কৃষিঋণ মকুব, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, ধানের দাম কুইন্টাল প্রতি ৩২০০ টাকা করা, একর প্রতি ২০ কুইন্টাল ধান কেনা, গ্যাসের সিলিন্ডারে ৫০০ টাকা ভর্তুকির মতো ‘জনমুখী প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের অনুকরণে মহিলাদের মাসে ১৫ হাজার টাকা আর্থিক অনুদানের কথাও ঘোষণা করেছিলেন বঘেল। একদা মোদীর কটাক্ষের শিকার ‘রেউড়ি (খররাতি) রাজনীতি’ অনুসরণে পিছিয়ে ছিল না ‘পদ্ম’ও। রমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, চতুর্থবার মুখ্যমন্ত্রী হলে মহিলাদের মাসে হাজার টাকা করে দেবেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সেই প্রতিশ্রুতিতেই ভরসা রেখেছে ছত্তীসগঢ়।
তিন দফায় টানা ১৫ বছর মুখ্যমন্ত্রী পদে থেকে বিজেপি নেতা রমন গরিবের মন জয়ে ২ টাকা কেজি দরে ৩৫ কিলোগ্রাম করে চাল বিলি করে ‘চাউলওয়ালে বাবা’ হয়ে উঠেছিলেন। মুফতে স্মার্টফোনও বিলি করেছিলেন। কিন্তু চাষির ঋণ মকুব করতে পারেননি। যা করছিলেন ভূপেশ। পাশাপাশি ‘মাওবাদী উপদ্রুত এলাকা’ বলে চিহ্নিত বস্তার ডিভিশনের সাতটি জেলায় পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা জনজাতি গ্রামগুলিতে গত পাঁচ বছরে উন্নয়নের অস্ত্রে হিংসা নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সাফল্য পেয়েছিলেন তিনি। ছত্তীসগঢ়ের ভোটে সাধারণত জনজাতিদের বড় ভূমিকা থাকে। জনজাতি এলাকায় কংগ্রেসের ভোট বরাবরই বেশি। ২০১৩-য় রমন তৃতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হলেও অধিকাংশ জনজাতি আসন কংগ্রেসের দখলে ছিল। ২০১৮-য় বস্তারের সাত জেলায় নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছিল কংগ্রেস। এ বার কংগ্রেসের সেই ভোটব্যাঙ্কে ধস নেমেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ বলছেন, তার কৃতিত্ব আরএসএসের শাখা সংগঠন বনবাসী কল্যাণ আশ্রমের। গত পাঁচ বছরে আদিবাসী অঞ্চলগুলিতে ধর্মান্তকরণের অভিযোগ তুলে তাদের লাগাতার প্রচারের প্রভাব পড়েছে ইভিএমে।