ব্যবসার অস্তিত্ব ‘কাগজে’, তার বিনিময়ে লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসকে কোটি টাকা ৪ সংস্থার, দাবি ইডি চার্জশিটে

ব্যবসা হয়েছে শুধু খাতায়-কলমে। আর সেই ব্যবসার বিনিময়েই একটি সাইকেল সংস্থা-সহ চারটি সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে কোটি কোটি টাকা। নিয়োগ দুর্নীতি মামলার চার্জশিটে এমনই দাবি করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। ওই সংস্থাগুলির সঙ্গে লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের বৈদ্যুতিক কেটলি, চশমা এবং কার্ডের ব্যবসা হয়েছে বলে ‘ইনভয়েস’ দেখানো হলেও ইডির দাবি, তা হয়নি। বাস্তবে কোনও জিনিসপত্রই কেনাবেচা হয়নি দু’পক্ষের মধ্যে। পুরোটাই রয়েছে শুধুমাত্র নথিতে।

লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থার ডিরেক্টর হিসেবে তৃণমূলের নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও চার্জশিটে উল্লেখ করেছে ইডি। অভিষেক জানিয়েছিলেন, লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থা তাঁর তৈরি। অতীতে সংস্থার ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে ভোটে দাঁড়ানোর সময় সেই পদ থেকে সরে যান। নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তের সূত্রে এই সংস্থা ইডির আতশকাচের নীচে। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তাদের পঞ্চম অতিরিক্ত (সাপ্লিমেন্টারি) চার্জশিটে ওই সংস্থাকে ‘অভিযুক্ত’ হিসাবে দেখানো হয়েছে। সেই চার্জশিটে ইডি দাবি করেছে, বেশ কিছু সংস্থা থেকে লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের অ্যাকাউন্টে প্রচুর টাকা জমা পড়েছে। ইডি মনে করছে, ওই সংস্থাগুলির সঙ্গে আদতে কোনও ব্যবসায়িক লেনদেন হয়নি লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের। কোন কোন সংস্থা থেকে কত টাকা লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করেছে, চার্জশিটে তারও খতিয়ান দিয়েছে ইডি। চার্জশিটের ৫০ নম্বর পাতায় তদন্তকারী সংস্থার দাবি, ‘লক্ষ্মী সাইকেল প্রাইভেট লিমিটেড’ থেকে ১ কোটি ৩৪ লক্ষ ৪ হাজার ৬৮১ টাকা, ‘নবীন এন্টারপ্রাইজ়’ থেকে ১ কোটি ২৪ লক্ষ ৬৭ হাজার ১৯৭ টাকা, ‘এগজ়টিক ইনভেনশন এন্টারপ্রাইজ়’ নামে একটি সংস্থা থেকে প্রায় ১৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, ‘ইন্টিগ্রেটেড ইনভেনশন ট্রেডিং’ সংস্থা থেকে ১০ লক্ষ ৪ হাজার ৫৫৮ টাকা জমা পড়েছিল লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। ওই চারটি সংস্থা থেকে লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের অ্যাকাউন্টে মোট ২ কোটি ৮৩ লক্ষ ২৬ হাজার ৪৩৫ টাকা জমা পড়েছিল বলে চার্জশিটে দাবি করেছে ইডি।

ইডির আরও দাবি, লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের সঙ্গে লেনদেনের বিষয়টি নজরে আসার পরে ‘লক্ষ্মী সাইকেল প্রাইভেট লিমিটেড’-এর দফতরে তল্লাশি চালানো হয়েছিল। সেই তল্লাশির সূত্রে বেশ কিছু নথি তদন্তকারীদের হাতে এসেছে। ইডির দাবি, সেই নথি থেকে তারা জানতে পেরেছে লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের সঙ্গে ওই সংস্থাগুলির কোনও ব্যবসা হয়নি। ‘ভুয়ো’ ব্যবসার ‘ইনভয়েস’ তৈরি করা হয়েছে। সেই ‘ভুয়ো’ ইনভয়েসের বিনিময়েই লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থার অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা জমা দেওয়া হয়েছে বলে দাবি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার। তারা চার্জশিটে দাবি করেছে, ২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ওই বছরের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের অ্যাকাউন্টে লক্ষ্মী সাইকেল প্রাইভেট লিমিটেড সংস্থার অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ১ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকা এসেছে।

পঞ্চম অতিরিক্ত চার্জশিটের ৫৩ নম্বর পাতায় ইডির আরও দাবি, সাইকেল সংস্থার সঙ্গে লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের ব্যবসার কাগজপত্র তৈরি করতেন মনোজ মানহোত। তিনি পেশায় শেয়ার বাজারের দালাল তথা ট্রেডার। সাইকেল সংস্থার মালিক নবীনকুমার গুপ্ত জিজ্ঞাসাবাদের সময় দাবি করেছেন, লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থার অ্যাকাউন্টে যে টাকা পাঠানো হয়েছিল, তা জোগাড় করে দিয়েছিলেন তাঁর দীর্ঘ দিনের বন্ধু মনোজ। সেই টাকা তিনি নিজের সংস্থার অ্যাকাউন্টে জমা করতেন, তার পর সেই টাকা পাঠানো হত লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থার অ্যাকাউন্টে। ওই সংস্থা আদতে কী করত, তা তিনি জানেন না এবং ওই সংস্থার দফতরে কখনও যাননি বলেও ইডির কাছে দাবি করেছেন নবীনকুমার। দাবি করেছেন, মনোজই তাঁকে চশমা, বৈদ্যুতিক কেটলি, কার্ডের ‘ভুয়ো’ ইনভয়েস তৈরি করে দিতেন। আর এর পরিবর্তে তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা যেত লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের অ্যাকাউন্টে। ইডির কাছে তিনি দাবি করেছেন, ওই জিনিসগুলির আদতে কখনও লেনদেন হয়নি।

ইডির দাবি, একই ভাবে বাকি তিন সংস্থাও ‘ভুয়ো’ ইনভয়েসের বিনিময়ে লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছিল।

প্রসঙ্গত, লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থার জন্যই অভিষেককে তলব করেছিল ইডি। সংস্থার অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’। লিপ্‌স অ্যান্ড বাউন্ডস সংস্থার আর্থিক কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন তিনি। পরে সিওও (চিফ অপারেটিং অফিসার) হয়েছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। তখন সংস্থার ডিরেক্টরের পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। এখন নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তাঁকে হেফাজতে নিয়েছে সিবিআই। পঞ্চম অতিরিক্ত চার্জশিটে লিপ‌্‌স অ্যান্ড বাউন্ডসকে অভিযুক্ত করেছে ইডি। ‘অভিযুক্ত’ হিসাবে লক্ষ্মী সাইকেল প্রাইভেট লিমিটেডে এবং নবীনকুমার গুপ্তর নামও রয়েছে। ওই সংস্থা এবং নবীনকুমারের ব্যবসায়িক লেনদেনে ‘অসঙ্গতি’ মিলেছে বলেও চার্জশিটে দাবি করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.