পরিচিত কণ্ঠ নকল করে ফোন বা নগদ টাকা চেয়ে ব্ল্যাকমেল, কোন ডিজিটাল ফাঁদে কী করবেন, কী নয়

সাইবার অপরাধের জন্ম কবে? প্রশ্নটি সহজ আর উত্তরও জানা— যে দিন থেকে হাতে হাতে মোবাইল এসেছে।

সময় যত এগিয়েছে, তত মোবাইল ফোনের প্রযুক্তিগত উন্নতি হয়েছে। তেমনই ‘উন্নতি’ ঘটেছে সাইবার অপরাধের। সেই অপরাধ আরও ডালপালা মেলেছে। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়েছে ডিজিটাল ফাঁদ। সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) প্রতারকদের কাজ আরও সহজ করে দিয়েছে। অনায়াসে যে কোনও ব্যক্তির গলা নকল করে ফোন যাচ্ছে তাঁর পরিচিতদের কাছে। কোথাও সেই নকল কণ্ঠ সরাসরি টাকা চাইছে, কোথাও আবার তাকে কাজে লাগিয়ে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে আপনজনদের। কলকাতা পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগের প্রাক্তন পুলিশকর্তা কল্যাণ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘সাইবার অপরাধে এত ফাঁকফোকর রয়েছে, তার উপরে মানুষের এত গভীর বিশ্বাস, যে আমাদের কাজ আরও কঠিন হয়ে যায়। তাই আমরা সাধারণ ভাবে বলি, যাকে-তাকে বিশ্বাস করবেন না।’’

উদাহরণ দিতে গিয়ে কল্যাণ বলছেন, ‘‘হয়তো কোনও ব্যক্তিকে ফোন করে বলা হল, তাঁর মেয়েকে অপহরণ করে আনা হয়েছে। দু’লক্ষ টাকা দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে। বাবা সে কথা বিশ্বাস না করলে তাঁকে তাঁর মেয়ের কণ্ঠ শোনানো হচ্ছে ফোনে! এআই ব্যবহার করে গলা নকল করা হচ্ছে। বাবা তখন বিচলিত হয়ে পড়লেই অপরাধীদের কেল্লা ফতে! অথচ হয়তো তাঁর মেয়ে তখন কলেজে মন দিয়ে ক্লাস করতে ব্যস্ত!’’ কী ভাবে পরিচিতের গলা নকল করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা? কল্যাণ বলেন, ‘‘ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে অনেকেই আজকাল ভিডিয়ো বানান, রিল্‌স তৈরি করেন। সেখান থেকেই এআই তাঁদের কণ্ঠস্বরের নমুনা পেয়ে যায়। অন্য কারও বলা কথা সেই কণ্ঠে বদলে দেওয়া যায় অনায়াসে।’’

কল্যাণের বর্ণিত প্রতারণার দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি। এমনকি, ফোনের ওপার থেকে মেয়ের অপহরণের কথা শুনে মা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে। তাই বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, অনলাইনের জগতে পা ফেলতে হবে সন্তর্পণে। যে কোনও অচেনা উৎসকে প্রথমেই অবিশ্বাস করতে হবে। যাচাই করতে হবে বার বার। প্রতারণার ফাঁদ এড়াতে কখন কী করা জরুরি, কখন কোন পদক্ষেপে নামতে পারে বিপদ, বিশেষজ্ঞেরাই তা বলে দিয়েছেন। প্রাক্তন পুলিশকর্তা কল্যাণ এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগের ডিআইজি অঞ্জলি সিংহের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে আনন্দবাজার অনলাইন ‘কী করবেন’ এবং ‘কী করবেন না’-র যে তালিকা তৈরি করেছে—

কী করবেন

  • পরিচিত কারও নাম করে মেসেজে বা অন্য কোনও অনলাইন মাধ্যমে টাকা চাওয়া হলে তাঁর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করুন।
  • সন্দেহজনক ফোন, ওয়েবসাইট বা চ্যাটের উৎস যাচাই করুন। আদৌ তা বৈধ কি না দেখুন। যাচাই করতে না পারলে কথা বন্ধ করুন।
  • সন্দেহজনক ফোন বা মেসেজ পেলে তৎক্ষণাৎ পুলিশকে জানান।
  • মোবাইল নম্বর-সহ সন্দেহজনক চ্যাটের সম্পূর্ণ স্ক্রিনশট নিন। ওয়েবসাইট হলে ইউআরএলের স্ক্রিনশটও নিন। তার পর চ্যাট মুছে যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ করে দিন।
  • অডিয়ো বা ভিডিয়ো কল সম্পর্কে সাবধান থাকুন। এআই ব্যবহারে পরিচিতের কণ্ঠস্বর নকল করে এ ধরনের ফোন করা যায়। সে ক্ষেত্রে যাঁর গলা ফোনের ওপারে শুনতে পাচ্ছেন, সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিন।
  • অচেনা ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া কিউআর কোড বা রাস্তাঘাটে বিজ্ঞাপনী কিউআর কোড আগে যাচাই করুন।

কী করবেন না

  • অচেনা কাউকে অনলাইনে টাকা দেবেন না।
  • অচেনা কারও কাছ থেকে অনলাইনে টাকা নেবেন না।
  • চেনা বা অচেনা কাউকেই ব্যক্তিগত তথ্য বা ব্যাঙ্কের তথ্য জানাবেন না। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার তথ্য শুধু আপনার কাছেই রাখুন।
  • অচেনা উৎস থেকে আসা কোনও লিঙ্কে ক্লিক করবেন না।
  • অচেনা কারও কথায় নিজের ফোনে কোনও অ্যাপ ইনস্টল করবেন না।
  • কারও সঙ্গে ওটিপি বা অন্য কোনও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোড নম্বর শেয়ার করবেন না।
  • ফোন করে কেউ পুলিশ বা অন্য কোনও সরকারি তদন্তকারী সংস্থার অফিসারের পরিচয় দিলে চট করে বিশ্বাস করবেন না।
  • অনলাইনে কাউকে গ্রেফতার করা যায় না। ফলে ‘ডিজিটাল গ্রেফতারির’ মতো শব্দবন্ধে বিশ্বাস করবেন না।
  • ট্রু কলারে অচেনা নম্বরের পরিচয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল থাকে। তা বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই। রাস্তাঘাটে যত্রতত্র কিউআর কোড না বুঝে স্ক্যান করবেন না।
  • অচেনা কারও সঙ্গে ফোন বা ল্যাপটপে নিজের স্ক্রিন শেয়ার করবেন না।

ডিজিটাল অ্যারেস্টের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় শোনা গিয়েছে, ল্যাপটপে ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে উর্দি পরিহিত সিবিআই অফিসারেরা ভয় দেখিয়েছেন, জেরা করেছেন, টাকা চেয়েছেন। সিবিআইয়ের নাম শুনে ভয় পেয়ে অনেকে টাকা দিয়ে দিয়েছেন সাতপাঁচ না-ভেবেই। অভিজ্ঞ পুলিশকর্তা কল্যাণ বলছেন, ‘‘সিবিআই কখনও ইউনিফর্ম (উর্দি) পরে না। এই ধরনের ফোনে বেশি এগোনোরই দরকার নেই। আপনি যদি কোনও অন্যায় না-করে থাকেন, তা হলে তো ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। যে যা-ই বলুক, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিন! কোনও অন্যায় করে থাকলেও ফোনের কোনও হুমকিতে ভয় পাওয়ার দরকার নেই। পরিচিত কাউকে নিজের ভুল বা অন্যায়ের কথা জানিয়ে রাখুন।’’

প্রতি পদক্ষেপে সতর্কতা জরুরি। নইলে অনলাইন অপরাধের চোরাগলিতে পা ফস্কে যেতে পারে বার বার। কথায় বলে, সাবধানের মার নেই। ঠেকে শেখার প্রয়োজনীয়তা আছে বটে। কিন্তু তার মাসুল বড্ড চড়া। অতএব, আগেই সাধু সাবধান! 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.