ভোট আগামী মঙ্গলবার। প্রচারের জন্য হাতে মাত্র তিনটি দিন। তবু এখনও পর্যন্ত রাজবংশী অধ্যুষিত ধূপগুড়ি উপনির্বাচনে একটি বারের জন্যও প্রচারে দেখা গেল না অনন্ত মহারাজকে। সদ্যই বাংলা থেকে দলের প্রথম রাজ্যসভা সাংসদ হয়েছেন অনন্ত। আগামী লোকসভা নির্বাচনে রাজবংশী ভোট নিজেদের দখলে রাখতেই যে বিজেপি রাজবংশীদের স্বঘোষিত ‘মহারাজ’-কে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে, তা অনেকের কাছেই স্পষ্ট ছিল। ধূপগুড়ি উপনির্বাচনে অনন্তকে সামনে রেখে ভোট টানার পরিকল্পনাও ছিল দলের। সেইমতোই ভোটের প্রচারে তারকা প্রচারকদের তালিকায় ছিল অনন্তের নাম। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল নির্বাচনের ময়দানে নেই তিনি। রাজ্য সভাপতি সুকান্ত, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীরা ধূপগুড়ির মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেও অনন্ত নেই কেন? বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে ধূপগুড়িতে ‘পৃথক কোচবিহার’ ধুনোর গন্ধ এড়িয়ে যেতেই এই সিদ্ধান্ত।
প্রাথমিক ভাবে অনন্তকে ধুপগুড়ির প্রচারে নামানোর পরিকল্পনা ছিল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। সায় ছিল রাজ্য নেতৃত্বেরও। কিন্তু অঙ্ক কষে দেখা গিয়েছে, অনন্তকে প্রচারে নামানো হলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। কারণ, এখন রাজ্যসভায় বিজেপির সাংসদ হলেও অনন্তের মূল দল ‘গ্রেটার কোচবিহার পিপল্স অ্যাসোসিয়েশন’ (জিসিপিএ)। যেই দলের দাবি আলাদা কোচবিহার রাজ্য। অনন্তর বিজেপিতে এলেও তিনি সেই দাবি থেকে সরে এসেছেন বলে জানাননি। জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়িতে প্রচারে গিয়ে তিনি আলাদা কোচবিহার রাজ্যের দাবি তুলে ফেলবেন কি না, তা নিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব সংশয়ী। তাতে রাজবংশী ভোট বাড়লেও ওই আসনের অন্য সম্প্রদায়ের ভোটারদের বিজেপির প্রতি আস্থা কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। গেরুয়া শিবির সূত্রের খবর, সেই ‘হাওয়া’ বুঝেই অনন্তকে প্রচার থেকে দূরে রাখা হয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে দলের তরফে কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়নি।
সাধারণ ভাবে উপনির্বাচনের ফল শাসকের পক্ষে যায়। বিধানসভা নির্বাচনের পর পরই দু’টি জেতা আসন নদিয়ার রানাঘাট ও কোচবিহারের দিনহাটায় উপনির্বাচনে হেরেছে বিজেপি। অথচ বিধানসভা নির্বাচনে দু’টি আসনেই ভাল ব্যবধানে জিতেছিল তারা। ভবানীপুর থেকে খড়দহেও একই ভাবে জয়ের ধারা বজায় রেখেছিল তৃণমূল। ব্যতিক্রম ছিল মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি। ওই আসনে কংগ্রেসের জয় রাজ্য রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছিল। সেই কারণেই বিজেপির কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ধূপগুড়ি। লোকসভা নির্বাচনের আগে ধূপগুড়ি ধরে রেখে ভাল ফল করাই লক্ষ্য বিজেপি রাজ্য নেতৃত্বের।
ঠিক ছিল রাজ্য সভাপতি সুকান্ত ২৮ এবং ২৯ অগস্ট সমাবেশ করবেন ধূপগুড়িতে। আবার যাবেন ২ সেপ্টেম্বর শেষবেলায়। কিন্তু ২৮ তারিখ থেকেই ধূপগুড়ির মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন সুকান্ত। প্রতিদিনই সভা-সমাবেশ করছেন। কর্মিবৈঠক ও বাড়ি বাড়ি প্রচারেও যাচ্ছেন। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রচারের শেষবেলা পর্যন্ত ধূপগুড়িতেই থাকবেন সুকান্ত। বুধবার গিয়েছেন শুভেন্দু। বৃহস্পতিবারেও তিনি প্রচার করেছেন। শুক্রবার রাতেই জলপাইগুড়ি রওনা দিচ্ছেন দিলীপ ঘোষ। শেষবেলার প্রচারে শনিবার দিনভর ধূপগুড়িতে থাকার কথা তাঁর। জলপাইগুড়ির সাংসদ জয়ন্তকুমার রায়, ফালাকাটার বিধায়ক দীপক বর্মণও লাগাতার প্রচারে রয়েছেন। রয়েছেন রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি রথীন্দ্র বসু-সহ অন্য নেতারা। নেই শুধু অনন্ত মহারাজ।
ধূপগুড়িতে বিজেপির উপস্থিতি প্রথম চোখে পড়ে ২০১৮ সালে। সে বার ধূপগুড়ি পুরসভা নির্বাচনে চারটি ওয়ার্ডে জিতেছিল গেরুয়া শিবির। সে বার পঞ্চায়েত ভোটেও ওই বিধানসভার গ্রামাঞ্চলে খাতা খুলেছিল তারা। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জলপাইগুড়ি আসনে ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ভোটে জেতে। ধূপগুড়ি বিধানসভাতেও তারা এগিয়েই ছিল। গত বিধানসভা নির্বাচনে তারা ধুপগুড়িতে ৪৫.৬৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জেতে ৪,৩৫৫ ভোটে। তৃণমূল পেয়েছিল ৪৩.৭৫ শতাংশ ভোট। সিপিএম ৫.৭৩ শতাংশ।
ধূপগুড়িতে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে রাজবংশী ভোটের ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭৭ সাল থেকে বিধানসভায় রাজবংশী প্রতিনিধি পাঠিয়েছে জলপাইগুড়ি জেলার এই আসন। ২০২১ সালে বিজেপির হয়ে জেতেন রাজবংশী বিষ্ণুপদ রায়। তাঁর মৃত্যুতেই উপনির্বাচন হচ্ছে সেখানে। এ বারেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বীরা সকলেই রাজবংশী। সিপিএমের ঈশ্বরচন্দ্র রায় (কংগ্রেস সমর্থিত), তৃণমূলের নির্মলচন্দ্র রায় এবং বিজেপির তাপসী রায়। বাম এবং তৃণমূলের প্রার্থীরা ‘রাজনীতিক’ হলেও বিজেপির তাপসী কখনও রাজনীতি করেননি। ভোটের ময়দানে তাঁর পরিচয় পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় নিহত সিআরপিএফ জওয়ান জগন্নাথ রায়ের স্ত্রী। যা থেকে স্পষ্ট— ‘শহিদ’ আবেগ কাজে লাগিয়ে জয় পেতে চাইছে বিজেপি। যে কারণে প্রার্থীর নামও ঘোষণা করা হয়েছিল স্বাধীনতার দিবসের রাতে।
প্রাথমিক ভাবে ‘শহিদ’ আবেগ এবং রাজবংশী ভোটের অঙ্ক কষেই ময়দানে নেমেছিল বিজেপি। কিন্তু পরে দলের অভ্যন্তরীণ হিসাবে দেখা যায়, ওই এলাকায় রাজবংশী ভোট তিন ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা। কারণ, সব দলের প্রার্থীই রাজবংশী সম্প্রদায়ের। আর বিজেপি প্রকাশ্যে যতই দাবি করুক, তারাও জানে, রাজবংশী ভোটের সবটাই ‘গেরুয়া’ নয়। পঞ্চায়েতে নির্বাচনেই দেখা গিয়েছে, ওই আসনের গ্রামাঞ্চলে জেলা পরিষদ স্তরে তৃণমূল পেয়েছে ৪৭.৬০ শতাংশ ভোট। বিজেপি পেয়েছে ৩৯.২০ শতাংশ। বাম-কংগ্রেস জোটের দখলে ছিল ১২.১০ শতাংশ ভোট।
ওই শতাংশের হিসেব থেকে একটা সহজ অঙ্কে আসা যায় যে, বিধানসভার তুলনায় তৃণমূলের ভোট কিছুটা যেমন বেড়েছে, তেমনই রামের ভোট অনেকটাই বামে গিয়েছে। সেই ক্ষত মেরামত করতে গেলে যে শুধু রাজবংশী ভোটের উপরে নির্ভর করা যাবে না, সেটা সম্যক বুঝেছে বিজেপি। আবার বিজেপির রাজবংশী ভোট ব্যাঙ্ক ‘অনন্ত নির্ভর’ হলেও সেই সমাজের সকলেই যে ‘মহারাজ’-কে স্বীকৃতি দেন এমনও নয়। পাশাপাশিই, ধূপগুড়িতে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যাঁরা কোনও ভাবেই রাজবংশীদের পৃথক রাজ্যের দাবির সঙ্গে একমত নন। সেই ভোট টানতেই বিজেপি অনন্তকে প্রচার থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিজেপি এখন যে নীতি নিয়েছে, তাতে তারা রাজবংশী এলাকায় গিয়ে যেমন অনন্তকে রাজ্যসভায় পাঠানোর কৃতিত্ব নিচ্ছে, তেমনই অন্য এলাকায় গিয়ে ওই বিষয়টি বাদ দিয়ে মোদী সরকারের সুখ্যাতি আর তৃণমূলের নিন্দা করে ভোট চাইছে। অনন্তকে ধূপগুড়িতে নিয়ে এসে এই ‘বিভাজন’ প্রকাশ্যে আনতে নারাজ বিজেপি। যদিও বা শেষবেলায় তাঁকে প্রচারে নিয়ে যাওয়া হয়, তা হলেও একেবারে রাজবংশী অধ্যুষিত এলাকাতেই মহারাজকে নিয়ে ছোট আকারে সভা করার পরিকল্পনা আছে গেরুয়া শিবিরের। তবে সেই সম্ভাবনাও খুব কম।