আষাঢ়মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ার পুণ্যতিথিতে ভ্রাতা-ভগিনীর ত্রয়ীরূপ ধারণ করে শ্রীভগবানের যাত্রা। জগন্নাথ দেবের মূল মন্দির ছেড়ে প্রায় তিন কিলোমিটার রাজকীয় পথ পরিক্রমা করে তাঁরা মাসির বাড়ি গুন্ডিচা মন্দিরে পৌঁছান। সেখানে আটদিন তাঁদের পুণ্য অবস্থান ঘটে। তারপর সকলে ফিরে আসেন আপন মন্দিরে। গমন ও প্রত্যাগমনের এই চিরায়ত যাত্রায় ভগবান আমাদেরও যেন পথে নামিয়েছেন। সেই ঐশীপথ চেনার নামই রথযাত্রা মহোৎসব। রথ যে আবার দেহরূপ মন্দিরও বটে! দেহের খাঁচায় ঈশ্বরকে অধিষ্ঠান করিয়েই জীবনের চিরন্তন শুভযাত্রা। দেহে যেমন ২০৬ টি অস্থি, শ্রীজগন্নাথ দেবের রথও ২০৬ টি অস্থিরূপ কাষ্ঠে নির্মিত। কোথায় যেন রূপ আর অরূপ মিলেমিশে একাকার!
জগন্নাথদেব, বলভদ্র এবং সুভদ্রার রথের নাম যথাক্রমে নন্দীঘোষ বা কপিধ্বজ, তালধ্বজ বা হলধ্বজ এবং দর্পদলন বা পদ্মধ্বজ। রথ তিনটির চাকার সংখ্যা যথাক্রমে ১৬, ১৪ এবং ১২; সবমিলিয়ে সমগ্র রথযাত্রায় ৪২টি চাকার সমাহার। এই তিন রথের রশি বা দড়ি হচ্ছে তিনটি সাপ; তা যথাক্রমে শঙ্খচূড়, বাসুকি এবং স্বর্ণচূড়।
সব কয়টি রথই কাষ্ঠ নির্মিত, যেন ভক্তিরূপ কাষ্ঠ। এবং এই রথপথে এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে একটি বিশিষ্ট শব্দের উৎপত্তি ঘটে, যাকে ‘বেদ’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রথযাত্রা সংঘটিত হবার পথে চাকার তিনটি চিহ্ন বা দাগ ভূমিতে পতিত হয়; যাকে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী — এই তিন নদীর চিহ্নরূপে অভিহিত করা হয়। রথযাত্রা এগিয়ে যাবার পর পরেই ভক্তবৃন্দ এই ত্রিদাগের পুণ্যধূলি গ্রহণ করেন, কেউবা দাগের চিহ্নে আপন দেহ সমর্পণ করে নিজে গাত্রে মেখে নেন পরম ধূলি। হিন্দু বিশ্বাস, ভূপতিত হয়ে ধূলি মাখার সৌকর্য তিন নদীর সঙ্গমে পুণ্যস্নানের ফললাভের সমতূল্য।
তিন ভাইবোনের মধ্যে বলভদ্র জ্যেষ্ঠ, তাই প্রথমে বলভদ্রের তালধ্বজ রথ এগিয়ে চলে। বলরামের এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে গুরুতত্ত্বের একটি বহু প্রাচীন আভাষ। বলভদ্র গুরুতত্ত্বের প্রতীক, তিনিই যে নিত্যানন্দ-স্বরূপ। মানবজীবনে গুরুকৃপা সর্বোপরি থাকতে হবে। গুরুতত্ত্বে যে ১৪ ভুবনের ধারণা আছে, তা তো বলভদ্রের তালধ্বজ রথের ১৪ টি চাকারূপ চিহ্ন-সংকেতই। জগন্নাথের রথে রয়েছে ১৬ টি চাকা, যা দশটি ইন্দ্রিয় এবং ছয়টি রিপূর যোগফলের প্রতীক সংখ্যা। ভগবান সকল ১৬ কে পদতলে বা নীচে রেখেছেন; কিংবা বলা চলে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সুভদ্রার রথে স্থিত ১২ টি চাকা ভক্তির বারোমাস্যার চিহ্নিত সংখ্যা। বারোমাস অর্থাৎ রোজই যাজন করতে হবে ভগবানের উদ্দেশ্যে ভক্তির পুণ্য অর্ঘ্য সাজিয়ে।
মধ্যে অবস্থান করে যাত্রা সুভদ্রার পদ্মধ্বজ রথের। ভক্তিতত্ত্বের মূর্তিপ্রতিমা সুভদ্রার মধ্যেই খুঁজে পান ভক্তমণ্ডলী। সুভদ্রা যে ভক্তিমহারাণী; শুদ্ধাভক্তি যেন মূর্তিমতি হয়ে পথ পরিক্রমায় চলেছেন। সর্বশেষে চলেছেন শ্রীজগন্নাথ, অর্থাৎ ভগবান স্বয়ং। যেন গুরু, ভক্ত এবং ভগবানের সমন্বিত ক্রমিক যাত্রা চলছে আবহমানকাল ধরে। এই যাত্রায় অংশগ্রহণ করেন সমস্ত দেবতা। তিনটি রথেই সকল দেবদেবীর অবস্থান। রথের রশি ছোঁওয়ামাত্র গুরুদেব, পরম গুরু, পরমাধ্য গুরু; ভগবান এবং সকল দেবদেবীর চরণ ছোঁওয়া সুসম্পন্ন হবে। হিন্দু বিশ্বাস, এর ফলে মানুষের পুনর্জন্মলাভ হয়ে জাগতিক দুঃখকষ্ট আর পেতে হবে না, সরাসরি ঈশ্বরের পাদপদ্মলাভ সম্পন্ন হবে। রথের রশি স্পর্শ করে টানলে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমতূল্য ফললাভ ঘটবে বলেও বিশ্বাস।
ভক্তজনের বিশ্বাস, এই যে রথ এগিয়ে চলে, তা প্রভুর ইচ্ছাশক্তিতেই ঘটে, কারণ পথ চলতে চলতে রথ থেমে যায়, আবার চলে, আবারও থেমে যায়। এই যে চলা, না-চলার চিরায়ত যাত্রা, এর তাৎপর্য কী? ভক্ত ভগবানের পথ চলা দেখছেন, ভগবানও কী দেখছেন! ভগবান খোঁজেন তাঁর প্রিয় ভক্তকে অসংখ্য নরনারীর ভীড়ে; হয় তো নিজেকেও খোঁজেন। রাধাভাবে বিভোর হয়ে শ্রীচৈতন্যদেব সপার্ষদ নৃত্য করতে করতে প্রভুর শ্রীমুখ দর্শন করছেন, আর এগিয়ে চলেছেন। প্রভুরও যেন শ্রীচৈতন্যের প্রতি খেয়াল, লক্ষ লক্ষ ভক্তের মাঝে প্রিয় ভক্তের মুখও যেন তাঁর দেখা চাই, খুঁজে পাওয়া চাই। তাইতো তিনি থামেন, তাই তো ভক্তের মুখদর্শন করেন, আবার এগিয়ে যান। ভক্ত না থাকলে ভগবানই বা কী নিয়ে থাকবেন!
“আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে।”
কল্যাণ গৌতম