সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দু’টি এবং ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দু’টি ছক্কা। ভারতের বিশ্বজয়ের নেপথ্যে রিচা ঘোষের এই চার ছক্কার অবদান খুব কম নয়। কিন্তু জানা গেল, দু’টি ম্যাচই ভাঙা আঙুল নিয়ে খেলেছিলেন শিলিগুড়ির রিচা। জানালেন, কলকাতায় আসার পর রিচার প্রথম কোচ শিবশঙ্কর পাল।
সেমিফাইনালের আগেই রিচার সঙ্গে কথা হয়েছে শিবশঙ্করের। বললেন, ‘‘একটা কথা বলি। আগে বললে হয়তো অন্য রকম মন্তব্য করা হত। রিচা আঙুলে চোট নিয়েই সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল খেলেছে। ওর বাঁহাতের মধ্যমায় চিড় রয়েছে। এক দিন ফোনে বলল, স্যর ব্যথা করছে।’’
বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল বলে কথা। ব্যথা নিয়েই খেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন শিবশঙ্কর। বললেন, ‘‘ওকে বলেছিলাম, ‘এখন এ সব ব্যথা ভুলে যা। ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়ে খেল। বিশ্বকাপের পর দেখা যাবে।’ সে ভাবেই খেলল। হাতের ব্যথা নিয়েই নিজের সেরাটা উজাড় করে দিয়েছে। ওই ব্যথা নিয়েই বড় বড় ছয় মেরেছে। কতটা মনের জোর থাকলে এমন খেলা যায়।’’
ঋদ্ধিমান সাহা দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক হিসাবে বিবেচিত হন। তাঁর মতো রিচাও উইকেটরক্ষক। তাঁর মতোই শিলিগুড়ির বাসিন্দা। ২২ বছরের উইকেটরক্ষক-ব্যাটারের ক্রিকেটজীবনে ঋদ্ধিমানের প্রভাব রয়েছে। তবে তাঁর আদর্শ মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। মাহির ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিবশঙ্কর। বাংলার প্রাক্তন জোরে বোলার ধোনির সঙ্গেই জাতীয় দলে প্রথম ডাক পেয়েছিলেন। যদিও দেশের জার্সি গায়ে খেলার সুযোগ পাননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ থেকে বঞ্চিত শিবশঙ্করের হাতেই তৈরি আজকের রিচা।
রিচা উইকেট রক্ষা তো করেনই। তাঁর ব্যাটের হাতও খারাপ নয়। ভারতীয় মহিলা দলের ফিনিশার। বড় শট নিতে পারেন। নিজ গুণে ভারতীয় দলের অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছেন। তাঁর শিলিগুড়ি থেকে ভারতীয় দল ভায়া কলকাতা যাত্রা পথের সব কিছুই নখদর্পণে শিবশঙ্করের।
রঞ্জি ট্রফির ম্যাচের জন্য আগরতলায় রয়েছেন বাংলা দলের বোলিং কোচ। সেখানকার হোটেলে বসে টেলিভিশনে ছাত্রীর বিশ্বজয় দেখেছেন। ছাত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে? কী বলল? আনন্দবাজার ডট কম-কে তিনি বললেন, ‘‘বিশ্বকাপ জেতার পর দু’-তিন বার কথা হয়েছে। কিন্তু ও এখনও ধাতস্থ হতে পারেনি। কথা বলতে পারছে না ঠিক করে। বলল, স্যর গুরুদক্ষিণা দিতে চাই। বিশ্বকাপ দিয়েছে। আর কী দেবে বলুন তো? একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। বাংলা বড় ক্রিকেটার অনেক দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বকাপ শুধু রিচা দিয়েছে।’’
শিবশঙ্কর যখন হাতে পেয়েছিলেন, তখন রিচার বয়স ১৫-১৬-র মতো। শিলিগুড়ির ক্লাবের হয়ে ওপেন করতেন। শিবশঙ্করই রিচাকে পাঁচ নম্বরে নামিয়ে দেন। তিনি বললেন, ‘‘প্রথম যখন রিচাকে দেখি, তখন বয়স কম। ছোট ছিল তো, বুদ্ধি ছিল না তেমন। হাতে বড় শট ছিল। শটে ভাল জোর ছিল। শুধু মিড অফের উপর দিয়ে ছয় মারার চেষ্টা করত। মনে হয়েছিল, ওপেনারের থেকে ফিনিশার হিসাবে খেললে বেশি সাফল্য পাবে। তাই পাঁচ বা ছ’নম্বরে ব্যাট করাতে শুরু করি। পরে বাংলার মহিলা দলের কোচ হয়েও ফিনিশারের দায়িত্বই দিয়েছিলাম। এখন মাঠের সব দিকে শট মারতে পারে। যে কোনও দিকে ছক্কা মারতে পারে। অভিজ্ঞতা বেড়েছে। এখন রিচা দেশের অন্যতম সেরা ফিনিশার। ও নামলে সবাই ধরে নেয় তিন-চারটে ছক্কা মারবেই। বিশ্বকাপে তো সবাই দেখল। প্রায় সব ম্যাচেই ভাল ব্যাট করেছে। ফাইনালে যে ৩৪ রানের ইনিংসটা খেলল, সেটার গুরুত্ব কম নয়।’’

ব্যাটার রিচার প্রশংসা হলেও উইকেটরক্ষক রিচার সমালোচনা হচ্ছে। বিশ্বকাপে একাধিক ক্যাচ ফেলেছেন। অন্তত তিনটি স্টাম্পড আউট করার সুযোগও নষ্ট করেছেন। কোচ হিসাবে কি আপনি সন্তুষ্ট? শিবশঙ্কর বলেছেন, ‘‘রিচা খারাপ উইকেটরক্ষক নয়। বেশ কিছু ভাল ক্যাচ ধরেছে। রান আউট করেছে। দু’একটা ম্যাচ সকলের খারাপ যেতে পারে। এটা ঠিক বিশ্বকাপের অন্তত দুটো ম্যাচে ওর কিপিং ভাল হয়নি। প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তার মানে ও খারাপ উইকেটরক্ষক নয়। চোটের কথা তো আগেই বললাম।’’
বিশ্বকাপের জন্য কী ভাবে প্রস্তুত করেছিলেন? শিবশঙ্করের বক্তব্য, ‘‘এখন এখানে খুব একটা থাকতে পারে না। ভারতীয় দলের খেলা ছাড়াও সারা বছর নানা প্রতিযোগিতা থাকে। এখানে থাকলে আমার পাটুলি ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন করে। বোলিং মেশিন, নৈশালোকের মতো পরিকাঠামো রয়েছে। থ্রোডাউন বিশেষজ্ঞ রয়েছে। যতটা সম্ভব ভাল পরিকাঠামো রিচাকে দেওয়ার চেষ্টা করি। সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। ভীষণ পরিশ্রম করতে পারে। সারা দিন ধরে ব্যাটিং, কিপিং করতে পারে। এই সাফল্য ওর পরিশ্রমের ফল।’’
আপনার ছাত্রী ধোনির ভক্ত। আপনি ধোনির বন্ধু। দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন? শিবশঙ্কর বললেন, ‘‘ধোনি ফোন ধরে না খুব একটা। তা ছাড়া আমার সময় থাকলেও হয়তো ধোনির থাকে না। বা উল্টোটা। রিচাও এখন ব্যস্ত। ওকে বলেছিলাম, ‘ধোনির সঙ্গে কোথাও দেখা হলে, পরামর্শ চেয়ে নিবি। ম্যাকো স্যরের স্টুডেন্ট বলে পরিচয় দিবি।’ দু’-এক বার ধোনির সঙ্গে দেখা হয়েছে ওর। ধোনির পরামর্শ পেয়েছে। বেশ কিছু টিপস দিয়েছে ধোনি। সেগুলো মাথায় রাখার চেষ্টা করে সব সময়। রিচা তো আসলে ধোনির মতোই। উইকেটরক্ষক এবং ফিনিশার। বড় বড় ছয় মারে। একটা সময় সবাই ধোনি হতে চাইত। রিচাও তো তাই। বিশ্বাস করি এমন এক দিন আসবে, যখন সবাই রিচা হতে চাইবে।’’
রিচার ক্রিকেটজীবনে তাঁর বাবা মানবেন্দ্র ঘোষের অবদানও কম নয়। তাঁর হাতেই মূলত রিচার ক্রিকেটে হাতেখড়ি। শিলিগুড়ির বাড়িতে মেয়ের জন্য নেটের ব্যবস্থাও করেছিলেন। শিবশঙ্কর বললেন, ‘‘রিচার বাবার মতো বাবা আমি দেখিনি। মেয়ের জন্য নিজের কাজকর্ম সব ছেড়ে দিয়েছেন। বড় মেয়ের দিকেও সে ভাবে দেখেননি বোধহয়। পরিবার, বাড়ি ছেড়ে ছোট মেয়েকে নিয়ে দিনের পর দিন কলকাতায় পড়ে থাকতেন। ছোট মেয়ের জন্য ওঁর ত্যাগ কম নয়। রিচাও সেটা বোঝে। এখনও কলকাতায় আসার আগে বাবাকে ফোন করে বলে বিমানবন্দরে চলে যেতে। উনিও ছুটতে ছুটতে মেয়েকে আনতে যান।’’
শিবশঙ্করের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না, তিনি বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটারের কোচ। বললেন, ‘‘রিচা শুধু আমার ছাত্রী নয়। মেয়ের মতোই। আমার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে ওর খুব বন্ধুত্ব। আমার বাড়িতে এলে ওদের সঙ্গে খেলে। রিচা দিদি জিতেছে বলে ওদের আনন্দের শেষ নেই। লাফিয়ে যাচ্ছে।’’
রিচা নাকি খেতে খুব ভাল বাসেন? প্রচুর খান নাকি? শিবশঙ্কর বললেন, ‘‘হ্যাঁ খেতে ভালবাসে। কিন্তু বাসলেই তো হল না। এখন যে পর্যায় খেলছে, সেখানে খাওয়ার এত স্বাধীনতা নেই। ইচ্ছা হলেই খাওয়া যায় না। পেশাদার ক্রিকেটার এখন। নির্দিষ্ট ডায়েট মেনে চলতে হয়। না মানলে নিজেরই ক্ষতি। রিচা চকোলেট খেতে খুব ভালবাসে। কিন্তু সেটা একদম বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আমাদের বাড়িতে এলেও তো ভাবতে হয়, ওকে কী খেতে দেব। অনেক কিছুই খাওয়াতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোচ হয়ে তো নিয়ম ভাঙতে পারি না!’’
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ, মহিলাদের প্রিমিয়ার লিগ, বিশ্বকাপ— পর পর তিন বছরে তিনটি বড় ট্রফি জেতা হয়ে গেল রিচার। রয়েছে এশিয়ান গেমসের সোনা, কমনওয়েলথ গেমসের রুপোও। ২২ বছরের মধ্যেই একের পর এক সাফল্য ধরা দিয়েছে। আগামী বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলবেন সব ঠিক থাকলে। তত দিনে অভিজ্ঞতা এবং পরিশ্রম নিশ্চিত ভাবে আরও দক্ষ করে তুলবে বাংলার বিশ্বজয়ীকে। এখন থেকেই আশায় বুক বাঁধছেন বিশ্বজয়ীর কোচ।
মহিলাদের এক দিনের বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার দীপ্তি শর্মার উত্থানের নেপথ্যেও ভূমিকা রয়েছে শিবশঙ্করের। আদতে উত্তরপ্রদেশের আগ্রার বাসিন্দা হলেও দীপ্তি বেশ কয়েক বছর খেলেছেন বাংলার হয়ে। বিশ্বকাপে প্রিয় দুই ছাত্রীর সাফল্যে উচ্ছ্বসিত শিবশঙ্কর। দুই ছাত্রীর মতো তাঁদের কোচও রবিবার রাত থেকে ধাতস্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন।

