পয়লা বৈশাখ যশোহর-নৃপতি মহারাজ প্রতাপাদিত্য (১৫৬১-১৬১১)-র রাজ্যাভিষেকের দিন। মহারাজের স্মৃতিকে যদি তুলে ধরি, তবে আত্মপ্রকাশ করবে আগ্রাসী মুঘলদের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধীন স্বরাজের আর এক আদর্শ স্থাপনের গল্প। যে রাজ্যের সীমানা ছিল ধূমঘাট থেকে পাটনা, পুরী থেকে চট্টগ্রামের সন্দীপ। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজেরও পূর্বে (১৬৩০-১৬৮০) বাংলা পথ দেখিয়েছিল মুঘলদের বিরুদ্ধে বীরত্বের প্রদর্শনে। চিরপ্রসিদ্ধ বাঙালির দৌর্বল্যের যে অধুনাতন কাহিনি শোনা যায়, তার বিপ্রতীপে দুর্লভ শক্তিপূজারীরাও যে বাংলায় বসবাস করতেন, তা মনে করিয়ে দেবার দায় কোনো দেশবিরোধীদের না থাকতে পারে, দেশব্রতীদের আছে। রবীন্দ্র-ভাগ্নী সরলাদেবী চৌধুরানি (১৮৭২-১৯৪৫)-র ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ এমনই এক জাতীয় জীবনের ইতিহাসের ভাব-আরাধনার প্রয়াস, যে ইতিহাস ঠিক মতো ধরা হয় নি। তারই অঙ্গ ছিল লাঠিখেলা এবং অস্ত্রপূজন। ১৯০৩ সালে সরলা দেবী চৌধুরানি বৈশাখী পূর্ণিমাতে প্রচলন করলেন প্রতাপাদিত্য উৎসব৷ আর এই বছরই প্রকাশিত হল নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের নাটক ‘বঙ্গের প্রতাপাদিত্য’। নাট্যকার সেখানে দেখালেন, বাঙালি না পারে, এমন কার্যই নেই। এখন কে সেই প্রতাপ? কবি ভারতচন্দ্র লিখছেন,
“যশোর নগর ধাম, প্রতাপ-আদিত্য নাম,
মহারাজ বঙ্গজ কায়স্থ।
কেহ নাহি আঁটে তায়, নাহি মানে পাতসায়,
ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ।।
বরপুত্র ভবানীর, প্রিয়তম পৃথিবীর
বাহান্ন হাজার যার ঢালী।
ষোড়শ হলকা হাতী, অযুত তুরঙ্গ সাথী,
যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী।”
১৮৯৫ সালে বালগঙ্গাধর তিলক দেশবাসীকে ব্রিটিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলতে প্রচলন করেছিলেন ‘শিবাজী উৎসব’। মারাঠি এই উৎসব বাংলাতেও প্রভাব বিস্তার করলো। সরলা দেবী বঙ্গের বীর সিরিজের ক্ষুদ্র পুস্তিকা-সম্ভার রচনা করলেন এবং বীররসে বাঙালি যুবসমাজকে জারিত করে দিলেন। তারই অনুষঙ্গে প্রতাপাদিত্যর পুত্র উদয়াদিত্যের বীরত্বকেও স্মরণ করে আয়োজিত হল ‘উদয়াদিত্য উৎসব’। মঞ্চে বৃহৎ তরবারি রেখে পুষ্প অর্পণ করে বীরপুজো সম্পন্ন করলো স্বাধীনতাকামী যুবসমাজ।
সরলাদেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী তথা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবীর কনিষ্ঠা কন্যা। তিনি বঙ্গের যুবমণ্ডলীকে জাগিয়ে তুলতে এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালতে ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’-এর সূচনা করলেন। প্রতাপের রাজ্যাভিষেকের দিন ছিল পয়লা বৈশাখ। ওই দিনটিকেই বেছে নেওয়া হল বর্ষবরণ এবং অস্ত্রগ্রহণের দিন হিসাবে। কলকাতার ভবানীপুরে মণিলাল গাঙ্গুলির আমন্ত্রণে সরলার অংশগ্রহণের শর্ত হিসাবে সাধারণ সাহিত্য সমিতির বাৎসরিক উৎসব আয়োজনের দিনটি ফেলা হল পয়লা বৈশাখ৷ অতএব উৎসবে সভানেত্রী হতে রাজিও হয়ে গেলেন সরলাদেবী। উৎসবের তারিখটি এরপর এই দিনেই চালু হয়ে গেলো। বাঙালির বীরপূজার উৎসব, ব্রিটিশ শক্তিকে সরানোর অন্তরঙ্গে শক্তিপূজার প্রচলন, যেমনভাবে শিবাজী উৎসব চালু করে শক্তিশালী হয়েছিল মারাঠিরা, তেমনই বঙ্গদেশেও শুরু হল।
Young India পত্রিকায় বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২) এই উৎসবের আয়োজনকে প্রশংসা করে লিখলেন, “As necessity is the mother of invention, Sarala Devi is the mother of Pratapaditya to meet the necessity of a hero for Bengal.”
উৎসবে বক্তৃতার ক্লান্তিকর কর্মসূচী ছিল না। বরং ছিল বীরত্বের খেলার প্রদর্শনী দেখে অন্তরে-বাহিরে শক্তিশালী হবার প্রেরণা। কেবলমাত্র একটি প্রবন্ধ পাঠের আয়োজন ছিল, সেটি হচ্ছে প্রতাপাদিত্যর জীবনী৷ আর ছিল অস্ত্রপূজার শপথ এবং সেরা বাঙালি কুস্তিগীরের প্রদর্শন, তলোয়ারধারীর কেরামতি, বক্সিং আর লাঠি খেলোয়াড়দের নানান প্যাঁচ-পয়জার। প্রতাপাদিত্য উৎসব সেই সময় সারা বাংলায় যুবমনে দারুণ আলোড়ন ফেললো। এর মধ্যে ১৯০৫ সালে ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গ করে বাঙালির একতাকে ভেঙে দেবার চেষ্টা করলো, বিপ্লবের পটভূমিকায় দেশাত্মবোধক শক্তির আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো৷
আজ কি প্রতাপাদিত্যকে বাঙালি মনে রেখেছেন? মহারাজ শশাঙ্ককেও মনে রেখেছেন? বাঙালিকে যদি মহাকার্যে শেষরক্ষা বলে কিছু করতে হয়, চরিত্রগত দুর্বলতায় সবকিছু যাতে পণ্ড হয়ে না যায়, তারজন্য বীররসের সাধনা ভীষণভাবে দরকার। সেরা বাঙালির যোদ্ধৃত্ব রূপের সাধনা এই কারণেই। যোদ্ধা হওয়া এবং যোদ্ধাকে উপাসনা করা।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।