ঠিক দু’দিন আগে হয়ে গেল আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস। আশার কথা, পশ্চিমবঙ্গে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু বাঘমার্কা প্রতীকের সেই সিএসটিসি-র বাস চলে গিয়েছে বিস্মৃতির আড়ালে। আজ সেই অধুনালুপ্ত সিএসটিসি-র প্রতিষ্ঠাদিবস। আগে ঘটা করে সংস্থার তরফে পালন করা হত দিবসটি। এখন সে সব ইতিহাস।
কলকাতার মানুষদের যাতায়তের ব্যবস্থা করতে স্বাধীনতার পর বিধানচন্দ্র রায় একটা সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা করলেন। ১৯৪৮-এর ৩১ জুলাই তৈরি হল সিএসটিসি। ব্রিটেনের ধাঁচে বাস। প্রতীক হল বাংলার বাঘ- দি রয়াল বেঙ্গল টাইগার। সিএসটিসি-র প্রাক্তন কর্মী আশি ছুঁই ছুঁই অমর মজুমদার জানান, “গোড়ায় ছিল লম্ফায়মান পূর্ণ বাঘের ছবি।
১৯৬০-এর ১৫ জুন সেই প্রতীকে গলা কেটে গৃহিত হল কেবল বাঘের মুখের ছবি। দীর্ঘকাল সেই সরকারি বাস ছিল যাত্রী পরিবহণ-ব্যবস্থার মেরুদন্ড।”
আগে প্রতি বছর সংস্থার সদর দফতর ৫, নীলগঞ্জ রোডের মিলনায়তনে এ দিনটি উদযাপিত হত। পরিবহণমন্ত্রী যেতেন। মাঝে মাঝে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও থাকতেন। সংস্থার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উল্লেখ করে শ্রমিক-কর্মীদের দেওয়া হত বাঘমার্কা ছাপওয়ালা খাবারের ছোট বাক্স। শনিবার সংস্থার ছুটির দিন হওয়ায় শ্রমিক-কর্মীদের দেওয়া হয়েছে একটি বেসরকারি নামী সংস্থার মোড়ক। প্রসঙ্গত ওই সংস্থার মালিকের পারিবারিক ঘনিষ্ঠ এক নামী বিজেপি নেত্রী। কলকাতায় গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউয়ে সংস্থার প্রধান দফতরে বিধান চন্দ্র রায়ের আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান হয়েছে। তবে, মন্ত্রীর উপস্থিতিতে নয়।
পরবর্তীকালে কী অবস্থা হল সিএসটিসি-র? সত্তরের দশক থেকে ক্ষয়রোগ ধরতে শুরু করে সিএসটিসিতে। বাড়তে থাকে নেতিবাচক কর্মসংস্কৃতি, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। ২০১১-তে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের কিছুকাল পর থেকে সিএসটিসি এবং অন্যান্য পরিবহণ নিগনে খোলনলচে বদলানোর কাজ শুরু হয়। মহানগরে গণ-পরিবহণের হাল খতিয়ে দেখতে বছর ২০১৩-তে একটি সমীক্ষা করেছিল আন্তর্জাতিক সংস্থা জোনস লেসেল। তাদের রিপোর্ট এতদিন পরিবহণ দফতরেই পড়েছিল। সিটিসি, ভূতল পরিবহণ নিগম এবং সিএসটিসি-সরকারি এই তিন সংস্থাই বাস চালাত মূলত শহরের মধ্যেই। একই রুটে একাধিক নিগমের বাস চলত আবার মোটামুটি একই সময়ে। ফলে, যাত্রী পাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে চলত অস্বাস্থ্যকর রেষারেষি। দিনের নির্দিষ্ট সময়ে কিছু রুটে সরকারি বাসের হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। সন্ধের পরে সেই সব সরকারি বাস উধাও-ও হয়ে যেত প্রায় এক সঙ্গেই। অথচ শহর-শহরতলিতে এমন বহু এলাকাই রয়েছে, যেখানে সরকারি বাসই একমাত্র ভরসা। এ দিকে যাত্রী সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছিল। সেই অনুপাতে মহানগরের পরিবহণ ব্যবস্থায় গতি বাড়েনি। বরং অপরিকল্পিত যান চলাচল বেড়েছিল। তৈরি হচ্ছিল বিশৃঙ্খলা।
একই রুটে সরকারি নিগমগুলির গুঁতোগুঁতি, অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় লোকসান হচ্ছিল। এই অবস্থা বন্ধ করে যাত্রী পরিবহণে গতি আনতে একটি রিপোর্ট তৈরি করে পরিবহণ দফতর। দত্ত-মুরুগান-শাণ্ডিল্য কমিটির সেই রিপোর্ট জমা পড়ে ২০১৪-র ফেব্রুয়ারিতে। সেই রিপোর্টেই কলকাতায় সরকারি বাস চালানোর মূল দায়িত্ব সিএসটিসি-কে দেওয়ার কথা বলা হয়। ঠিক হয়, সিটিসি এবং ভূতল পরিবহণ নিগম শহর ও শহরতলির মধ্যে যাত্রী পরিবহণের কাজ করবে। আগামী দিনে বিভিন্ন নিগমের মধ্যে ডিপো ও মালপত্র ভাগ করে নেবে। জেএনএনইউআরএম প্রকল্পে কলকাতায় চলাচলের জন্য নতুন বাস আসতে শুরু করে। তার আগেই সিএসটিসি-কে মহানগরে সরকারি বাসের পূর্ণ দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে বিভিন্ন পরিবহণ নিগমকে মিশিয়ে তৈরি করা হয় পশ্চিমবঙ্গ পরিবহণ নিগম (ডব্লুবিটিসি)।
গত এক দশকের ওপর সিপিএম প্রভাবিত সিএসটিস এমপ্লইজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন রামপ্রসাদ সেনগুপ্ত। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “১৯৮০-তে সিএসটিসি-র কর্মী ছিল প্রায় ১৪ হাজার। বেশির ভাগই স্থায়ী কর্মী। ২০১১-তে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৬,১৮৩। এখন মোট কর্মী ৩,১৬৩। এর মধ্যে স্থায়ী ২,৩১৯, স্থায়ী ৮৩৪। এখন বাসের মোট সংখ্যা ৯৫০। চলে এর অর্ধেক। এক ট্যাঙ্কার ডিজেলের (১২ হাজার লিটার) দাম হয়েছে ১০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।”
সব মিলিয়ে যেন বাস চালানো দায় হয়ে উঠেছে সরকারের। আগে প্রতিদিন ভোরে এবং বেশি রাতে সরকারি ডিপো থেকে বিভিন্ন রুটের প্রথম এবং শেষ বাস ছাড়ত। এখন সে সব প্রায় বন্ধ। সকাল-সন্ধ্যার নির্দিষ্ট সময় ছাড়া সরকারি বাস ভীষণ কম। রামপ্রসাদ সেনগুপ্তর দাবি, “সরকারের টাকার অভাব নেই। অনেককাল ধরে মৃত্যুজনিত কারণে অর্থাত্ মৃত কর্মীর সন্তানদের নিয়োগ বন্ধ হয়ে আছে। আমরা বার বার এই নিয়োগের দাবি করেছি। লাভ হয়নি। চুক্তিবদ্ধ কর্মীদের স্থায়ীকরণের দাবিও জানাচ্ছি।”
সংস্থার এক আধিকারিক এই প্রতিবেদককে জানান, “সিএসটিসি এখন আর নেই। বদলে গিয়েছে বাঘমার্কা প্রতীকও। ডব্লুবিটিসি-র যথেষ্ঠ আধুনিকীকরণ হয়েছে। জেএনএনইউআরএম বাস আসার পর কলকাতার যাত্রী পরিবহণে গতি এসেছিল। ডিপোগুলোর মানোন্নয়ন হয়েছে। ৮০টি ইলেকট্রিক বাস এসেছে। পুরনো বাসগুলোকে পর্যায়ক্রমে প্রতিস্থাপিত করা হবে। অস্থায়ীদের স্থায়ীকরণের কোনও ভাবনা নেই। ব্যয়সঙ্কোচ করে সংস্থাকে স্বাবলম্বী করার সব রকম চেষ্টা হচ্ছে।”