‘‘থানার সামনে বেশি ভিড় করবেন না। গেটটা ছেড়ে দাঁড়ান, বড়বাবু বেরোচ্ছেন।’’— কথাগুলো বলতে বলতে তৎপরতার সঙ্গে বড়বাবুকে গাড়িতে তুলে দিয়ে তিনি এসে বসলেন এক ব্যক্তির অভিযোগ শুনতে। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘‘তা হলে আপনি বলছেন, এমনটাই হয়েছে! বসুন, ছোটবাবু কথা বলবেন।’’ এর পরে তিনি থানারই একটি কম্পিউটারে বসে শুরু করলেন টাইপ করা। নিজের মনেই বললেন, ‘‘কেসগুলো আজকের মধ্যেই তুলে ফেলতে হবে। পাসপোর্টের ব্যাপারগুলোও আছে।’’
বাঁশদ্রোণী থানার এমনই নানা দৃশ্য এখন আবর্তিত হচ্ছে শুভাশিস চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তিকে ঘিরে। বছর পঁয়তাল্লিশের ওই ব্যক্তি খবরের শিরোনামে এসেছিলেন চলতি মাসের মাঝামাঝি। এক রাতে বাঁশদ্রোণী থানায় হাজির হয়ে তিনি দাবি করেন, নিজের দাদাকে বালিশ চাপা দিয়ে খুন করেছেন। শুভাশিসের সঙ্গে তাঁর বাড়ি গিয়ে পুলিশ দেখে, বিছানায় পড়ে এক ব্যক্তির মৃতদেহ। জানা যায়, তিনিই শুভাশিসের দাদা দেবাশিস চক্রবর্তী।
শুভাশিস দাবি করেন, বাবার মৃত্যুর পর থেকে তিনি মা এবং দাদার সঙ্গে বাঁশদ্রোণীর নিরঞ্জনপল্লির একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। মূলত মায়ের পেনশনে সংসার চলত। দাদাও কিছু টাকা পেনশন পেতেন। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পরে দুই ভাইয়ের অর্থকষ্ট চরমে ওঠে। পুরনো ফ্ল্যাট ছেড়ে ওই এলাকাতেই একটি ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন তাঁরা। শুভাশিস দাবি করেছিলেন, তাঁর দাদা কিছু দিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু চিকিৎসার টাকা ছিল না। সেই হতাশা থেকেই তিনি দাদাকে খুন করেছেন।
কিন্তু মৃতদেহের ময়না-তদন্তের রিপোর্ট আসার পরে জানা যায়, খুন নয়, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু হয়েছে দেবাশিসের। তখন শুভাশিস দাবি করেন, কয়েক বছর ধরে তিনি বেকার। নিজের মৃত্যুর পরে ভাইয়ের কী ভাবে চলবে, এই ভেবে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন দেবাশিস। তাই তিনিই নাকি শুভাশিসকে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরে ভাই যেন থানায় গিয়ে বলেন, খুন করেছেন তিনিই। কারণ, গ্রেফতার হলে খাওয়ার সমস্যা হবে না।
পরে তদন্তকারীরা অবশ্য বুঝতে পারেন, গোটাটাই কল্পনা করেছেন শুভাশিস। যে হেতু শুভাশিস কোনও অপরাধ করেননি, তাই তাঁকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। কিন্তু শুভাশিস পুলিশকে অনুরোধ করতে থাকেন তাঁকে কোনও কাজ খুঁজে দেওয়ার জন্য। এ-ও দাবি করেন, তাঁর পক্ষে পুরনো ঠিকানায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁকে বেশ কয়েক বার থানা থেকে চলে যেতে বলার পরেও তিনি যাননি। থানার সামনেই বসে থাকতে শুরু করেন। শুভাশিসের কথা পৌঁছয় পুলিশের বড় কর্তাদের কানে। স্থানীয় ডিসি-সহ পুলিশের বহু কর্তা গিয়ে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি। শেষে শুভাশিসের সঙ্গে দেখা করতে বাঁশদ্রোণী থানায় আসেন কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (অপরাধ দমন)। তিনিই বিষয়টি মানবিক ভাবে দেখার সিদ্ধান্ত নেন। সেই থেকেই থানায় থাকা শুরু শুভাশিসের।
পুলিশ সূত্রের খবর, শুভাশিস বাণিজ্যে স্নাতক। কম্পিউটারেও বেশ দক্ষ। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে, থানার যে সব কাজে কম্পিউটার প্রয়োজন হয়, সেই কাজগুলি শুভাশিসকে দিয়ে করানো হবে। ব্যারাকেই থাকবেন তিনি। খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে থানার ক্যান্টিনে। থানার অফিসারেরাই টাকা দিয়ে একটি তহবিল তৈরি করে দিয়েছেন খাওয়ার খরচ চালানোর জন্য। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং শুভাশিস কিছু শিখতে চাইলে তা-ও শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে খবর। একই সঙ্গে খোঁজ চলছে তাঁর জন্য কোনও চাকরির। এক পুলিশকর্তা বললেন, ‘‘মানবিক দিক থেকে ওই ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানো হয়েছে। ওঁকে আর সমস্যার মধ্যে ফেলতে চাই না। ওঁর যোগ্য কোনও কাজ পেলে সেখানেই পাঠানো হবে।’’
কিন্তু শুভাশিস থানায় থাকলেও তালাবন্ধ পড়ে তাঁর ঘর। বাড়িওয়ালা বললেন, ‘‘এই মাসের ভাড়া দেওয়া আছে। মাসটা কেটে গেলেই স্থানীয় কাউন্সিলর বা থানায় গিয়ে আমাদের ঘর খুলে দেওয়ার অনুরোধ জানাব।’’
কিন্তু শুভাশিস কী চান? অল্প কথায় তাঁর উত্তর, ‘‘থানাতেই ভাল আছি। স্যরেরা খুব ভাল।’’