যেন একটু বেশিই নতশির দেখাল তাঁকে, সেন্টার কোর্ট থেকে লিখলেন আনন্দবাজার অনলাইনের অতিথি লেখক

শালপ্রাংশু। মেদ-রহিত অবয়ব তাঁর, মাথার চুল সামনের দিকে পেতে আঁচড়ানো, লম্বা মুখে গালের দু’পাশে উঁচু হয়ে থাকা হনু। থুতনির কাছটা একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন। গভীর এবং নিকষ দুটি চোখে আপাত-অসীম শূন্যতা। দেখে ঘোর হয়, যেন সত্যি সত্যিই টাইম মেশিনে চেপে বহু শতাব্দীর ও পার হতে ফিরে এসেছেন বহু জয়ের নায়ক-গ্ল্যাডিয়েটর।

কিশোর-প্রায় প্রতিযোগীর হাতে তাঁর অদৃশ্য রাজমুকুট লুণ্ঠিত হয়েছে একটু আগেই। কিন্তু তা-ও, কী জানি কী এক অন্য কোনও ভারে, একটু যেন বেশিই ঝুঁকে আছে তাঁর শির। স্বগতোক্তির মতো কিছু শব্দ বেরিয়ে আসছে তাঁর কণ্ঠ থেকে। এলোমেলো সে সব বাক্য কখনও অনুজের প্রতি প্রীতিময়, কখনও বা এই সাদা দাগ কাটা সবুজ ভূখণ্ডের ওপর তাঁর দশকব্যাপী অধিকারবোধের অহঙ্কারে সঞ্জিত। অতিমানব তিনি, তাঁর শরীর নির্মিত বিরল ইস্পাতে। তাঁর মাথায় ধরা আছে তাবৎ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ টেনিস অভিজ্ঞান। রবিবারের আগে এই মাঠে উনি হেলায় হত্যা করেছেন বহু তরুণ প্রতিযোগীর আশা, প্রতিস্পর্ধাকে। অন্যের খেলা ভাঙার খেলা তাঁর নিত্যকার খেলা— এমনটাই এক প্রকার আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছেন তিনি।

আমরা ধরে নিয়েছিলাম তিনি অজেয়, অক্ষয়। রবিবার জিতলে একটানা পাঁচ বার জিত হাসিল হবে এই টুর্নামেন্টে। ২৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম তাঁর সংগ্রহে। আশা ছিল ২৪তমটি যোগ হবে সেই ঝোলায় আর তিনি, টেনিস ব্রহ্মাণ্ডের অনাবিষ্কৃত উচ্চতায় নিয়ে যাবেন নিজেকে। একাকী, নিঃসঙ্গ সেই বায়ুমণ্ডল থেকে চোখ রাখবেন ভবিষ্যতের ওপর।

Ujjwal Sinha with Suhel Seth

আমরা সবাই, যারা মাঠমুখী জনতা ছিলাম সকালবেলায়, এমন ভাবেই ভেবেছিলাম তাঁর জন্য। ভেবেছিলাম ওঁর বলা শুক্রবারে কথাই সত্য হতে চলেছে। উনি ফিরে যাবেন নিজের ২৬ বছর বয়সে, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল মহাকাব্য।

কিন্তু বিধাতা বাম। রবিবার তিনি নশ্বরতার পাঠ দিতে চেয়েছিলেন মহাকায়কে এবং তাঁর মাধ্যমে এখানে উপস্থিত সমস্ত গুণীজনকে। জীবন মহান, কারণ তা কোনও জাগতিক নিয়মের ঘেরাটোপে চলে না প্রত্যহ। তাই গত কাল কেমন গেল, তার কোনও অভিঘাত না-ও থাকতে পারে আগামীর ওপর। এমন সব চিন্তা যখন মনের ভেতরে মথিত হচ্ছে, আমি শুনতে পেলাম দীর্ঘ জীবনে লব্ধ গভীর বোধ তাঁকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে নিহিত দর্শন, “এই বধ্যভূমিতে আমি আগে এমন অনেক যুদ্ধ জিতেছি, যা হয়তো আমার জেতার কথা ছিল না। আগেও হারতে পারতাম হয়তো। কিন্তু আজ সত্যি হেরেছি। ইভেন স্টিভেন্স! শোধ-বোধ! খেলা ভাঙার খেলার দিন নয়কো আজ।’’

নানা এতোল-বেতোল কথার মধ্যে তাঁর চোখ খুঁজছিল গ্যালারিতে বসে থাকা নিকটজনদের। জীবনে যা কিছু তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয়, তাঁর শিশুপুত্রদের নিষ্পাপ, একটু দিশাহারা হাসিমুখের ওপর গিয়ে ন্যস্ত হল তাঁর দৃষ্টি। নিমেষে গলা ধরে এল তাঁর। বহু অভিজ্ঞতায় উনি জানেন, এ হল বীরমঞ্চ। এখানে অশ্রু মানায় না। তা-ও বাঁধ ভাঙল শেষমেশ। নিচু মাথা আরও নত হল। দু’চোখে হাত দিয়ে স্বীকার করলেন ঘাসের কোর্টে এমন ভাবে হারতে হবে ভাবেননি তিনি। আমরা বুঝলাম ২৬ নয়, অন্তত ৩৬ বছরের যাপন লাগে পরিবারের সমক্ষে এমন করে কাঁদতে।

খেলা তখন মধ্যগগনে। একটু আগেই প্রথম সেট জিতেছেন হেলায়। স্কোরবোর্ডে জ্বলজ্বল করছিল নিওন আলো— তিনি ৬, প্রতিদ্বন্দ্বী ১। আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম, আবার এক পরিচিত চিত্রনাট্য উন্মোচিত হচ্ছে পরতে পরতে। কিন্তু নাহ! ওই যে বললাম, বিধাতা স্বয়ং অন্য কিছু চেয়েছিলেন। অন্য রকম কিছু।

Picture of Novak Djokovic during Wimbledon Final 2023.

সকাল থেকেই আবহাওয়া ছিল খামখেয়ালি। যা ছিল সকালে ঝকঝকে নীল আকাশ, তা খেলা শুরু হওয়ার সময় বদলে গিয়েছিল মেঘলা ধূসর শামিয়ানায়। আকাশের মতো বদলে গেল খেলার চিত্রপটও। দেড় ঘণ্টার মাথায় উনি দ্বিতীয় সেট জিততে জিততে হারলেন। রয়্যাল বক্সের সামনে একবার টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন অকস্মাৎ। হাতের ভুলণ্ঠিত র‍্যাকেট জমি থেকে তুলে নিচ্ছিল বিহ্বল বল-বালিকা। তার আর দোষ কী! স্বয়ং টেনিসদেবতা থাকলেও হয়তো তা-ই করতেন সেখানে। তিনি ঘাসের মাটিতে ভূপতিত অবস্থায় মাথা ঘুরিয়ে এক বার দেখলেন সে দিকে। তার পর তাকালেন সেই বালিকার দিকে। মৃদু হাতের আন্দোলনে ইশারায় তাকে অনুরোধ করলেন, তাঁর প্রিয় অস্ত্রকে ধীরে মাটিতেই নামিয়ে রাখতে। সেখান থেকে সেই অস্ত্র তাঁকেই তুলতে হবে— ক্ষত্রিয়ের ধর্ম তাই বলে। আমার মনে সন্দেহ হল মৃদু। ‘ছাব্বিশে এমন গাঢ় হয় কি ধর্মবোধ? এত প্রেম জন্মায় নিজের শস্ত্রের প্রতি?’

তৃতীয় সেটের ৫ নম্বর পয়েন্টের অধিকার অর্জন করার লড়াইয়ের সময় যে প্রতিযোগিতা হল ১৩ বার ‘ডিউস’ হয়ে, তা নিশ্চয়ই বিশদে লিপিবদ্ধ থাকবে টেনিসের মহাফেজখানায়। যাতে কঠিন সময়ে টেনিসের মাহাত্ম্যে আস্থা, ভরসা রাখার জন্য শিক্ষানবিশেরা বার বার সে ছবি দেখতে পারে। কিন্তু সে কথা এখন থাক। আমরা বরঞ্চ এগিয়ে যাই আরও কয়েক পল। তখন ৫ নম্বর সেটের খেলা চলছে। আগের চার সেটের ফলাফল ২-২। আর সবে শুরু হওয়া নির্ধারক সেটে তিনি হারছেন ১-২ গেমে। একটি সহজ ভুলের মাশুল দিলেন পয়েন্ট খুইয়ে আর পয়েন্টের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ধৈর্যচ্যুতিও ঘটল। ধৈর্যচ্যুতি? তাঁর? অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, যেন জন ম্যাকেনরো অথবা হ্যাপি গিলমোরের খেলোয়াড় সত্তা ভর করেছে তাঁর ওপর! সেই অস্ত্র, যা তিনি কিছু ক্ষণ আগেই পরম মমতায় মাটি থেকে তুলেছেন, স্বহস্তে তাকে নির্মম ভাবে ভেঙে ফেললেন নিজ হাতেই! শুরুতে প্রায় সব দর্শকই গলা ফাটাচ্ছিলেন তাঁর প্রতিপক্ষের জন্য। তবে বিলিতি ওয়েদারের মতো বিলিতি দর্শকের সেই সমর্থনও খেলা যখন মাঝামাঝি পর্যায়ে, তখন পাল্টে যাচ্ছিল মুহুর্মুহু! তাঁর নামেও জয়ধ্বনি উঠছিল প্রতিটি কোনা থেকে।

ওই একটি ঘটনায় সে সব নিমেষে মিলিয়ে গেল এক লহমায়। স্বয়ং তিনি বিদ্রুপের শিকার হলেন নিজের প্রিয় চারণভূমিতে। আমি এ বার প্রায় নিশ্চিন্ত হলাম এই ভেবে যে, তিনি অবশেষে টেনিস-বৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর বয়স এখন ৩৬। এখনও হয়তো বলার সময় আসেনি। কিন্তু সাহস করে বলেই ফেলছি কথাটা— এখান থেকে শুধুই উতরাই। অন্তত এই মাঠে। এর অন্যথা হলে পুলকিত হব হয়তো। কিন্তু জানি সে পুলক ভাগ্যে নেই।

বছর কুড়ির বালকের চোখে চোখ পড়লে সম্ভ্রম হয়, লিখেছিলাম আগে। তিনি বলেছিলেন, “এখন ভীত হওয়ার সময় নয়। এখন ক্লান্ত হওয়া বারণ।” তিনি কথা রেখেছেন। আমাদের অবগত করিয়েছেন, নির্ভীকতা মানে প্রথমে পিছিয়ে পড়েও স্বয়ং ঈশ্বরের সামনেও না-ঝুঁকে, তাঁর চোখে চোখ রেখে, তাঁকে পরাস্ত করাতেই তাঁর সম্মান বৃদ্ধি হয়। এই বালকের শরীরের বয়স ২০। কিন্তু টেনিসীয় মস্তিষ্কের বয়স হয়তো বেশি। হয়তো বা ৩৭ বছর বয়সের কোনও টেনিস-অভিজ্ঞ বাস করেন সেখানে। যিনি নিজের স্পেনীয় টেনিস সত্তার উত্তরাধিকার দিয়ে যাচ্ছেন ওই সদ্য তরুণকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.