অর্পিতা মুখোপাধ্যায় টালিগঞ্জের যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, তার একাংশ বেআইনি ভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। রাজ্য সরকারের তরফে নোটিস পাঠানো সত্ত্বেও সেই নির্মাণ কাজ ভাঙা হয়নি। বার বার প্রোমোটারকে বলা সত্ত্বেও কাজ হয়নি বলে অভিযোগ। গোটা বিষয়টির ভিতরে কোনও প্রভাবশালীর হাত ছিল বলেই এখন মনে করছেন ডায়মন্ড সিটি সাউথ আবাসনের বাসিন্দাদের একাংশ। আবাসনের যে বাসিন্দারা অর্পিতার ফ্ল্যাটের বেআইনি নির্মাণ নিয়ে সরব হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম আর কৃষ্ণমূর্তি। সোমবার তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘এত দিনে বুঝতে পেরেছি, কেন প্রোমোটার এত ভয় পাচ্ছিলেন। কেন কোথাও আমরা সুবিচার পাচ্ছিলাম না।’’
কৃষ্ণমূর্তিরা বিষয়টির মধ্যে কোনও প্রভাবশালীর হাত ছিল বলে মনে করছেন। অর্পিতা গ্রেফতার হওয়ার পর কৃষ্ণমূর্তিরা জানতে পারেন, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ হিসাবে তাঁদের প্রতিবেশীকে উল্লেখ করেছে। সেখান থেকেই কৃষ্ণমূর্তিদের ধারণা, পার্থের প্রভাব খাটিয়েই হয়তো ওই বেআইনি নির্মাণ আপত্তি সত্ত্বেও রেখে দিয়েছিলেন। ভাঙেননি।
ডায়মন্ড সিটি সাউথ আবাসনের টাওয়ার ২-এর ১-এ থেকে ইডি গ্রেফতার করে অর্পিতাকে। ওই ফ্ল্যাট-লাগোয়া ছাদটিই বেআইনি ভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। সেখানে রীতিমতো বাগান করেছিলেন অর্পিতা। সেখানেই চলত পার্টি। এমনটাই জানিয়েছেন অন্য আবাসিকেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা যেমন বলছেন, ‘‘তখনও আবাসিকদের সংগঠনের হাতে রক্ষণাবেক্ষণের ভার আসেনি। তার আগেই ওই অংশটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই ছাদ-বারান্দাটির নীচে গাড়ির পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থার জন্য খোলা জায়গা থাকা জরুরি। বহুতলে কয়েক তলা অন্তর এ রকম একটি খোলা ছাদ থাকা রাখা হয়। আবশ্যিকও। আগুন লাগলে উদ্ধারের জন্য এই খোলা ছাদ ব্যবহার করেন দমকলকর্মীরা।’’ এই বাসিন্দার দাবি, অর্পিতা প্রভাব খাটিয়ে ওই অংশটি নির্মাণ করেন। এবং আপত্তি জানানোর পর তা প্রভাব খাটিয়েই ভাঙতে দেননি।
আবাসিকদের একাংশের দাবি, কলকাতা পুরসভা, দমকল, পুলিশ এবং সিইএসই পরিদর্শন করে আবাসিকদের সংগঠনকে শো-কজ নোটিস পাঠায়। সেটা ২০১৯-এর মার্চ। তার পর পরই প্রোমোটার সংস্থা ‘ডায়মন্ড গ্রুপ’-কে মেল করে সমস্যার কথা জানান কৃষ্ণমূর্তি। আবাসিকদের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘এই চিঠি দেওয়ার পর থেকেই পাল্টা প্রোমোটারের তরফে চাপ আসতে থাকে। এর পর আমি দমকল, পুরসভা, কলকাতার মেয়র, কাউন্সিলর, এমনকি, মুখ্যমন্ত্রীকেও চিঠি দিয়ে অভিযোগ জানাই। শেষে কলকাতা হাই কোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করি। সেই পিটিশনও খারিজ হয়ে যায়।’’
কৃষ্ণমূর্তির দাবি, ২০২২-এর ৯ মার্চ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার শংসাপত্র পুনর্নবিকরণের জন্য আবেদন করে ‘ডায়মন্ড সিটি সাউথ রেসিডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’। ১৫ মার্চ শংসাপত্রের মেয়াদ বাড়িয়ে আবাসিকদের সংগঠনকে বিজ্ঞপ্তি পাঠায় দমকল এবং জরুরি পরিষেবা বিভাগ। কৃষ্ণমূর্তি জানান, ওই বিজ্ঞপ্তিতে প্রথমেই স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘দমকলের গাড়ি, সরঞ্জাম পরিবহণের জন্য ড্রাইভওয়ে অবাধ রাখতে হবে। তাতে গাড়ি পার্ক করা চলবে না।’ বিজ্ঞপ্তির ২১ নম্বর পয়েন্টে লেখা ছিল, ‘এই বিজ্ঞপ্তি জারির ছ’মাসের মধ্যে ফাঁকা এলাকায় গাড়ি রাখার ছাওনি ভেঙে ফেলতে হবে।’ এর আগে এক বার হাই কোর্টে রিট পিটিশন করেন কৃষ্ণমূর্তি। তবে তা খারিজ হয়ে যায়। ফের ২০২২-র জুনে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করেন তিনি। আবেদনে আবাসিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আরও এক বার উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এরই মধ্যে গত ২৩ জুলাই ওই ফ্ল্যাট থেকেই গ্রেফতার হন অর্পিতা। ফ্ল্যাটের একটি ওয়ারড্রোব থেকে উদ্ধার হয়েছিল ২১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা নগদ, ৭৯ লক্ষ টাকার সোনার গয়না, ১৮টি মোবাইল ফোন। অর্পিতা গ্রেফতার হতেই ইডি প্রকাশ করে তিনি ‘পার্থ-ঘনিষ্ঠ’। আপাতত জেল হেফাজতে রয়েছেন পার্থ। অর্পিতাও। তাই এই বেআইনি নির্মাণ নিয়ে অর্পিতার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে কৃষ্ণমূর্তির দাবি, ‘‘ঘটনাক্রম থেকে স্পষ্ট, এর পিছনে প্রভাবশালীর হাত ছিল।’’