২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস, অশোক সেনগুপ্তর ভাবনা

 ‘শুভ বই দিবস। আমার বই কুণ্ঠ..’— এই শিরোনামে ফেসবুকে ‘বইপোকা’ গ্রুপে বই দিবসকে স্বাগত জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন অধ্যাপক রাজীব নন্দী।

তাতে তাঁর ‘বই কুন্ঠ’-তে রাখা ‘রাইজ অফ দি ডিজিটাল’ থেকে ‘ইভলিউশন অফ ট্রাডিশন’, ’ইন্ডিয়ান সিনেমা’, ন্যাশনালিজম, এথনিসিটি অ্যান্ড মিডিয়া এথিকস’, ‘ইতিহাস ও সাহিত্য প্রবন্ধমালা’— হরেক কিসিমের বই।

আজ বই দিবসে হঠাৎ ভাবলাম, কিছু একটা লিখি বই নিয়ে। আসলে এত লক্ষ বিষয় লেখা যায় বই নিয়ে! অনেকেই জানেন, বিশ্ব বই দিবস বা বিশ্ব গ্রন্থ দিবস (এছাড়া বিশ্ব বই এবং কপিরাইট দিবস বা বইয়ের আন্তর্জাতিক দিবস নামেও পরিচিত) হল পড়া, প্রকাশনা এবং কপিরাইট প্রচারর জন্য জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন (ইউনেস্কো) আয়োজিত একটি বার্ষিক দিবস। ২৩ এপ্রিল ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো প্রথমবারের মত বিশ্ব বই দিবস উপযাপন করে। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এই দিবস  যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ডে মার্চ মাসে পালন করা হয়। বিশ্ব বই এবং কপিরাইট দিবস উপলক্ষে, ইউনেস্কো বই শিল্পের প্রধান সেক্টর থেকে নির্বাচিত উপদেষ্টা কমিটির সাথে, এক বছরের একটি জন্য ওয়ার্ল্ড বুক ক্যাপিটাল নির্বাচন করে। প্রতিটি মনোনীত ওয়ার্ল্ড বুক ক্যাপিটাল শহর বই পাঠ, বইয়ের প্রচার এবং প্রচারের জন্য বছরব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে । ২০২৩ সালে ঘানার রাজধানী  আক্রাকে ওয়ার্ল্ড বুক ক্যাপিটাল হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।

ক’দিন আগে গিয়েছিলাম শিক্ষাবিদ ও প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাসের বাড়িতে। বেশ কিছু নামী সংস্থার পরামর্শদাতা/পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সুন্দর, ছিমছাম দোতলা বাড়িতে দুটি মাত্র প্রাণী— তিনি ও তাঁর স্ত্রী। চার ঘর বোঝাই বই। কত হবে সংখ্যায়? উত্তরে অচিন্ত্যবাবু বললেন, “তা হাজার পাঁচ তো হবেই!”

ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন অচিন্ত্যবাবু। তেমনই অঙ্ক নিয়ে খেলা করেন আইএএস দেবাশিস সোম। কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন কমিশনার পরবর্তীতে যোগ দেন বেসরকারি পরিষেবায়। এ রকম বইয়ের পাহাড় তাঁর বাড়িতেও। এর অনেকটাই গণিত-বিষয়ক। সামাজিক মাধ্যমে সেই পাহাড়প্রমাণ বই অনেকে দেখেছেন।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়িয়ে আছি।‘ আবার বই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ”বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সাঁকো।” – আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছিলেন, ”বইয়ের মত এত বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই।“ বই আর গ্রন্থাগার নিয়ে নানা সময়ে নানা মূল্যবাণ মন্তব্য করেছেন জ্ঞানীগুনিরা। বই চুরি, বই চোর, বই প্রকাশ প্রভৃতি নিয়ে অনেক গল্প আছে।

বই চুরি নিয়েই একটা রীতিমত থিসিস লেখা যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় পড়েছি, অপু তার বাবার বাক্স থেকে বই চুরি করত পড়ার জন্য। ২০০৫ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘বুক থিফ’ নিয়ে অসাধারণ মূল্যায়ণ করেছেন তপন মল্লিক চৌধুরী। তপনবাবু লিখেছেন, মারকুস জুসাক তাঁর ওই উপন্যাসের জন্য সেই সময় যথেষ্ট খ্যাতিও অর্জন করেছিলেন তবে আজ তাঁর কথা তেমন করে আর কারও স্মরণে নেই। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন জার্মানিতে যখন নাৎসি বাহিনী নিপীড়নের চরম ভয়াবহতা আর ধ্বংসলীলায় আপামর জনগণমনে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে ঠিক সেই সময়কার একটি অভাবনীয় ঘটনাকে তুলে ধরেন জুসাক তাঁর ‘বুক থিফ’-এ। আমরা মুখোমুখি হই লিসেল নামে এক কিশোরীর ঊদ্বেগতাড়িত অসহনীয় জীবনযাপনের সঙ্গে, তখন সে তার ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বিপন্ন বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত তবু মৃত্যু আর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকেও যে জীবনের স্বপ্ন দেখা সম্ভব সেই নিশ্চিত অসম্ভবকে আমরা দেখতে পেলাম লিসেল-এর মধ্যে। বই পড়ার মধ্যে সে ক্রমশই খুঁজে পেতে থাকে বেঁচে থাকার উৎসাহ, ক্রমশই তাকে ভর করতে থাকে বই, বিভিন্ন বইয়ের পাতায় পাতায় সে যেন খুঁজে পেতে থাকে আশ্চর্য থেকে অতি আশ্চর্যময় রত্ন সামগ্রী। বই-এর নেশায় সে মাতাল হয়ে পড়ে কিন্তু এসবই অতি গোপনে, সন্তর্পণে। কারণ, দুনিয়ার কোনও নাৎসি, কোনও ফ্যাসিবাদ কখোনোই বই বা তার পাঠকে সুনজরে দেখে না। একটি বইয়ের মধ্যেই থাকে বিপ্লবের বারুদ, একটি বইয়ের মধ্যেই থাকে আগুন শিখা, তাই নাৎসি জমানায় বই-এর ঠাঁই নেই। কিশোরী লেসলিও জেনেবুঝে ফেলেছিল সেকথা কিন্তু বই পড়ার গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারলেও লেসলি শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠল একজন বই চোর। লেসলিকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে নাৎসিরা, কোথায় লেসলি, কোন গোপন আস্তানায় সে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। নাৎসিদের তো লেসলিকে খুঁজে পেতেই হবে, তবে যত না বই চোর লেসলিকে তার চেয়ে অনেক বেশি যে, চুরি করে নাৎসিদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চায় সেই বই যার পাতায় পাতায় বারুদ ঠাসা, ছত্রে ছত্রে আগুনের শিখা। কারণ লেসলির মতো বই চোরেরাই পারে সভ্যতাকে ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে“ (বঙ্গদর্শন, ১০ জানুয়ারি ২০১৮)।

আবার বন্ধু সাংবাদিক নীলাঞ্জন হাজরার লেখায় পেয়েছি রেমন্ড স্কটের কাহিনী৷ “তাঁর অ্যান্টিকের ব্যবসা৷ জন্ম ১৯৫৭৷ যখন পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে, সেটা ২০০৮৷ সে সময় তাঁর ঠোঁটে দেখা যেত উত্‍কৃষ্ট সিগার৷ গ্যারাজে হলুদ ফেরারি৷ অভিযোগ, ১৯৯৮ সালে ডুরহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে একটি বই হাফিস করে দেন তিনি? একটা বই চুরির জন্য দশ বছর পর দরজায় পুলিশ? ঠিক তাই৷ কারণ বইটি ছাপা হয়েছিল ১৬২৩ সালে৷ উইলিয়াম শেক্সপিয়ার মারা যাওয়ার সাত বছরের মাথায় তাঁর নাটকগুলির প্রথম বার প্রকাশিত সংকলন৷ বড় জোর ২৫০ কপি ছাপা হয়েছিল সে সংকলন৷ শেক্সপিয়ার গবেষকদের কাছে এই দুষ্প্রাপ্য বইটি পরিচিত ‘First Folio of Shakespeare’s plays’ নামে৷ দুর্লভ বইয়ের বাজারে তার দাম ধার্য হয় আনুমানিক ৩০ লক্ষ পাউন্ড৷ মানে প্রায়, ২৮ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা৷ পাক্কা দশটি বছর আর কোনও হদিশ মেলেনি সে বইয়ের৷ তার পরেই মোক্ষম ভুলটা করে বসেন স্কট সাহেব৷ বিশ্বের বৃহত্তম শেক্সপিয়ার বিষয়ক গ্রন্থাগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি-র ফোলগার শেক্সপিয়ার লাইব্রেরিতে বইটি হাতে নিয়ে গটমটিয়ে গিয়ে সেটি বিক্রির চেষ্টা করেন৷ সঙ্গে দেন হাভানা শহরের এক নাইটক্লাবের নর্তকী বান্ধবীর মায়ের বাড়িতে এক প্রাচীন বাক্স থেকে বইটি পাওয়ার এক অলীক গপ্পো৷ সঙ্গে সঙ্গে এফবিআইকে খবর৷ তার পরেই গ্রেফতার৷ তিনি কখনও স্বীকার করেননি সেই চুরি৷ সত্যি বলতে কী, পুলিশ কোনও দিন প্রমাণ করতে পারেনি তিনিই বইটা হাফিস করেছিলেন৷ বিচারের পর ২০১০ সালে তাঁর জেল হয় ‘চোরাই মাল পাচারের চেষ্টার অপরাধে’৷ ২০১২ সালের ১৪ মার্চ জেলের কুঠরিতে স্কট আত্মহত্যা করেন“ (‘এই সময়’, ২৭ এপ্রিল, ২০১৫)৷

আর এক অনুজ সহকর্মী সুরবেক বিশ্বাসের লেখায় পেয়েছি, “আমি এক কবিকে চিনি এবং জানি, যিনি নিজেরই লেখা বই বহু বার বইমেলায় প্রকাশকের স্টল থেকে চুরি করেছেন। কেন? ওই কবির যুক্তি, ‘চুক্তি অনুযায়ী, প্রকাশক আমাকে ১০টা বই বিনামূল্যে দেন। কিন্তু বহু লোক আমার কাছে বই উপহার চান। মাত্র ১০টা বইয়ে সেই চাহিদা মেটে না। তাই, বাকি বইগুলো চুরি করি।’

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র অভিষেকের মতে, ‘বইচুরি যেমন একটা আর্ট, তেমন একটা টিমওয়ার্কও। একা বইচুরি করতে গেলে কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ দে’জ-এর অপু বলছেন, ‘বইচুরির মধ্যে ঠিক অপরাধ নেই, একটা মজা আছে। আর পড়ার জন্য বই চুরি মানে কিন্তু বইয়ের প্রতি, পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসারই পরিচয়। তাই, সে সব চোরদের প্রতি ঘৃণা জন্মায় না“ (‘এই সময় গোল্ড’)।’’

বই হয়ে ওঠে রাজনীতির হাতিয়ারও। যেমন ২০২৩-এর ২৩ এপ্রিল এই মুহূর্তের একটা খবর— “একের পর এক পাঠ্যবই থেকে নির্দিষ্ট বিষয় বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সরব কেরল সরকার। তাদের হুঁশিয়ারি, পড়ুয়াদের পাঠ্যবই তারা এ বার নিজে থেকেই ছাপাতে শুরু করবে। কেন্দ্রের ভরসায় থাকবে না।“

ওই রাজীব নন্দীর কথাতেই আসি। ভূপর্যটক অধ্যাপক বাংলা শব্দ নিয়ে খেলা করেন। তাই তো ভাবনার নির্যাসের মাথায় বসাতে পারেন ‘বইরাগী’ কথাটা। তাতে লিখেছেন, “কিছুদিন আগে ‘আমার বইকুণ্ঠ’ ক্যাপশনে লেখা একটি পোস্টে আমার দু’টি বুকশেলফের পুরো ছবি দিয়েছিলাম। সেই পোস্টে অনেক বইপড়ুয়া, সংগ্রাহক এবং সুহৃদের সাথে ইন্টারেক্ট হলো। আজ এটি আমার দ্বিতীয় পোস্ট, রইলো ‘পৌরাণিক সমগ্র’র ছবি। আমাদের পারিবারিক সংগ্রহশালাকে ক্যাটাগোরাইজ করছি করোনার গৃহবন্দী নিভৃত নিবাসের সময়টুকুতে। ধীরে ধীরে এভাবে সাংবাদিকতা, গণযোগাযোগ, রাজনীতি এবং লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে পর্ব করে করে “ক্যাটাগোরাইজড পোস্ট” করবো, শুধুমাত্র এই গ্রুপে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে সকলকে শুভেচ্ছা, প্রণাম ও ভালোবাসা।”

এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠছে, বিশ্বের কোনও কিছু নশ্বর নয়। বই কি চিরকালীন? আজকের দিনে বই মানেই একমাসের মাথায় তাঁর পিডিএফ বাজারে চলে আসা। তারপর টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে সেই বইয়ের পিডিএফের রমরমা। এভাবে বইয়ের আয়ু কি চিরকালীন হতে পারে? ‘জাগোনিউজ২৪.কম’ লিখেছে, “ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে হয়তো একদিন বইমেলাই আর হবে না। বইমেলা হবে ভার্চুয়ালি। সেখানে সবাই কনটেন্ট বিক্রি করবে। পাঠকরা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কনটেন্ট কিনবেন। ঘরে বসেই ঘুরে আসবেন ডিজিটাল বইমেলা থেকে। লেখক-পাঠকের কথা হবে ভার্চুয়ালি। সেদিন আর হয়তো বেশি দূরে নয়।”

পড়ার অভ্যাস কেড়ে নিয়েছে মুঠোফোন। ঐতিহ্যের গ্রন্থাগারগুলো ধুঁকছে। জীবনের বৈতরণী থেকে বাদ দিয়ে দিতে চাইছি বইকে। তা সত্বেও আমি আশাবাদী ফেসবুকে বই-বিষয়ক নানা গ্রুপের পোস্ট এবং আলোচনায়। সেগুলো পড়লে বোঝা যায় এখনও কত লোক মন দিয়ে বই পড়েন, কতজন স্মৃতি সত্বা ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছেন বইকে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন “জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই।” কথাটা এখনও কিন্তু অনেকের কাছেই সত্যি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.