অমলিন সুবাসের রূপকার

অস্টিন গাড়ি, রবীন্দ্রনাথ, রোভার সাইকেল, সুগন্ধি কেশতেল, লালচাঁদ বড়াল, মন ভরানো পানমশলা, বঙ্গভঙ্গ, সাহিত্য পুরস্কার— এক পঙ্‌ক্তিতে পাশাপাশি এমন বৈচিত্র দেখলে খটকা লাগা স্বাভাবিকই। কিন্তু এমন এক জন মানুষ আমাদের বাংলার ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছেন, যাঁর জীবনে মিলে গিয়েছিল এই সমস্ত কিছু। সেই মানুষটিই নিজের সব শৌখিন রুচিবোধকে কাজে লাগিয়ে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন ব্যবসায় বাঙালিভাগ্যের চাকা। মিলে গিয়েছিল সাহিত্য, শিল্প, সর্বোপরি ব্যবসার খুঁটিনাটি। তাই একবিংশ শতাব্দীর তাবড় বাঙালি ব্যবসায়ীরা আজও কারিগরি মুনশিয়ানার পাঠ নিতে পারেন তাঁর কাছেই।

‘‘কেশে মাখ ‘কুন্তলীন’

রুমালেতে ‘দেলখোস’

পানে খাও ‘তাম্বুলীন’

ধন্য হোক্‌ এইচ বোস।।’’

এই চার লাইনের ছোট্ট ছড়া তখনকার দিনে ছড়িয়ে পড়েছিল মুখে মুখে। যাঁর জন্য এই ছড়া, তিনিই বাংলা বাজারের ব্যবসার অন্যতম রূপকার। হেমেন্দ্রমোহন বসু। সংক্ষেপে ‘এইচ বোস’ নামেই বেশি জনপ্রিয়।

হেমেন্দ্রমোহনের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা ছিলই, পাশাপাশি তাঁর বাপ-কাকারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছিলেন স্বপ্রতিষ্ঠিত। ময়মনসিংহ জেলার জয়সিদ্ধি গ্রামে পদ্মলোচন বসুর তিন ছেলে— হরমোহন, আনন্দমোহন এবং মোহিনীমোহন। আনন্দমোহন ছিলেন ভারতের প্রথম র‌্যাঙ্গলার, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বিদেশের ডিগ্রিধারী মোহিনীমোহন ভারতের প্রথম হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা শিক্ষাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা। হরমোহন আবার দুই ভাইয়ের চেয়ে কম যান না। তিনি উকিল না হয়ে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সরকারি আদালতের মুন্সেফ হওয়াকেই। এর পিছনে ছিল তাঁর ভক্তিপ্রাণতা এবং সত্যানুরাগ। তাঁর চার ছেলে— হেমেন্দ্রমোহন, যতীন্দ্রমোহন, সুরেন্দ্রমোহন, সত্যেন্দ্রমোহন। এ রকম পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা হেমেন্দ্রমোহনের রুচি, ভাল লাগা যে আর পাঁচ জনের চেয়ে আলাদা হবে, তা বলাই বাহুল্য।

হেমেন্দ্রমোহন বরাবরই উজ্জ্বল ছাত্র ছিলেন। তুখড় বললেও কম বলা হয়। স্কুল পাশ করে ভর্তি হলেন বিএ’তে। তার পরে মেডিক্যাল কলেজে। মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পিছনে ছিল তাঁর আত্মীয় জগদীশচন্দ্র বসুর উৎসাহ। জগদীশচন্দ্র সেই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। এক দিন প্রেসিডেন্সির ল্যাবরেটরিতেই ঘটল দুর্ঘটনাটা। হেমেন্দ্রমোহন সেখানে এসেছিলেন বটানির কিছু গবেষণা করতে। অসাবধানতায় তাঁর চোখে এসে পড়ল রাসায়নিক দ্রব্য। সাড়ে পাঁচ মাস ধরে সুদীর্ঘ চিকিৎসার পরে চোখের ব্যান্ডেজ খুলল বটে, কিন্তু মেডিক্যাল কলেজে পড়ার ইতি ঘটল পুরোপুরি।

‘আগলী অ্যানিমেল’ ও প্রত্যাখ্যান

হেমেন্দ্রমোহনের রক্তেই ছিল ব্যবসা। তাই একের পর এক ব্যবসায় মেতেছেন তিনি। সফলও হয়েছেন চূড়ান্ত ভাবে। বাংলায় তথা ভারতে বহু ব্যবসার পত্তন ঘটিয়েছিলেন তিনি। যেমন ধরা যাক ‘এইচ বোস সাইকেল কোম্পানী’র কথা। ভারতীয় মালিকানায় প্রথম সাইকেলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল সেটাই। ভাই যতীন্দ্রমোহন বসুর সঙ্গে এ ব্যবসায় জোট বাঁধলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের কাছে হ্যারিসন রোডের উপরে তৈরি হল বড় শোরুম। তার পিছনে দেশি সাইকেল তৈরির কারখানা। ইংল্যান্ডে তৈরি রোভার সাইকেল আর ডারকাপ সাইকেলের ‘সোল এজেন্সি’ নিলেন হেমেন্দ্রমোহন। বিক্রির পাশাপাশি দিতেন সাইকেলে চড়তে শেখার পাঠও। জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র রায় থেকে শুরু করে নীলরতন সরকার— হাতে ধরে সাইকেলে চড়া শিখিয়েছিলেন হেমেন্দ্রমোহন। সুধীরকুমার সেন নিজের প্রথম রোভার সাইকেলটি কিনেছিলেন এই ‘এইচ বোস সাইকেল কোম্পানী’র শোরুম থেকেই।

কলকাতায় তখন মোটরগা়ড়ির সংখ্যা হাতে গোনা যায়। তাঁর চোখ এ বার সাইকেল ব্যবসা থেকে প়ড়ল মোটরগা়ড়ির দিকে। অবশ্য তার জন্য ছিল আগেকার সাইকেল কোম্পানি চালানোর অভিজ্ঞতা। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের এক প্রকাণ্ড বাড়িতে মোটরগাড়ির ব্যবসা খুলে বসলেন হেমেন্দ্রমোহন। নাম দিলেন ‘দি গ্রেট ইস্টার্ন মোটর ওয়ার্কস’। ইংল্যান্ড থেকে পাশ করা দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার প্রিসটনকে নিযুক্ত করা হল সুপারভাইজ়িং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। সমস্ত গাড়ি বিক্রির আগে শংসাপত্র বার হত প্রিসটনের হাত দিয়েই। ওই বাড়ির নীচে সামনের দিকে বড় শোরুম। তার পিছনে যন্ত্রপাতি সারানোর ব্যবস্থা। হেমেন্দ্রমোহন বিক্রির জন্য নিলেন স্টোনলে সিডলে ডেজি, অস্টিন আর ল্যান্ডলেট গাড়ির এজেন্সি। ব্যবসা ভালই চলত তাঁর। সাহেবসুবোরা তো কিনতেনই, বাঙালিরাও পিছিয়ে ছিলেন না। যে প্রথম বাঙালি ‘দি গ্রেট ইস্টার্ন মোটর ওয়ার্কস’ থেকে জার্মানিতে তৈরি বিখ্যাত গাড়ি ডারকাপ কিনেছিলেন, তিনি হলেন স্বনামখ্যাত চিকিৎসক সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী। নিজের জন্য ফ্রান্স থেকে তৈরি করে আনা ড্যারাক গাড়ি কিনেছিলেন হেমেন্দ্রমোহন। ১৯০৩ সালে ১ সিলিন্ডার এবং ১৯০৫ সালে
২ সিলিন্ডারের ড্যারাক কেনেন। চালানোর জন্য ড্রাইভারও রেখেছিলেন। ব্যবসা ভাল চলা সত্ত্বেও দীর্ঘস্থায়ী হল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বের বাজারে তখন আগুনের আঁচ। ১৯২০ সাল নাগাদ মোটরগাড়ির ব্যবসা বন্ধ করে দিলেন হেমেন্দ্রমোহন। তাঁর রুচিতে যেমন ছিল আভিজাত্যের ছোঁয়া, তেমনই মেজাজটাও ছিল উচ্চ তারের। গাড়ির ব্যবসা খোলার সময়ে আমেরিকার ফোর্ড কোম্পানিকে এজেন্সি নেওয়ার অফার ফিরিয়ে দিয়ে সেই গাড়িকে অবলীলায় ‘আগলী অ্যানিমেল’ বলার স্পর্ধা তিনিই দেখাতে পেরেছিলেন।

বন্দেমাতরমের আহ্বান, প্যাথে-রাজ

হেমেন্দ্রমোহন কোনও দিনই নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চাইতেন না। নতুন কিছু আবিষ্কার করার, কাছ থেকে দেখার ইচ্ছেশক্তি ছিল প্রবল। তাই ফোনোগ্রাফের কথা তাঁর কানে পৌঁছতেই মন নেচে উঠল। বিদেশ থেকে আনালেন এডিসনের ফোনোগ্রাফ যন্ত্র। ইচ্ছে, নতুন কোনও ব্যবসার গহীনে ঢুকে পড়ার। ধর্মতলায় বিখ্যাত জহুরি লাভোচাঁদ-মতিচাঁদের দোকানের লাগোয়া খুলে বসলেন নতুন ব্যবসা। নাম দিলেন ‘দি টকিং মেশিন হল’। যাকে বাংলায় বলা হত কলের গান, সেই গ্রামোফোন আনলেন। বারিদবরণ ঘোষ লিখছেন, ‘‘যন্ত্র আর রেকর্ডের ব্যবসামাত্র নয়, রেকর্ড তৈরি করা পর্যন্ত। কি বিস্ময়কর প্রতিভা আর অত্যাশ্চর্য উদ্যোগ! সিলিনডার রেকর্ডকে আবার প্যারিসের বিখ্যাত চার্লস প্যাথি কোম্পানি থেকে ডিস্‌ক রেকর্ডে পরিণত করিয়ে ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম ‘প্যাথেফোন’ যন্ত্রের প্রবর্তন করলেন।’’ হেমেন্দ্রমোহনের সঙ্গীতপ্রেমকে কাজে লাগিয়ে সেই যে শুরু, এর পর পুরোটাই ইতিহাস। ধর্মতলায় মার্বেল হাউস নামেই বেশি পরিচিত সেই বাড়ির দোতলায় এর পর একে একে কে না এলেন… রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, প্রমদারঞ্জন রায়, লালচাঁদ বড়়াল থেকে উস্তাদ রমজান খান, পিয়ারা সাহেব, মানদাসুন্দরী দেবী, নরীসুন্দরী, কাশীবাবু, পূর্ণ কুমারী, মহম্মদ হুসেন, দেবেন বন্দ্যোপাধ্যায়, এস সি সমাজপতি,
জি জি গুপ্ত, নীরোদা বাঈ পর্যন্ত! এইচ বোসের প্যাথেতে রবীন্দ্রনাথের রেকর্ডিংয়ের সংখ্যা ছাড়িয়েছিল একুশেরও বেশি। ‘লুকোচুরি’, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি’, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’, ‘অয়ি ভুবন মনমোহিনী’, ‘বন্দেমাতরম’ যার মধ্যে অন্যতম।

কিন্তু এইচ বোসের গ্রামোফোনের ব্যবসাও এক সময়ে ডুবতে বসল। চারপাশে তখন আছড়ে পড়ছে বঙ্গভঙ্গের ঢেউ। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে সদ্য রেকর্ড করা বহু গান বাজারে প্রকাশও করা হয়নি। এরই মাঝে পুলিশ এল ৫, শিবনারায়ণ দাস লেনে হেমেন্দ্রমোহনের বাড়ি। স্বদেশি গান ভেবে বহু মূল্যবান রেকর্ড পুলিশ নষ্ট করে দিয়ে গেল। যেটুকু বাকি ছিল, তার বিনাশ লেখা ছিল তৎকালীন কলিকাতা কর্পোরেশনের হাতে। শহরে প্লেগ চলাকালীন বাড়ি বাড়ি হানা দিত কর্পোরেশনের লোক। আর ‘‘ঘর জীবাণুমুক্ত করতে এসে গৃহ সংগীতমুক্ত করে গেল!’’ এর পাশাপাশিই আধুনিকীকরণের পথ সুপ্রশস্ত হচ্ছিল। সিলিন্ডার রেকর্ড আর নয়, বাজার ছেয়ে যাচ্ছিল ডিস্কে। হেমেন্দ্রমোহন চেষ্টা করেছিলেন প্যাথিদের দিয়েই ডিস্ক তৈরি করাতে। কিন্তু প্যাথিরা তখন সিনেমার কাজে বাঁধা। অগত্যা হেমেন্দ্রমোহন এই ব্যবসাও তুলে দিলেন!

কাচের নল, ফুলেল গন্ধ

হেমেন্দ্রমোহনের অধিকাংশ ব্যবসাই কমবেশি কয়েক বছর পরে হয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, নয়তো নিজের ব্যবসায়িক দূরদর্শিতা কাজে লাগিয়ে তা গুটিয়ে এনেছিলেন সময় থাকতেই। কিন্তু যে ব্যবসা কখনও তাঁকে হতাশ করেনি, তা হল সুগন্ধির। খুব কম বয়স থেকেই শুরু করেছিলেন চুলের তেল, পানের মশলা, গায়ের আতর তৈরি। পুণ্যলতা চক্রবর্তী তাঁর পিসেমশাই হেমেন্দ্রমোহন সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘‘ছোট পিসিমারা আমাদের কাছেই একটা বাড়িতে থাকতেন।— সে বাড়ির তিন-তলায় লম্বা একটি ঘরে পিসেমশাই হেমেন্দ্রমোহন বসু (এইচ বোস) তাঁর লেবরটরি করেছিলেন; সেখানে বসে তিনি নানা রকম সুগন্ধি তৈরীর পরীক্ষা করতেন। ঘরটার দিকে গেলেই সুগন্ধ ভুরভুর করত। কত রকমের শিশি বোতল, রাশি রাশি ফুল, চোলাই করবার যন্ত্র, বড় বড় পাথরের খল ও হামানদিস্তা; এককোণে একটা সোডা তৈরীর কল, সে রকম আমরা আগে কখনও দেখিনি। হাতল টিপলেই ভুরভুর করে নল দিয়ে সোডা ওয়াটার বেরোত, সিরাপ মিশিয়ে আমাদের খেতে দিতেন, রুমালে জামায় সুগন্ধ এসেন্স দিয়ে দিতেন।’’

হেমেন্দ্রমোহন রংবেরঙের কাচের জার-নল, ছোট ছোট আবিষ্কার দিয়ে যে ভাবে ওই সামান্য বালিকাকে মুগ্ধ করতে পেরেছিলেন, না জানি তাঁর কতটা প্রভাব ছড়িয়েছিল বাঙালি সমাজে! ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় হেমেন্দ্রমোহনের সুগন্ধি ব্যবসার সুবিশাল বৈচিত্রের কথা। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভাল যে, ব্যবসার ব্র্যান্ড ভ্যালু বোঝার অসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর এবং বাঙালিকে তা শিখিয়েওছিলেন। তাই শুধু ব্যবসার জন্য হরেক জিনিস প্রস্তুত করেই ক্ষান্ত থাকেননি। ঠিক মতো বিজ্ঞাপন দিয়ে, নিজের প্রচার করে ব্যবসা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তৈরি করেছিলেন নিজস্ব খাঁটি বাঙালি ব্র্যান্ড। সুবাসিত, পদ্মগন্ধ, গোলাপ, যুঁই, চন্দন, বোকে, ভায়োলেট কুন্তলীন— এই সাত রকমের চুলের তেল ছাড়াও নানা সুগন্ধি পাওয়া যেত। আতরিন, ল্যাভেন্ডার ওয়াটার, মৃগনাভি ল্যাভেন্ডার, অ-ডি-কোলন, রোজ ও সুপিরিয়র পমেটমস, মিল্ক অফ রোজ, টয়লেট পাউডার, রোজ কার্বলিক টুথ পাউডার… তখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে হেমেন্দ্রমোহনের কল্পনা এবং তা বাস্তবায়িত করার ক্ষমতা দেখে রীতিমতো অবাক হতে হয়। আর দাম? এক বোতল বড় ভায়োলেট কুন্তলীনের সবচেয়ে বেশি দাম পড়ত মেরেকেটে তিন টাকা! দাঁতের মাজন মিলত তিন আনায়। এগুলোর পাশাপাশি ছিল পানে খাবার তাম্বুলীন, ক্যাস্টর অয়েল— ক্যাস্টারীন, অপরাজিতা সেন্ট, স্পেশাল এসেন্স, কোকোলীন সাবান, সিরাপ, গোলাপ দন্তমঞ্জন, ফ্লোরিডা।

১৮৮১ সালের কুন্তলীন তেলের পরেই দেলখোস সুগন্ধি এল বাজারে। তার সুঘ্রাণ এত দূর ছ়ড়িয়ে পড়ল যে, হেমেন্দ্রমোহনের বৌবাজার স্ট্রিটের বাড়ির নামই হয়ে গিয়েছিল দেলখোস হাউস। বলা ভাল, সকালের দাঁতের মাজন থেকে শুরু করে রাতে শুতে যাওয়ার আগে কোষ্ঠকাঠিন্যের ওষুধ— সমস্ত কিছুর সন্ধান মিলত হেমেন্দ্রমোহনের কাছে। আর কারা ছিলেন না কুন্তলীন-দেলখোসের গুণমুগ্ধ? স্যর প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ইন্ডিয়া কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্যার কে জি গুপ্ত, নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, লালা লাজপত রায়, মতিলাল নেহরু… নাম অসংখ্য।

এখানে অবশ্যই উচিত একটি অভিমতের কথা তুলে ধরা। ‘‘কুন্তলীন তৈল আমরা দুইমাস কাল পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। আমার কোন আত্মীয়ের বহু দিন হইতে চুল উঠিয়া যাইতেছিল। কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে তাঁহার নূতন কেশোদ্গম হইয়াছে। এই তৈল সুবাসিত, এবং ব্যবহার করিলে ইহার গন্ধ ক্রমে দুর্গন্ধে পরিণত হয় না।’’ এর লেখক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আর আকাশবাণী কলকাতা থেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উদাত্ত কণ্ঠে প্রকাশ্যে বলে উঠেছিলেন, ‘‘তেলে-জলে কখনও মেশে না, কিন্তু তবুও একথা মানতেই হয় যে অন্তত একটি তেল আমাদের সাহিত্যরূপ জলের সঙ্গে নিতান্ত নিগূঢ় ভাবেই মিশে আছে। সেটি কুন্তলীন।’’

ফরমায়েসি গল্প, ‘অব্যক্ত’ বিজ্ঞাপন

এই কুন্তলীন নামটার হাত ধরেই জুড়ে গেল ছাপাখানা ও সাহিত্য পুরস্কারের গল্পও। ঠিকানা ৬২, বৌবাজার স্ট্রিট। সেই বাড়িতে বিশাল ছাপাখানা খুললেন হেমেন্দ্রমোহন। কুন্তলীন প্রেস থেকে ছাপা হওয়া বইগুলো চাক্ষুষ না করলে তার গুণগতমান সম্পর্কে বোঝানো মুশকিল। ‘‘এই প্রেসের রোটারি মেশিনে তিনিই ভারতবর্ষে প্রথম মনোটাইপ ও লাইনোটাইপ প্রথা প্রবর্তনের উদ্যোগ করেন।’’ ছাপার কাজ বৌবাজার স্ট্রিটের বাড়িতে হলেও ব্লক তৈরি হত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে। ‘‘তিনি বঙ্গসাহিত্যের উৎসাহদাতা ছিলেন। কুন্তলীন পুরস্কার নাম দিয়া তিনি প্রতি বৎসর কয়েকটি গল্পের একখানি পুস্তিকা মুদ্রিত করিয়া বিতরণ করিতেন এবং এই সকল গল্প লেখককে নগদ টাকা বা তাঁহার গন্ধদ্রব্য পুরস্কার দিতেন, বিক্রেয় পণ্যের সংশ্রবে পুরস্কার দানের ব্যবস্থা করিয়া সাহিত্য-চর্চায় উৎসাহ দানের প্রথা বোধ হয় তিনিই সর্ব প্রথম বঙ্গদেশে প্রবর্তিত করেন।’’ এ ভাবেই জন্ম নিল কুন্তলীন পুরস্কার। তবে শর্তও ছিল। এই ধরনের ফরমায়েসি লেখায় কুন্তলীন ও দেলখোসের অবতারণা করতে হবে, কিন্তু তা যেন কোনও ভাবে বিজ্ঞাপনে পরিবর্তিত না হয়। লেখকের অভাব কোনও দিনই হয়নি এ ক্ষেত্রেও। প্রতিযোগিতা শুরু হয় ১৩০৩ বঙ্গাব্দে। প্রথম পুরস্কৃত গল্পের নাম ছিল ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’। লেখকের নাম তখন প্রকাশিত না থাকলেও বলতে দ্বিধা নেই যে, সেই গল্পের রচয়িতা আর কেউ নন, জগদীশচন্দ্র বসু। পরে ‘অব্যক্ত’তে সেই গল্পটিই পরিবর্জন ও পরিমার্জনার পরে সঙ্কলিত হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘মন্দির’ও পুরস্কৃত হয় কুন্তলীন পুরস্কারের সম্মানে। কুন্তলীন পুরস্কার পুস্তিকার জন্য রবীন্দ্রনাথ ‘কর্মফল’ গল্পটি লিখে সাম্মানিক পেয়েছিলেন ৩০০ টাকা। কুন্তলীন পুরস্কারের জন্য ১০০ টাকা বরাদ্দ ছিল। প্রথম স্থানাধিকারী পেতেন ১০০ টাকা। এ ভাবে ২৫, ২০, ১৫, ১০ এবং পঞ্চম থেকে দশম স্থানাধিকারীকে ৫ টাকা দেওয়া হত।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে হেমেন্দ্রমোহনের হৃদ্যতা শুধু মাত্র ব্যবসায়িক ছিল না। তিনি বিয়ে করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের ছোট বোন মৃণালিনীকে। ব্যবসার সূত্রতা বাঁধা পড়েছিল আত্মীয়তাতেও। এত কিছুর কান্ডারি যে মানুষটি, তাঁর গৃহিণীও যে অনন্য হবেন, তা-ই স্বাভাবিক। তবে মৃণালিনীদেবীর স্বকীয়তা ছিল ঘরে, নিজের সংসার সামলানোর মাঝে। বহু সন্তানের জননী হওয়া সত্ত্বেও তিনি কারও প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন না। স্বামীর সমস্ত কর্মযজ্ঞের পিছনে মৃণালিনীদেবীর ছিল অপরিসীম ধৈর্য এবং নীরব সাহচর্য। ছেলেদের নিয়ে মাঝেমাঝে স্বামীর ড্যারাক গাড়িতে চেপে বেড়াতে যেতেন তিনি। হেমেন্দ্রমোহনও বুঝেছিলেন তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণীর ক্ষমতা। হেমেন্দ্রমোহন-মৃণালিনীর চোদ্দো সন্তানের মধ্যে পরবর্তী কালে অনেকেই নিজেদের ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। যেমন চিত্রপরিচালক নীতিন বসু, ক্রিকেটার কার্তিক বসু, সঙ্গীত শিল্পী মালতী ঘোষাল প্রমুখ।

যন্ত্ররসিক, আলোকচিত্রী

ছবি তোলার ঝোঁকটা হেমেন্দ্রমোহনের এসেছিল জগদীশচন্দ্রের হাত ধরেই। ছবির প্রতি ভালবাসা হেমেন্দ্রমোহনকে এতটাই বশ করেছিল যে, তিনি বিদেশ থেকে শুধু একাধিক ক্যামেরা আনিয়েই ক্ষান্ত হননি, নিজের বাড়িতেই তৈরি করেছিলেন ডার্করুমের। সেখানেই নিজের হাতে তোলা ছবি ডেভেলপ করতেন তিনি। এমনকি রঙিন ফিল্মের ব্যবস্থাও তাঁর হাত ধরে। আবার এখানে ছবিতে থ্রি ডায়মেনশন বা ত্রিমাত্রিক ভাবনাও প্রথম তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। ১৯০৫-০৬ সাল নাগাদ তাঁর তোলা স্ত্রী মৃণালিনীদেবীর একটি ছবি এখনও দেখতে পাওয়া যায়। মৃণালিনীদেবীর শাড়ির আঁচলে লাগানো ব্রোচ। তাতে জ্বলজ্বল করছে ‘বন্দেমাতরম’। হেমেন্দ্রমোহনের তোলা ছবির অসংখ্য নেগেটিভ বা স্লাইড নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ক্ষতি শুধু আলোকচিত্র ইতিহাসেরই হয়নি। বঙ্গভঙ্গের সময়ে তোলা তাঁর একাধিক ছবির মধ্য থেকে হাতে গোনা ছবিই এখন বর্তমান। স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে বিভিন্ন জনজমায়েতের ছবি হেমেন্দ্রমোহন তুলতেন পেশাদার আলোকচিত্রীর মতোই। স্লো স্পিড ফিল্ম, ভারী ক্যামেরা, কাচের নেগেটিভ, কাঠের ট্রাইপড স্ট্যান্ড— হেমেন্দ্রমোহনের শখ আর ভালবাসার কাছে কিছুই অন্তরায় ছিল না। রঙিন ফিল্মের পাশাপাশি মুভি ক্যামেরাও আনিয়েছিলেন বিদেশ থেকে। হেমেন্দ্রমোহনের ছেলে নীতিন বসু বাবার আনা মুভি ক্যামেরাতেই হাত পাকিয়েছিলেন। গ্রুপ ফোটোর পাশাপাশি পোর্ট্রেটেও ছিল হেমেন্দ্রমোহনের দক্ষতা। স্টিরিয়োস্কোপিক অটোক্রোম প্লেটে রবীন্দ্রনাথের ছবিও তুলেছিলেন এইচ বোস। চৌকোনা পকেট টর্চ লাইটও
এ দেশে এসেছে তাঁর হাত ধরেই।

তবুও শান্তি, তবু আনন্দ,
তবু অনন্ত জাগে

যে মানুষটির জীবন জুড়ে শুধুই শৌখিনতার প্রলেপ, তাঁর যে চায়ের প্রতি সখ্য গড়ে উঠবে, এ বলাই বাহুল্য। চা খাওয়ার ফ্যাশনদুরস্ত রীতিও নাকি তাঁর হাত ধরেই। নিয়মিত চা পান
করবেন বলে সরাসরি চিন থেকে আনিয়েছিলেন চায়ের বাসনপত্র। দার্জিলিংয়ে ছিল তাঁর নিজস্ব চা-বাগানও। চিনে পেয়ালা-পিরিচে দার্জিলিংয়ের আস্বাদ গ্রহণ করার মেজাজ ছিল তাঁর। তেমনই ছিল পানের প্রতিও প্রীতি। নানা মশলা আর সুগন্ধে জারিত পান যদি আয়েস করে না খেলেন, তা হলে সেই মৌতাত আর জমবে কী করে? আর এখানেই হল বিপত্তি।

নিয়মিত পান খাওয়ার ফলে হেমেন্দ্রমোহনের দাঁতে ছোপ পড়ছিল। যে মানুষটি বিলেত থেকে আনা ‘পিক্‌ফ্রীন বিস্কুট’ আর প্যারিস থেকে আনা ‘ক্যাড্‌বেরি ফ্রাই’য়ে কামড় বসান, তাঁরই দাঁতে ছোপ! সবেমাত্র বাহান্নয় পা রেখেছেন হেমেন্দ্রমোহন। ঠিক করলেন দাঁতে স্ক্রেপ করাবেন, তা-ও আবার বিলিতি কায়দায়। করিয়েওছিলেন। কিন্তু স্ক্রেপ করার ঠিক দু’দিনের মাথাতেই শুরু হল দাঁত থেকে অনর্গল রক্ত পড়া। একই সঙ্গে প্রবল জ্বর, বেহুঁশ অবস্থা, অসহনীয় যন্ত্রণা। মাঝেমাঝেই প্রলাপ বকেন। সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী, প্রাণকৃষ্ণ আচার্য, দ্বিজেন্দ্র মৈত্রের মতো প্রখ্যাত চিকিৎসকের প্রবল প্রচেষ্টাও হার মানল। চিকিৎসক প্রাণধন বসু নাড়ি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বাড়ির উল্টো দিকের মর্টন ইনস্টিটিউশনের স্কুলঘড়ি ঢং ঢং করে জানান দিচ্ছে বিকেল চারটের কথা। পাশ থেকে শোনা যাচ্ছে স্ত্রীর অস্ফুট মগ্ন প্রার্থনা। দিনটা ছিল ১৯১৬র ২৮ অগস্ট। হেমেন্দ্রমোহন পাড়ি দিলেন।

জনশ্রুতির ওই ছড়াটা আবারও মনে করলো বলতেই হয়, কুন্তলীন-দেলখোস, তাম্বুলীনের সুবাসে এইচ বোস যত না বেশি ধন্য হয়েছিলেন, তার চেয়ে ঢের গুণ বেশি ঋণী করে গিয়েছেন আমাদের। এই বাঙালি জাতি যাঁরা এখনও স্বপ্নের উড়়ানে ভর দিয়ে পা়ড়ি দিতে চায়, যাঁরা আজও স্পর্ধা দেখিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে পড়তে পারে অজানা ব্যবসার অলি-গলিতে, যাঁদের ঐতিহ্যের পরতে পরতে আভিজাত্যের অহঙ্কার আর জয় করার গর্ব… হেমেন্দ্রমোহন তাঁদের পথ দেখিয়েই যাচ্ছেন। অবিরাম…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.