শ্রীভূমি-জটে ঠায় দাঁড়িয়ে অ্যাম্বুল্যান্স, মুহুর্মুহু হুটার বাজিয়েও এগোতে পারল না একচুল, সঙ্কটে রোগীপ্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে গাড়ি নড়ছে না ভিআইপি রোডে।

মুহুর্মুহু হুটার বাজিয়েও অ্যাম্বুল্যান্স একচুল এগোতে পারেনি। এ দিকে, সেই অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতরে শুয়ে থাকা, হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত রোগীর শারীরিক অবস্থার আচমকাই অবনতি হয়েছে। তাঁকে স্থিতিশীল রাখতে অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে জরুরি পরিস্থিতির ওষুধ দেওয়াও শুরু করেছেন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট। প্রমাদ গুনছেন অ্যাম্বুল্যান্সের চালক। শেষে কোনও ভাবে গাড়ি ঘুরিয়ে, অন্য পথ দিয়ে রোগীকে নিয়ে সেই অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছল ইএম বাইপাসের রুবি মোড়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে।
গত শনিবার মহালয়ার সন্ধ্যায় এমনই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল রোগী-সহ ওই অ্যাম্বুল্যান্সকে। কারণ, সেই রাতেই ভিআইপি রোডের উপরে শ্রীভূমি স্পোর্টিংয়ের পুজো মণ্ডপ খুলে দেওয়া হয়েছিল দর্শনার্থীদের জন্য। গত বছরের মতো এ বারও ভিড় ও যানজট নিয়ে শ্রীভূমির পুজো উদ্যোক্তাদের সতর্ক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবু উদ্বোধনের পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ কার্যত উড়িয়ে, দর্শনার্থীদের ভিড়ের চাপে যানজটের ফাঁসে বার বার আটকে পড়েছে ভিআইপি রোড ও সংলগ্ন এলাকা। মহালয়ার রাতে তেঘরিয়া এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সঙ্কটজনক ওই রোগীকে রুবি মোড়ের কাছে ওই বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হচ্ছিল। কিন্তু ‘প্রভাবশালী’ পুজোর জেরে লেক টাউন মোড়ের কাছে প্রায় ৪৫ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে তেঘরিয়ায় রোগী আনতে যাওয়া অ্যাম্বুল্যান্সটি। চালকের কথায়, ‘‘প্রতি বার পুজোয় লেক টাউন-ভিআইপি এলাকায় যানজট হয়। আমরা যানজটে কম-বেশি আটকালেও মোটামুটি সময়ের মধ্যেই গন্তব্য হাসপাতালে পৌঁছে যাই। কিন্তু শনিবার ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ৪৫ মিনিট ধরে রাস্তায় আটকে। গাড়ি নড়ছে না। শুনলাম, পিছনে কেবিনে রোগীর অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে গিয়েছে। তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।’’

শেষ পর্যন্ত কোনও ভাবে লেক টাউন মোড়ের কাছ থেকে উল্টো দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে চিনার পার্কের দিকে ছোটেন অ্যাম্বুল্যান্সের চালক। সেখান থেকে নিউ টাউন ও সল্টলেক ঘুরে অবশেষে পৌঁছন রুবি মোড়ের কাছে ওই হাসপাতালে। চালকের কথায়, ‘‘সাধারণ সময়ে আসতে আধ ঘণ্টা লাগে। সে দিন ৪৫ মিনিট আটকে থাকার পরে রোগীকে নিয়ে ওই হাসপাতালে পৌঁছতে আরও এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়।’’
ঘটনাটি বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশের এক পদস্থ আধিকারিককে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কেউ বিষয়টি জানাননি। তবে যানজটে গাড়ি নড়তে না পারলে সেখানে অ্যাম্বুল্যান্সও আটকে পড়বেই। তা না-হলে অ্যাম্বুল্যান্সের আলাদা জায়গা করে দেওয়া হয়। উদ্বোধনের দিনে দর্শকদের সারিতেও এক জন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে, সার্ভিস রোডে তাঁদের গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে তাঁকে উঠিয়ে দেয়।’’ এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে শ্রীভূমির প্রধান উদ্যোক্তা তথা রাজ্যের মন্ত্রী সুজিত বসু এবং পুজো কমিটির সম্পাদক দিব্যেন্দু গোস্বামীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা হলেও তাঁরা ফোন ধরেননি, টেক্সট মেসেজেরও উত্তর দেননি।

ভিআইপি রোড সংলগ্ন এলাকায় অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা প্রদানকারী কয়েকটি সংস্থা জানাচ্ছে, গত দু’-তিন বছর ধরেই পুজোর সময়ে শ্রীভূমি-ত্রাসের কারণে বিকেলের পরে তারা ভিআইপি রোড যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে। মতিঝিল এলাকার একটি অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংস্থা জানাচ্ছে, গত রবিবার শ্রীভূমির কারণে দীর্ঘ যানজটে আটকে পড়েছিল তাদের একটি অ্যাম্বুল্যান্সও। সেটি রোগী নিয়ে এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিল। উল্টোডাঙা উড়ালপুল থেকে লেক টাউন মোড় পর্যন্ত রাস্তাটুকু পেরোতে ওই অ্যাম্বুল্যান্সের লেগে যায় প্রায় ৪৫ মিনিট। তাই পুজোর এই সময়ে শ্রীভূমি-আতঙ্কে ভিআইপি রোড এড়িয়ে চলতেই চেষ্টা করে ওই অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংস্থাগুলি। তারা জানিয়েছে, পুজোর আবহে বিমানবন্দর, কৈখালির মতো এলাকা থেকে কলকাতার হাসপাতালে রোগীকে আনতে হলে ভিআইপি রোডের বদলে নিউ টাউন, সল্টলেক পেরিয়ে রোগী নিয়ে যায় তাদের অ্যাম্বুল্যান্স। আর বাগুইআটির দিকের রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হলে কেষ্টপুর খালধারের পাশের রাস্তা দিয়ে, সল্টলেক পেরিয়ে রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হয়।

অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংস্থাগুলি মনে করছে, পুজোর সময়ে যানজটের জেরে তাদের এই সমস্যার কথা ভেবে দেখা উচিত পুলিশ-প্রশাসনের। নাগেরবাজার এলাকার একটি অ্যাম্বুল্যান্স সংস্থার মালিকের কথায়, ‘‘এটা তো মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। আধ ঘণ্টার রাস্তা আমরা দু’ঘণ্টায় নিয়ে যেতেই পারি। কিন্তু রোগীর শারীরিক অবস্থা যদি সেই ধকল নিতে না পারে, কিছু হলে তার দায় কে নেবে? এইটুকু বিচক্ষণতা কি আমরা প্রশাসনের থেকে আশা করতে পারি না?’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.