কার্তিক মাসের আলপনা

বাঁদনা পরব অনুষ্ঠিত হয় কার্তিক মাসে। আঁকা হয় আলপনা। বাঁদনা পরবের মূল বিষয় গো-বন্দনা। জঙ্গলমহলে এরই নাম ‘সোহরী’। ওঁরাও, মুণ্ডা, বিরহোর, কোরোয়া, অসুর সম্প্রদায়ের মধ্যে এর নাম ‘সোহরাই’। কৃষকের নিত্যসঙ্গী অবলা পশু দিয়ে সারাবছর চাষাবাদ হয়েছে, এদিন তাদের গুছিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। এদিন গোয়ালে আঁকা হবে লক্ষ্মীর পা, গোবর্ধন পর্বত। জোয়াল-লাঙ্গলে লাগানো হবে গুঁড়ির ফোঁটা। গোয়াল থেকে কুলি বা সদর দরজা পর্যন্ত আলপনা দেন সাঁওতাল রমণী। আলপনায় জায়গায় জায়গায় সিঁদুরের বিন্দু দেওয়া হয়। গরুকে স্নান করিয়ে, শিঙে তেল সিঁদুর দিয়ে যত্ন করে, গায়েও পিটুলি ছাপের অলংকরণ করা হয়৷ গোশালার দেওয়ালেও ফুটে ওঠে আলপনার নান্দনিকতা।

ভারতের নানান প্রান্তে গো-কেন্দ্রিক, গো-আধারিত, গো-পালক সমাজে যে বহুবিচিত্র লোকানুষ্ঠান উৎযাপিত হয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে কখনো লৌকিক, কখনো শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান। শাস্ত্রীয় ও লৌকিক — সব মিলেমিশেই এক সমন্বিত রূপ পরিগ্রহ করেছে ভারতীয় সংস্কৃতি। ‘বাঁদনা পরব’, ‘সোহরী’, ‘সোহরাই’ প্রভৃতি একই লক্ষ্যে রচিত সাংস্কৃতিক পালপার্বণ। গোপাষ্টমী, গোষ্ঠাষ্টমীও সেই বৃহত্তর বৃত্তেরই অমল সংস্কৃতি, এক অনবদ্য উত্তরাধিকার। সম্বৎসর গাই আর গোপীদের শ্রমে কৃষিফসলে গোলা উঠেছে ভরে, দুধের শ্বেতবিপ্লব। যাদের জন্য পাওয়া গেছে পুষ্টিকর দুধ, গোবর সার, জ্বালানি ঘুঁটে — আজ তাদেরই যত্ন করবার দিন। ধানের পরই গো-সম্পদের কদর! গরুকে নিয়েই চিরন্তন ভারতবাসীর চিরকালের উৎসাহ! গরুকে অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছে নারীসমাজ। লোকসাহিত্য থেকে শিষ্টসাহিত্য সর্বত্র তার অনুরণন। লৌকিক ছড়ায়, “ধান ধন বড় ধন/আর ধন গাই।/সোনারূপা কিছু কিছু/আর সব ছাই।” সবচেয়ে বড় ধন কন্যাশক্তি।

(আলপনার ঋণ স্বীকার: সংস্কার ভারতী, ১৪৩০ বঙ্গাব্দের ক্যালেণ্ডার)

কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.