Agnipath scheme: পাকিস্তান-চিন শত্রু আমাদের, ওদের রুখতে অগ্নিপথই ভারতের জন্য সঠিক রাস্তা

অগ্নিপথ নিয়ে খুব গোলমাল চলছে। দেশজোড়া সেই গন্ডগোল টনক নড়িয়েছে সরকারের। হঠাৎ করে সামরিক বাহিনীতে চাকরির এমন সুন্দর একটা প্রকল্প নিয়ে গোল কেন বাধল? কেন দেশের হাজার হাজার তরুণ রাস্তায় নেমে পড়লেন? আগুন জ্বালিয়ে দিলেন রেলওয়ে সিস্টেমে? ভাবনা ধরানোর মতো বিষয়। পাশাপাশি, আরও একটা জিনিস ভাবাচ্ছে। এই তরুণ সম্প্রদায়ের পথে নেমে পড়া সরকারকে বাধ্য করেছে প্রকল্পের রূপরেখায় বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনতে। আচ্ছা, সরকার তো এটা আগেই করতে পারত? একটু আঁটঘাট বেঁধে নামা। নামতে পারত না?

মনে রাখতে হবে, সামরিক বাহিনীর সদস্য হওয়াটা এখনও এ দেশের একটা বড় অংশের কাছে গর্বের। আমি যখন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্য হয়েছিলাম, তখনও দেখেছি, আমাদের মধ্যে একটা আবেগ কাজ করত। শুধু আমার নয়। আমার সঙ্গে সেই সময় যাঁরা কাজ করেছেন, সকলের। পরে যখন দেশের সেনাপ্রধান হয়েছি, তখনও দেখেছি, সকলের মধ্যে কী ধরনের আবেগ কাজ করে! আর এখনকার ছবিটাও দেখলাম। একটুও বদলায়নি! গত কয়েক দিন ধরে সংবাদমাধ্যমে একের পর এক ছবি দেখেছি। এবং উপলব্ধি করেছি, প্রতিবাদ-বিক্ষোভের কারণটা আসলে সামরিক বাহিনীর সদস্য হওয়াকে কেন্দ্র করেই। ফলে সেই আবেগটা এই প্রজন্মের মধ্যেও বেঁচে আছে। সেটা বুঝতে এবং জানতে পেরে ভাল লাগছে। ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়াটা কিন্তু কোনও ভাবেই বাধ্যতামূলক নয়। সম্পূর্ণ ভাবেই ‘স্বেচ্ছামূলক’। আমরা যাকে ‘ভলান্টারি’ বলি। আমার বিশ্বাস, অগ্নিপথের আসল উদ্দেশ্য ভারতীয় সামরিক বাহিনীর শক্তি বাড়ানো। শক্তি তখনই বাড়বে, যখন তার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। সরকার সেটাই চাইছে। এ বার যেটা হল, সাধের সঙ্গে সাধ্যের ফারাক দেখা দিল। বাজেট কমাব আবার শক্তিও বাড়াব! দুটো একসঙ্গে করতে গেলে যেটা হয়, সেটাই হল। তৈরি হল বিতর্ক। সামরিক বাহিনীর মানবসম্পদ বৃদ্ধি করতে গেলে নিয়োগে জোর দিতেই হবে। অথচ আর্থিক সঙ্গতি নিয়ে চিন্তা রয়েছে। ফলে একটা বিশেষ পথ অবলম্বন করতে হল সরকারকে। চার বছরের ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ’। তার পর সেখান থেকে ২৫ শতাংশ ‘অগ্নিবীর’কে তিন বাহিনীতে শূন্যপদ এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তি করানো হবে। বাকি ‘অগ্নিবীর’দের উপযুক্ত আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হবে মূলস্রোতে। এর পরেই অগ্নিপথ-বিক্ষোভ। তার পরেই একের পর এক সরকারি বার্তা। বিভিন্ন মন্ত্রকের নিয়োগ পদ্ধতি বা আধাসামরিক বাহিনীর নিয়োগে ওই ৭৫ শতাংশ ‘অগ্নিবীর’দের জন্য সংরক্ষণ চালু করা হল।

আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য এই লেখা লিখতে গিয়ে অনেক পুরনো কথা মনে পড়ছে। আমি যখন সেনাপ্রধান, তখনও তো সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ হয়েছে। তখনও সেনাবাহিনীর পরীক্ষায় বিপুল ভিড় হত। এখনও হয়। সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর আগে কয়েকটি জিনিস বুঝে নেওয়ার চেষ্টা চলত। তার এক নম্বরে থাকত, সেই মুহূর্তে বাহিনীতে ঠিক কত সদস্যের প্রয়োজন রয়েছে। এটা নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর প্রাথমিক শর্ত। আমার বিশ্বাস, অগ্নিপথ প্রকল্প ঘোষণার আগে সরকার নিশ্চয়ই তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে কথা বলে সে সব নিয়ে সমীক্ষা করেছে। তার পর এই প্রকল্পের ঘোষণা হয়েছে। আসলে বাহিনীর সদস্য বাড়ানোর এক এবং একমাত্র উপায় হল নতুন নিয়োগ।

কিন্তু নিয়োগের আগে কয়েকটা ভাবনাগত ধাপ থাকা উচিত। আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করি।

আমাদের সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় ১৫ লক্ষ। প্রথমেই বুঝে নিতে হবে, দেশের এই মুহূর্তের পরিস্থিতিটা ঠিক কেমন। সেই পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে আমাদের সর্বোচ্চ কত সৈনিক প্রয়োজন। আমরা ১৫ লক্ষই রাখতে চাইছি? কমাতে চাইছি? নাকি আরও বাড়ানো প্রয়োজন? এর সবটাই নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপর। একটু নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, পাকিস্তান এবং চিনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এই মুহূর্তে কেমন, সেটাই পরিস্থিতি মাপার সবচেয়ে বড় মাপকাঠি। ওই দুই দেশ কিন্তু আমাদের চিরশত্রু। কূটনৈতিক ভাবে যদি তাদের মোকাবিলা না করা যায়, তা হলে যুদ্ধ তো আবশ্যিক। তাই না! এ বার দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হল— আমাদের টাকা আছে কি না। কারণ, সামরিক বাহিনীতে মানবসম্পদের অন্তর্ভুক্তি মানেই বাড়তি টাকা।

শুধু উচ্চমানের সৈনিকই নয়, বাহিনীর ব্যবহার্য হাতিয়ারের দিকটাও ভাবতে হবে। হাতিয়ার কেনার টাকা আছে কি না, সেটা গুরুত্ব-তালিকার তিন নম্বরে রাখতে হবে। হাতিয়ার প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলার আছে। অত্যাধুনিক হাতিয়ারের সবটাই আমাদের দেশে তৈরি করা যায় কি না, তা-ও এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে। আমরা অনেকটা করতে পেরেছি। কিন্তু আরও দরকার। এখানে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা (পাবলিক সেক্টর) রয়েছে। রয়েছে বেসরকারি সংস্থাও (প্রাইভেট সেক্টর)। তাদের সঙ্গে কথা বলে দাম-দস্তুর করে কাজটা করানো যেতেই পারে। কারণ, বিদেশ থেকে অস্ত্রপাতি কিনতে আমাদের প্রচুর ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। দেশে অত্যাধুনিক হাতিয়ার তৈরি করাতে পারলে আর্থিক সাশ্রয় হতে পারে।

তা হলে আসল কথা কী দাঁড়াল? মানবসম্পদের পাশাপাশি আরও একটা বিষয় এখানে মূল ফ্যাক্টর— অর্থ। সেই অর্থ কতটা আছে, সেটা একটা সরকারকে প্রথমেই ভেবে নিতে হয়। অর্থাৎ সরকারকে যেমন ভাবতে হবে, সামরিক বাহিনীতে ঠিক কত লোক এই মুহূর্তে প্রয়োজন, তেমনই ভাবতে হবে তার কাছে কত পরিমাণ অর্থ রয়েছে এই বাবদে ব্যয় করার মতো। মূলত এই দু’টি বিষয়কে মাথায় রেখেই একটা সরকারকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পদক্ষেপ করতে হয়।
আমার মনে হয়, সরকার আর্থিক জায়গা থেকেই ‘অগ্নিবীর’দের চুক্তিকালীন সময়টা চার বছর করেছে। ওই সময় শেষে ২৫ শতাংশের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তি এবং বাকি ৭৫ শতাংশকে এককালীন কিছু আর্থিক সুবিধা দিয়ে মূল স্রোতে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত— সবটার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে সরকারের আর্থিক সঙ্গতি বা অসঙ্গতি। আরও একটা জিনিস মনে রাখতে হবে আমাদের। প্রত্যেক সরকারের একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। এই সরকারেরও হয়তো থাকবে। সেটা অস্বাভাবিকও নয়। অগ্নিপথের নেপথ্যে রাজনৈতিক কোনও কারণ থাকতেই পারে। থাকতে পারে জাতীয়তাবাদী কোনও লক্ষ্যও। কিন্তু আমার মতো মানুষের পক্ষে সেটা বোঝা অসম্ভব।

এ বার একটা আশঙ্কার কথা লিখি। অগ্নি-বিক্ষোভের পর এই যে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওই ৭৫ শতাংশ ‘অগ্নিবীর’দের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করছে, এটায় হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, আগেই লিখেছি, আমাদের দেশে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়। ফলে ‘অগ্নিবীর’দের বাইরে আরও লাখো লাখো তরুণ-তরুণী রয়ে যাবেন এই সমাজে। তাঁরা সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে না চাইলেও উপকূলরক্ষী বাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন আধাসামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক। চাকরি করতে ইচ্ছুক অন্যান্য সরকারি কাজেও।

‘অগ্নিবীর’দের জন্য নতুন এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা দেশে আর এক আন্দোলনের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠবে না তো! ঘর পোড়া গরু! সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় তো লাগেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.