নিজেদের অস্ত্রেই নিজেরা ঘায়েল। ঘরের মাঠে স্পিন খেলতে ব্যর্থ হল ভারত। কখনও ফুলটসে আউট হলেন বিরাট কোহলি, কখনও আবার লাইন ভুল করে সোজা বলে আউট হলেন শুভমন গিল। আবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সে দেশে গিয়ে ব্যর্থ ইংরেজ ব্যাটারেরা। আগ্রাসী ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ভুগেছেন তাঁরা। ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মাও মানছেন রান করতে পারেননি ব্যাটারেরা, সেই কারণেই হারতে হয়েছে ভারতকে। দুই দলের স্পিনের বিরুদ্ধে দুর্বলতাই কি প্রকাশ্যে চলে আসছে?
ভারতের পিচ স্পিন সহায়ক। পুণেয় কালো মাটির পিচ ছিল। যে পিচে স্পিনারেরা বেশি সাহায্য পান। প্রথম দিন থেকেই বল যে ঘুরবে তা ভালই জানতেন রোহিতেরা। কিন্তু টস হেরে প্রথমেই বুমেরাং হয়ে যায়। পুণের ঘূর্ণি পিচে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করা কঠিন। আর সেই ইনিংসে যদি ৩৫৯ রানের লক্ষ্য মাথার উপর থাকে তা হলে চাপ অবশ্যই আরও বাড়ে। ম্যাচ শেষে রোহিত মেনে নিলেন ব্যাটারদের ব্যর্থতার জন্যই হারতে হয়েছে। যদিও তিনি কাউকেই দোষ দিতে চাইলেন না। তবুও বুঝিয়ে দিলেন, বোলারেরা যেমন ২০ উইকেট না নিতে পারলে টেস্ট জেতা যায় না, তেমনই রান না করলেও টেস্ট জয় সম্ভব নয়।
রোহিত যেটা মানতে চাইলেন না, সেটা হল ভুল শট নির্বাচন এবং স্পিন খেলতে না পারা, এই দুই কারণের জন্য তাঁর দলের ব্যাটিং ব্যর্থতা। প্রশ্ন উঠছে, আক্রমণাত্মক ক্রিকেটই কি ডোবাল নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে? বেশি শট খেলতে গিয়ে উইকেট হারালেন ব্যাটারেরা? রোহিত এ সব বিষয়ে পাত্তাই দিতে চাইছেন না। তিনি ভরসা রাখছেন দলের উপর। ভারত অধিনায়ক বলেন, “ক্রিকেটে সকলে নিজের শক্তির উপর বেশি বিশ্বাস করে। দুর্বলতার কথা কম ভাবে। শক্তি অনুযায়ী খেললেই সাফল্য আসে। আমরাও সেটাই করেছি। নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলেছি। হ্যাঁ, হতে পারে এই সিরিজ়ে আমাদের পরিকল্পনা কাজে আসেনি। নিউ জ়িল্যান্ড আমাদের থেকে এগিয়ে থেকেছে। তাই বলে তো আর একটা গোটা সিস্টেম বদলে ফেলব না। আমাদের খেলার ধরন একই থাকবে। এই দুই টেস্টে কোথায় কোথায় ভুল করেছি তা শুধরে পরের টেস্টে নামব।”
একই অভিযোগ উঠছে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেও। পাকিস্তানের মাটিতে পর পর দু’টি টেস্টে স্পিনারদের বিরুদ্ধেই হেরেছেন বেন স্টোকসেরা। ইংল্যান্ড এখন আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতেই টেস্ট খেলে। যে আগ্রাসনের নাম দেওয়া হয়েছে বাজ়বল (ইংল্যান্ডের কোচ ব্রেন্ডন ম্যাকালাম আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলাচ্ছেন দলকে। যে হেতু তাঁর ডাকনাম ‘বাজ়’, ইংল্যান্ডের ক্রিকেটকে বাজ়বল বলা হচ্ছে।) কিন্তু বাজ়বলের কারণেই ইংল্যান্ডকে ভুগতে হচ্ছে বলে মনে করছেন প্রাক্তন অধিনায়ক নাসের হুসেন। তিনি বলেন, “পিচ বদল করার জন্য পাকিস্তানকে অভিনন্দন। পর পর ছ’টি টেস্টে হারের পর সমর্থকেরা খুশি হতে পারছিল না। পিচ বদল করতেই ওরা বাজ়বল ভোঁতা করার ওষুধ পেয়ে গেল। পাকিস্তানের ভাল স্পিনার আছে এবং স্পিন খেলার ভাল ব্যাটার আছে। বল ঘুরতে শুরু করলেই ইংল্যান্ডের দাঁত বেরিয়ে যায়। ইংল্যান্ড না পারে পাকিস্তানের মতো স্পিন খেলতে, না পারে ওই মানের স্পিন বল করতে।”
স্পিন নিয়ে ভারতও কি একই রকম সমস্যায় ভুগছে? বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “ভারত ভুগছে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে। কানপুরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দু’দিনে জেতাটাই কাল হয়েছে। রোহিতদের শরীরী ভাষাতে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। মিচেল স্যান্টনার খুব বড় মাপের স্পিনার নয়। ও সাদা বলের ক্রিকেটার। প্রথম টেস্টে তো ওকে দলেও নেয়নি নিউ জ়িল্যান্ড। সেই স্পিনারকে উইকেট দিয়ে গেল ভারত। মাঠে নেমেই স্পিন খেলতে অসুবিধা হয় বিরাটের। ও পেসের বিরুদ্ধে খেলে ক্রিজ়ে থিতু হতে পছন্দ করে। কিন্তু ঘরের মাঠে সেটা সম্ভব নয়। কিউয়ি স্পিনারেরা সঠিক লাইনে টানা বল করে গিয়েছে আর তাতেই উইকেট দিয়েছে ব্যাটারেরা।”
প্রশ্ন উঠছে ভারতের দল নির্বাচন নিয়েও। আরও এক জন স্পিনার খেলালে কি ভাল হত? বাংলার অনূর্ধ্ব-১৯ দলে কোচ সৌরাশিস লাহিড়ী বললেন, “আকাশ দীপকে দলে নেওয়া হল, কিন্তু ৬ ওভারের বেশি বল করানো হল না। ঘরের মাঠে অক্ষর পটেলের সাফল্য দুর্দান্ত। কিন্তু তাঁকে খেলানো হল না।”
রোহিত যদিও মনে করেন, আগে থেকে এই উত্তর জেনে গেলে তো হয়েই যেত। কেউ তা জানতে পারে না বলেই তো একটা পরিকল্পনা করে নামে। তিনি বলেন, “এই টেস্টে পেসারদের কিছু করার ছিল না। নিউ জ়িল্যান্ডও তিন স্পিনার খেলিয়েছে। আমরাও। ওয়াশিংটন সুন্দর যে ভাবে বল করেছে তার জন্য আমি গর্বিত। সব রকম পরিস্থিতির কথা ভেবে আমাদের দল তৈরি করতে হয়। ভারতের মাটিতে আমরা ভালই খেলি। আগের সিরিজ়েও সেটা দেখা গিয়েছে। এই সিরিজ়ে পারিনি। তবে দুটো টেস্ট হেরে যাওয়ায় বেশি ভাবার কিছু নেই।”
ভারতীয় দলের চিন্তার কারণ অবশ্যই ব্যাটারদের আউট হওয়ার ধরন। পুণে টেস্টের প্রথম ইনিংসে শুভমন পা সামনের দিকে এগিয়ে ডিফেন্স করতে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন বল স্পিন করবে। সেই অনুযায়ী ব্যাট নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু স্যান্টনারের বল সোজা এসে লাগে শুভমনের পায়ে। এটা মাত্র এক বার নয়, বার বার দেখা গিয়েছে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন ব্যাটার বলের লাইন বুঝতে ভুল করেছেন। আর সেই কারণে আউট হয়েছেন। অর্থাৎ, ভারতীয় ব্যাটারদের মাথায় ঘুরছিল বল স্পিন করবে। সেটা ভেবে নিয়েই তাঁরা খেলতে নেমেছিলেন। কিউয়ি স্পিনারেরা একই লাইনে বল করে গিয়েছেন। কোনও বল ঘুরেছে, কোনওটা ঘোরেনি। তাতেই বিপত্তি।
যদিও বিরাট পুণে ম্যাচে প্রথম ইনিংসে আউট হয়েছিলেন ফুলটসে। তাঁর সেই আউটের কোনও ব্যাখ্যা করাই মুশকিল। সঞ্জয় মঞ্জরেকর সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, “বিরাট নিজেই বুঝতে পারবে যে, ক্রিকেটজীবনের সবচেয়ে খারাপ শট খেলে আউট হয়েছে।” সমালোচনা করেন অনিল কুম্বলেও। ভারতের অন্যতম সেরা স্পিনার এক সময় ভারতীয় দলের কোচ হয়েছিলেন। সেই সময় অধিনায়ক ছিলেন বিরাট। ফুলটস বলে বিরাট আউট হওয়ার পর কুম্বলে তাঁকে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “কোনও ম্যাচের একটা-দুটো ইনিংস হলেও ও সাফল্য পেত। অনুশীলনের থেকে অনেক বেশি কার্যকরী কোনও ম্যাচ খেলা। বাকিদের থেকে এগিয়ে থাকা যায়। কোহলি যদি মনে করে ঘরোয়া ক্রিকেটে ওর খেলা উচিত এবং দল যদি অনুমতি দেয় তা হলে নিশ্চয়ই খেলতে পারে। তবে আমার মনে হয় না স্পিনের বিরুদ্ধে ওর ব্যর্থতার এটাই একমাত্র কারণ।”
১২ বছর ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজ় হারার পর স্বাভাবিক ভাবেই আঙুল উঠছে নতুন কোচ গৌতম গম্ভীরের দিকেও। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক প্রাক্তন ক্রিকেটার বললেন, “রাহুল দ্রাবিড়ের জায়গায় এমন এক জনকে কোচ করা হল, যে এর আগে কখনও কোনও দলের কোচ ছিল না। আইপিএলের সাফল্য দেখে এত দিন ক্রিকেটার বাছা হত, এখন কোচ বাছা হচ্ছে। টেস্ট ক্রিকেট মানে প্রতিটা মুহূর্তে পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে। আর ভারতীয় ব্যাটারদের জো রুটকে দেখে শেখা উচিত। ও এমন এক জন ব্যাটার, যে পেসারের ১৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে আসা বলে রিভার্স সুইপ মারতে পারে, আবার দলের প্রয়োজনে ২০০ বল খেলে ২৫ রানও করতে পারে।”
ভারতের পরের ম্যাচ মুম্বইয়ে। সেই মাঠে এক দিনের বিশ্বকাপ জয়ের স্মৃতি রয়েছে সমর্থকদের। আবার নিউ জ়িল্যান্ডের অজাজ পটেল এই মাঠেই টেস্টে এক ইনিংসে নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। তৃতীয় টেস্টে ভারতীয় দল খেলতে নামবে নিজেদের লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে। কারণ ভারত এর আগে মাত্র এক বারই ঘরের মাঠে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল। ২৪ বছর পর সেই লজ্জার মুখে পড়তে চাইবেন না রোহিতেরা।